ক্রোধ বা রাগ মানুষের স্বভাবজাত একটি বিষয়। সবার মধ্যেই কম বেশি ক্রোধের বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তায়ালা রেখে দিয়েছেন। একদিকে ক্রোধ মানুষকে বিভিন্ন পাপ অপরাধ ও অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়। অন্য দিকে এটি একেবারে না থাকলেও অনেক সমস্যা। কোন ব্যক্তি, তার সম্পদ, ধর্ম, সন্তান, পরিবার, কারো দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হলে সে তাদের হেফাজত করার শক্তি পাবে না। সে এতে প্রভাবিত না হয়ে “স্বাভাবিক” হয়ে থাকবে। ফলে তার বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক সময় রেগে যাই। এই রেগে যাওয়ার পেছনে অনেক সময় যৌক্তিক কারণ থাকে। আবার কখনো তুচ্ছ কোন বিষয়, অথবা কোন কারণ ছাড়াই রাগ তৈরি হয়। এসকল ক্ষেত্রে রাগ করা খুবই নিন্দনীয় ও কদর্য ব্যাপার। কিন্তু রাগ হওয়ার ক্ষেত্রে যদি যৌক্তিক কারণ থাকে, তাহলে এমন রাগ তৈরি হওয়া দোষণীয় নয়। কারণ রাগ একটি স্বভাবজাত গুণ। তবে এক্ষেত্রে করণীয় হল, রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা, ক্রোধকে দমন করে সহনশীল আচরণ করা।
এর মানে হল, রাগের মুহূর্তে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মানুষের মনে প্রবল প্রতিশোধের যে ইচ্ছে জাগে, আল্লাহ তায়ালার সীমারেখা ভুলে গিয়ে যার উপর রাগ হল, তাকে কাজে কর্মে কথায় ঘায়েল করার যে তীব্র বাসনা জাগে, সেটা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা। এই বিরত থাকাটাই হল ক্রোধ সংবরণ। কুরআন হাদীসে এই ক্রোধ সংবরণের বিপুল সওয়াব ও বিরাট পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে রাগ তৈরির কাজ যে করল, নানা রকম ক্ষতি যে হয়ে গেল, বিধিমত এর প্রতিকার করা বা তাকে বিচারের মুখোমুখি করা, এগুলোর সাথে রাগ দমনের সংঘর্ষ নেই। ইসলামি শরিয়া প্রতিকারের অনুমোদন দেয় বরং মানুষের মধ্যে ন্যায়বচারকে নিশ্চিত করে।
ক্রোধকে সংবরণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীসটি থেকে বুঝতে পারি। মহান সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি নবীজির কাছে এসে আরজ করল, (হে আল্লাহর রাসূল) আমাকে সংক্ষেপে উপদেশ করুন, যাতে করে আমি ঠিকমত ধারণ করতে পারি। নবীজি উত্তরে বললেন, তুমি রাগ করো না। সে আবার বলল, আমাকে উপদেশ করুন। নবীজি বললেন, তুমি রাগ করো না। সে তৃতীয়বার উপদেশ চাইলেও নবীজি তাকে একই উপদেশ দিলেন। (মুসনাদে আহমদঃ ৮৭৪৪)
নবীজি বারবার তাকে রাগ না করা তথা রাগ সংবরণ করার উপদেশ দিলেন। এতে এটিই প্রমাণিত হয়, রাগ দম করা নবীজির নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ।
ক্রোধ থেকে তৈরি অপরাধ ও অনিষ্টতা
প্রশ্ন হচ্ছে, এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? কেনই বা নবীজি আগন্তুক ব্যক্তিকে বারবার একই উপদেশ দিলেন? হাদীসের ব্যখ্যাতাগণ এর কারণ বর্ণনা করেছেন। আমরা খেয়াল করলে দেখব, রাগ বহু অন্যায়ের উতসমূল। এই ক্রোধ থেকে বহু অন্যায় ও গোনাহ জন্ম নেয়।
যেমন রাগের সময় মানুষের আকল বুদ্ধি লোপ পায়। ফলে আল্লাহ তায়ালার সীমারেখা লংঘন করে ফেলে। যার উপর ক্রোধ তৈরি হল, সে যদি অধিনস্থ কেউ হয় তাহলে তাকে গালিমন্দ করা হয়, কখনো মারধরও করা হয়। অথচ এই অন্যায়গুলো স্বতন্ত্র গোনাহ।
আবার যার উপর ক্ষুব্ধ হলাম, সে যদি অধিনস্থ না হয়, তাহলে ভিন্ন ধরণের গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ছি। তার দোষ খোঁজা, গীবত করা, তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার মত ভয়াবহ গোনাহ হয়ে যাচ্ছে। অথবা তার প্রতি হিংসা করছি, ধংস কামনা করছি, মন্দ ধরণা করছি, বা তাকে নিয়ে উপহাস করছি।
কিংবা সে কোন বিপদে পড়লে আমি আনন্দিত হচ্ছি। কখনো দেখা যায়, যিনি রেগে গেলেন, তিনি প্রতিশোধ নিতে না পেরে নিজের ক্ষতি করে বসেছেন। নিজেকে আঘাত করছেন, কোন আসবাব পত্র ভেংগে রাগ মিটাচ্ছেন। পরিবার ও আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন।
রাগ মানুষকে কখনো কুফুরি কথা উচ্চারণ করা পর্যন্ত নিয়ে যায়। ফলে তার ইহকালের সাথে পরকালও বরবাদ হয়ে যায়। হাদিস শরীফে এসেছে, ক্রোধ ঈমানকে নষ্ট করে দেয়, যেভাবে মাকাল ফল মধুকে বরবার করে ফেলে। (শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকি)
ক্রোধ দমনের ফজিলত ও প্রাপ্তি
যেহেতু এই ক্রোধ উপরে বর্ণিত বহু অনিষ্ট ও গোনাহের কারণ হয়ে থাকে, এজন্য ক্রোধ সংবরণ করাকে কুরআনে কারিমে মুত্তাকি খোদাভীরু আল্লাহ ওয়ালা মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুরা আলে ইমরানে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ [آل عمران: 133 – 134]
আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। (আয়াতঃ ১৩৩-১৩৪)
শুধু খোদাভীরুদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই নয়, মুসলিম শরিফের একটি প্রসিদ্ধ হাদিস থেকে জানতে পাই, ক্রোধ সংবরণ করা, সহনশীল আচরণ করা আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত পছন্দের গুণ। হজরত ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণনা করেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রধান আশাজ্জকে বলেছিলেন,
إنّ فيك لخصلتين يحبّهما الله: الحلم والأناة
তোমার মধ্যে দুটি গুণ আছে। আল্লাহ তায়ালা এগুলোকে পছন্দ করেন। একটি হল সহনশীলতা, অপরটি হচ্ছে ধীরস্থিরতা। (সহি মুসলিমঃ ১৭)
বলার অপেক্ষা রাখে না, যিনি আল্লাহ তায়ালার পছন্দনীয় গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করবেন, তিনিও তাঁর ভালোবাসা অর্জন করবেন। এজন্য আমরা দেখি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ক্রোধ সংবরণকারি ব্যক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন,
ليس الشّديد بالصّرعة، إنّما الشّديد الّذي يملك نفسه عند الغضب
যে কুস্তিতে মানুষকে পরাজিত করে সে বীর পাহলোয়ান নয়, বীর তো সেই ব্যক্তি যে ক্রোধের সময় নিজের প্রবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। (সহি বুখারিঃ ৬১১৪, সহি মুসলিমঃ ২৬০৯)
এই ক্রোধ সংবরণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়, তেমনি এর বিপুল সওয়াব ও সম্মানজনক পুরষ্কারের ঘোষণাও এসেছে। একটি হাদীসে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ يَسْتَطِيعُ أَنْ يُنَفِّذَهُ دَعَاهُ اللَّهُ يَوْمَ القِيَامَةِ عَلَى رُءُوسِ الخَلاَئِقِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ فِي أَيِّ الحُورِ شَاءَ.
যে ব্যক্তি নিজ রাগ কার্যকর করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সংবরণ করে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তাকে সকল সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং তাকে তার পছন্দ অনুযায়ি যে কোন বেহেশতি হুর বেছে নেয়ার অধিকার দান করবেন। (সুনানে তিরমিযিঃ ২৪৯৩, সুনানে আবু দাউদঃ ৪৭৭৭) সবার সামনে ডেকে নেয়ার দ্বারা বিশেষ সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করা হবে। অপর এক হাদীসে নবীজি বলেছেন,
من كف غضبه كف الله عنه عذابه يوم القيامة
যে ব্যক্তি ক্রোধকে দমন করে রাখবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার থেকে শাস্তি ফিরিয়ে রাখবেন। (সুনানে বায়হাকি, মাআরিফুল হাদীসের সূত্রেঃ ২/১২৬) পরকালে বিশ্বাসি একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি ও সুসংবাদ আর কী হতে পারে!
দুটি হাদীস ও ক্রোধ সংবরণের অনুপম দৃষ্টান্ত
প্রসিদ্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ নবীজির একদিনের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তখন এক ব্যাক্তি বলল, এ বন্টনে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়নি। তারপর আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে চুপিচুপি তাকে এ কথা জানালাম। এতে তিনি ভীষণ রাগান্বিত হলেন এমনকি তাঁর চেহারা লাল হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, যদি আমি তার নিকট এ কথা না বলতাম! তারপর তিনি বললেন, নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) কে এর চাইতেও অধিক কষ্ট দেওয়া হয়েছে। এবং তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন। সহি মুসলিমঃ ২৩১৯
সহি বুখারিতে উমর রাঃ সম্পর্কে এমন একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। একবার এক লোক এসে তাঁকে বলল, আপনি তো বিচারের সময় ইনসাফ করেন না। মানুষের অধিকারও দেন না। একথা শুনে উমর রাঃ এর রাগ হল। চেহারা লাল হয়ে উঠল। তখন কেউ একজন তাকে বলল, আমীরুল মোমিনীন, আপনি কি আল্লাহ তায়ালার এই বানি শুনেন নিঃ “আপনি ক্ষমা করুন, সৎ কাজের আদেশ করুন, আর মূর্খলোকদের এড়িয়ে চলুন”। (সুরা আরাফঃ১৯৯) আর এলোকটি একজন মূর্খ মানুষ। তখন উমর রাঃ বললেন, তুমি সত্যই বলেছ। যেন তিনি রেগে আগুন হয়েছিলেন, একথা শুনে নিভে গিয়েছেন। সহি বুখারিঃ ৪৬৪২
রাগ মানুষের স্বভাবজাত একটি বিষয়। কম বেশি সবার মধ্যেই এই রাগ তৈরি হওয়ার প্রবণতা আছে। তবে ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, কোন কারণে কারো মধ্যে ক্রোধ তৈরি হলে একে দমন করা। মনের মধ্যে প্রতিশোধের তীব্র আকাংখাকে বাস্তবায়িত না করে সহনশীল হওয়া। যেমন উপরের দুটি হাদীসে আমরা দেখতে পাই। নবীজি নিজের ক্রোধ দমন করেছেন। নবীজির সাহাবি হজরত উমর রেগে যাওয়ার পরও তা দমে গেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করব? রাগকে দমন করার পদ্ধতি কী?
রাগ দমনে নবীজির দেখানো পদ্ধতি
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে মানব জাতির প্রতি রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছিলেন, ফলে মানবজাতির কোন ক্ষতি ও অকল্যাণ হবে, এটা তিনি কোন ভাবেই সহ্য করতেন না। অপরদিকে তাঁর কাছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অহি আসত, এবং পূর্ববর্তি ও পরবর্তিদের জ্ঞানও আল্লাহ তাঁকে দিয়েছিলেন। ফলে নবীজির নির্দেশনা ও শিক্ষার যে বৈশিষ্ট্য তা অন্য কারো নিকট অনুপস্থিত। এজন্য রাগ দমন হোক আর অন্য যেকোন বিষয় হোক, প্রত্যেক বিশ্বাসি মুমিন সর্বক্ষেত্রে নবীজির শিক্ষা ও নির্দেশনা কী? এটি জানতে ও পালন করতে পরম আগ্রহি থাকেন। এবং এর মধ্যেই ইহকাল ও পরকালের পূর্ণাংগ সাফল্য রয়েছে, বিশ্বাস করেন। তাই রাগ দমনে নবীজির নির্দেশনা ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা জরুরি। হাদীসের ভান্ডারে অনুসন্ধান করলে আমরা দেখি, নবীজি এ বিষয়ে আমাদেরকে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি তুলে ধরছি।
- রাগের সময় “আউযুবিল্লাহ” পাঠ করা
সুলাইমান ইবনু সুরাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে বসা ছিলাম। তখন দু’জন লোক পরস্পর গাল মন্দ করছিল। তাদের এক জনের চেহারা লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার রগগুলো ফুলে গিয়েছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি এমন একটি দু’আ জানি, যদি লোকটি পড়ে তবে সে যে রাগ অনুভব করছে তা দুর হয়ে যাবে। তিনি বললেন, সে যদি পড়ে “আউযূবিল্লাহি মিনাশ শায়তান” (আমি শয়তান হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই) তবে তার রাগ চলে যাবে। (সহি বুখারিঃ ৩০৫২)
- নিরবতা অবলম্বন করুন
রাগের সময় চুপ হয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই রাগ দমিত হয়ে যাবে। নিজের ভেতরেই চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু চুপ না করে যদি কথা চালিয়ে যায়, তাহলে সমাধান তো কিছু হবেই না, উলটো আগুনে ঘি ঢালা হবে। রাগের পরিমাণ আরো বাড়তে থাকবে। হজরত ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণিত এক হাদীসে নবীজি বলেন, তোমাদের কারো যখন রাগ হয়, সে যেন চুপ থাকে। (মুসনাদে আহমদঃ ২১৩৬)
- ক্রোধের সময় দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়ুন, এরপর শুয়ে যান
আবু যর রাঃ বর্ণনা করেছেন, নবীজি বলেন, তোমাদের কারো যখন রাগ আসে, আর সে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে তাহলে সে যেন বসে পড়ে। এতে তার রাগ যদি চলে যায় তাহলে তো হল। কিন্তু তাতে যদি রাগ না যায় তাহলে সে শুয়ে পড়ুক। (সুনানে আবু দাউদঃ ৪৭৮২) এই নির্দেশনার অনেক উপকারিতা রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল, দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লে তার শক্তি ও উদ্যমে ভাটা পড়বে। যে অনাকাংখিত কর্মকান্ড রাগের সময় ঘটানোর আশংকা থাকে, বসে গেলে এর অনেক কিছুই করতে পারবে না। আর শুয়ে পড়লে তো এই আশংকা আরো কমে যাবে।
- রাগ দমনের জন্য অজু করুন
হজরত আতিয়্যা ইবনে উরওয়া রাঃ বর্ণনা করেছেন, নবীজি বলেন, রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তানকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আগুনকে পানির সাহায্যে নিভাতে হয়। তোমাদের কারো ক্রোধ তৈরি সে যেন অজু করে নেয়। (সুনানে আবু দাউদঃ ৪৭৮৪)
রাগ দমনের এ এক অব্যর্থ ব্যবস্থাপত্র। প্রচন্ড রাগের সময় কেউ যদি অজু করতে চলে যায়, এবং ধীরস্থির ভাবে সুন্নত মোতাবেক অজু করে, তাহলে মনে হবে বাস্তবেই আগুনকে পানি ঢেলে ঠান্ডা করা হয়েছে। যেন অজুর পানি ঝরার সাথে সাথে শরীর থেকে ক্রোধও ঝরে পড়ছে!
নবীজির প্রসিদ্ধ সাহাবি মুয়াবিয়া রাঃ একদিন খুতবা দিচ্ছিলেন, সে সময় এক ব্যক্তি তাকে বলে উঠল, আপনি মিথ্যা বলেছেন! তখন তিনি রাগ করে মিম্বর থেকে নেমে ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসলেন, তখন তার দাড়ি থেকে পানি ঝরছিল। এভাবে তিনি মিম্বরে উঠলেন এবং বললেন, হে লোক সকল! রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তানকে আগুন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তোমাদের কেউ রেগে গেলে সে রাগকে যেন পানি দ্বারা নিভিয়ে দেয়। তারপর তিনি আগের বক্তৃতা শুরু করলেন। (ইবনে কুতাইবা রচিত উয়ুনুল আখবারঃ ১/৪০৫)
- রাগের সময় মানুষকে নিজের জায়গা থেকে নয়, তার জায়গা থেকে বিবেচনা করুন
রাগের সময় আমরা এই চিন্তাটা করতে পারি। যেমন একজন অশিক্ষিত মানুষের উপর তার অন্যায় ও অযাচিত আচরণের কারণে আমার রাগ তৈরি হল। এখন রাগটা তার উপর প্রয়োগ করার আগে ভাবতে পারি, আসলে তার যদি শিক্ষা থাকত, সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি থাকত তাহলে তো সে একাজ করত না। তাই আমি তাকে অপারগ মনে করছি! এমনিভাবে কোন শিশু যদি রাগ উদ্রেককারি কোন কান্ড করে, তাহলে এক্ষেত্রে সে যে শিশু, বুঝমান পূর্ণবয়ষ্ক নয়, এটি বিবেচনা করে রাগকে দমিয়ে রাখতে পারি। হ্যাঁ, যদি গুরুতর অপরাধ করে ফেলে, তাহলে ঠান্ডা মাথায় শাসন করতে পারি, সেটা ভিন্ন বিষয়।
সহনশীলতা কিভাবে অর্জন করব?
এতো ছিল, যখন কেউ রেগে যাবে, তখন তাতক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে মৌলিক কিছু কথা। তবে রাগ দমনকে নিজের স্বভাবে পরিণত করা এবং সহনশীলতার গুণকে সর্বদা ধারণ করার জন্য কিছু বিষয় সামনে রাখা দরকার।
- খুব দ্রুত রেগে যাওয়াকে সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। অনেককে দেখা যায়, তাদের রাগ বেশি, তারা খুব রাগ করেন, এনিয়ে তাদের মধ্যে একধরণের ভালোলাগা কাজ করে। এজায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এবং এসমস্যার সমাধানের পথ নিয়ে ভাবতে হবে।
- ক্রোধ দমন করে সহনশীল আচরণ করার যে বিপুল সওয়াব ও পুরষ্কারের ঘোষণা কুরআন হাদীসে এসেছে, এগুলো বেশি বেশি পড়া, মনে রাখা, এবং চর্চা করা। শুধু জাগতিক উপকার নয়, রাগ দমন আল্লাহ তায়ালার আবশ্যকিয় বিধান, এই বিশ্বাস ও চেতনাকে লালন করা।
- আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের সাথে যে সীমাহীন সহনশীল আচরণ করেন, এটা বিশেষভাবে ভাবা। মানুষ কত অগণিত নাফরমানি অবাধ্যতা করে। বারবার আল্লাহ তায়ালার সীমারেখা লংঘন করে, তবুও তিনি ছাড় দেন। তাঁর ক্রোধ প্রকাশ করে মানবগোষ্ঠিকে -যার মধ্যে আমিও রয়েছি- ধ্বংশ করে দেন না। সেই তুলনা আমি যার উপর রাগ হচ্ছি, তার অপরাধ ও অবাধ্যতা তো অনেক ক্ষুদ্র। তাই আমার সহনশীল হওয়া কর্তব্য।
- ক্রোধ প্রকাশ না করে, সহনশীল হওয়ার মধ্যে যেসকল উপকারিতা ও কল্যাণ রয়েছে, এগুলো নিয়ে চিন্তা করা। যেমন এর মাধ্যমে পারষ্পরিক কল্যাণকামনা ভালোবাসা ও হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। হিংসা বিদ্বেষ শত্রুতা দূর হয়। অপরদিকে ক্রোধ প্রকাশ করলে বহুবিধ অকল্যাণ ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।
(সৌজন্যে, মাসিক নেয়ামত)