প্রিয় অনুজ আফফান লাবীব তাদের ‘শামাদান’র জন্য লেখা চেয়েছে। শামাদানের কোনো সংখ্যা আগে পড়া হয়নি। ফলে এটা কোন ধরণের পত্রিকা আমার জানা নেই। পত্রিকার ধরণ না জেনে লিখতে যাওয়াটা লেখক ও সম্পাদক উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর। সে ঝুঁকি না নিয়ে বরং এলেবেলে ধরণের কিছু সাংসারিক গল্প করা যাক।
বেকায়দায় পড়লে চেহারা গম্ভীর করে তাত্ত্বিক হয়ে ওঠাটা আমার পুরনো স্বভাব। দুদিন আগে ভীষণ এক জবাবদিহির মুখে পড়লাম। অভিযোগ গুরুতর। আমি নাকি বাচ্চাদেরকে শাসন না করে প্রশ্রয় দিই।
এই অভিযোগকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে কাটিয়ে ওঠার একটা সুযোগ হয়তো ছিল; কিন্তু যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযোগ সে ঘটনায় আমি এতো সুস্পষ্ট রকমের দোষী যে, একে অস্বীকার করতে হলে অনেক বেশি নির্লজ্জ হতে হবে। ফলে, এই মুহূর্তে বোকার মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কোনো জবাব নেই। কিন্তু লা জবাব হয়ে বসে লজ্জা পাওয়ারও কোনো মানে হয় না। তারচেয়ে চোরাই পথে তত্ত্বে ঢুকে পড়াটা ভালো হবে।
একটু সময় চুপ করে রইলাম। বিষয়টা আমি গুরুত্বের সাথে নিয়েছি এবং গভীরতর মনোযোগের সাথে জবাবদিহি করছি—এ ব্যাপারটা যথেষ্ট পরিমাণে ফুটিয়ে তুলতে হলে অপলক চোখে নিচের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকতে হবে, গাম্ভীর্যের সাথে খুব সূক্ষ্ম একটা করুণ হাসির সামান্য আভাস ছড়িয়ে রাখতে হবে। যত্নের সাথে এই পর্বটা শেষ করে অতঃপর ধীরে মাথা উঠিয়ে বললাম—‘আসলে শাসন জিনিসটা বহুমাত্রিক। পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ভিতর দিয়ে আমরা এর বিভিন্ন মাত্রার সন্ধান পেতে পারি। ফলে, আমাদের উচিত নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার ভাবাবেগ থেকে বেরিয়ে বিষয়টা নিয়ে মৌলিক আলোচনায় অংশ নেওয়া। এবং এটাই হয়তো প্রকৃত সমাধান। এখন, আমরা কি এটা করতে পারি?’ এমন পরিস্থিতিতে দার্শনিক আলোচনার আহ্বান বিশেষ সুবিধার কিছু নয়; তবু, আমার গাম্ভীর্য, সদিচ্ছা ও সততা দেখে অপর পক্ষ নিমরাজিমতো হলেন।
এরপর বেশ কিছু সময় ধরে যুক্তিতর্ক চলল, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের বয়ানও হাজির করা গেল। ফাঁকে দুবার তিনি কথা প্রসঙ্গে না কি উদাহর দিতে গিয়ে যেন মাত্রই পেরিয়ে আসা সেই ঘটনায় ঢুকে পড়তে চাচ্ছিলেন, যেই ঘটনায় আমি একচেটিয়া দোষী এবং যেই ঘটনা থেকে পালানোর জন্যই এতো তত্ত্ব ও দার্শনিকতার আয়োজন। তবে আমি সাথে সাথে বাধা দিয়ে বলেছি—মৌলিক ও মূলনীতিধর্মী আলোচনায় শাখা বিষয় উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে সত্য, কিন্তু এর জন্য এই ঘটনাটি না আনাই ভালো হবে। কারণ, ব্যাপারটা সদ্য ঘটেছে। যেটুকু সময় পেরিয়ে গেলে একটি ঘটনার সবদিক পরিস্কার হয়ে নির্মোহ বিচারের পরিস্থিতি তৈরী হয়, এই ঘটনাটি সে সময়টা পায়নি। এর প্রতিক্রিয়া ও রেশ এখনো দু পক্ষের মনের ভিতরেই রয়ে গেছে। ফলে, এটা আমাদের আলোচনাকে খারাপভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
এভাবে কথাবার্তা বেশ কিছু সময় চললেও আমি বিশেষ সুবিধা করতে পারিনি। কারণ নিরেট বিষয়নিষ্ঠ আলোচনা তো আমার উদ্দেশ্য ছিল না। মূলত জান বাঁচাতে এই রুক্ষ প্রান্তরে এসে অনিচ্ছায় উপনীত হয়েছি। ভিতরে ভিতরে সদিচ্ছার এই অভাব কিংবা শুন্যতা নিয়ে সুবিধা যে করা যাবে না, তা অনুমেয়েই।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো: কিছুটা খেলাচ্ছলে শুরু করলেও শেষে গিয়ে মনে হলো দু পক্ষের আলোচনার পরিণতি ও পরিসমাপ্তি থেকে বেশ সুন্দর কয়েকটি বিষয় পাওয়া গেল। গল্পের শেষ দিকে এসে সে বিষয়গুলো তুলে দিলে মন্দ হয় না।
যেমন,
১. মা এবং বাবা দুজনেই বাচ্চাকে শাসন করবে নিজের রেফারেন্সে। মা যদি বাবার ভয় দেখায় কিংবা বাবা যদি দেখায় মায়ের ভয়, তাহলে শিশুটির কাছে প্রত্যেকের শাসনের উপযুক্ততা ও ন্যায্যতা নষ্ট হয়। যেমন, মা সন্তানকে এ কথা বলবে না—দাঁড়া, বাবা আসুক, সব বলে দিব। দেখা যাবে সন্তান শুধু বাবাকেই শাসনের উপযুক্ত মনে করতে থাকবে। মাকে শুধু এ কারণে মান্য করবে যে, তিনি বাবাকে বলে দিতে পারেন। এতে ভারাসাম্য নষ্ট হবে।
২. মাঝে মাঝে বিশেষ কোনো শাসনের বিষয় মা বাবার হাতে ন্যাস্ত করতে পারেন। সে সময় পুরো বিষয়টিই ন্যাস্ত করবেন। শুধু এটুকু বলবেন না যে, আপনার মেয়েকে ধমক দেন বা আপনার মেয়েকে কিছু বলেন। কারণ, এতেও ভারসাম্য নষ্ট হবে। সন্তান ভাবতে পারে—বাবা নিজে যাচাই করেন না। মা যা বলেন তাই শুনেন। এটা তাকে বাবার ব্যাপারে খারাপ অনুভূতি দিবে, মায়ের ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব তৈরী করবে।
৩. শাসনের প্রয়োজনে সন্তানকে পরিমিতভাবে দুঃখ দেওয়া যাবে, মন খারাপ করানো যাবে, অনুতপ্ত করানো যাবে; কিন্তু সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে সে যেন শাসনের প্রতি বিরক্ত না হয় এবং তার ভিতরে যেন বিদ্রোহ তৈরী না হয়। বিরক্ত হওয়ার নানান কারণ থাকতে পারে। এসবের মধ্যে বিশেষ একটি কারণ সম্ভবত—শাসনের সুরে বেশি কথা বলা। মানুষ খোশগল্পের সময় বেশি কথা শুনতে পারে; কিন্তু শাসনের সুরে বেশি কথা নিতে পারে না। কারণ, শাসনের মুখোমুখি হলে সে গ্লানি বোধ করে। মা বাবার মমতা, নৈকট্যবোধ ও শ্রদ্ধাবোধের কারণে গ্লানির এই উপলব্ধি অনেক দূর সয়ে নিলেও যখন বেশি হবে, তখন বিরক্ত হতে শুরু করবে। ধীরে সম্পর্ক নষ্ট হবে। এক সময় সন্তান ঘরের চেয়ে বাইরে থাকতে বেশি পছন্দ করবে।
কিন্তু মুশকিল হলো, কথা বেশি হলো না কম হলো এটা ঠিক করবে কে? এর সমাধান অতো সহজ নয়। তবে দু পক্ষই একমত হলাম—কথা কমানোর বিষয়টা আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করা হলে, কথারা একসময় কমবেই। এবং উভয় পক্ষ এটাও স্বীকার করলাম যে, কথা কম বলার অর্থ কী? বা কী পরিমাণ কথাকে ‘কম কথা’ বলা যায়—এটা নিজেই আরেকটা দার্শনিক আলোচনা। এ নিয়ে আলাদাভাবে বসতে হবে।

অপরদিকে বিদ্রোহ তৈরী হওয়ারও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম একটা কারণ হলো—কোনো নির্দেশ জোর করে মানাতে চাওয়া। এখানে এসে বেশ একটু দ্বন্দ্বে পড়া গেল। কারণ, বিদ্রোহ জাগতে পারে এই ভয়ে যদি ছাড় দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে প্রায় দিনই সন্তান মাদরাসায় না গিয়ে পথে ঘাটে হেসেখেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিংবা ঘুমানোর জন্য বিছানায় আসছে রাত একটায় কি দেড়টায়। তবে, শেষমেশ একটা সমাধান পাওয়া গেল এই যে,
আমরা সন্তানদেরকে যা যা মানাতে চাই, তা মোট ৩ ধরণের।
ক. এমন কাজ, যা এখনই পালন করা জরুরী নয়। কাজটা সে পরে করলেও হবে বা বড়ো হতে হতে একসময় শিখে নিলেই হবে। এসব ক্ষেত্রে মানানোর জন্য তার পিছনে লেগে না থাকা উচিত। দাওয়াত ও নির্দেশনা দিব, তারপর চোখ ফিরিয়ে নিব। বলার সাথে সাথে করল না কেন—এই বলে জেদ ধরব না।
খ. কাজটা এমন যে, এখনই করতে হবে না; তবে নিকট সময়ে করাটা আবশ্যক। এসব ক্ষেত্রে প্রথম নির্দেশেই মানানোর জন্য জেদ না ধরে একটু বিরতি নিয়ে নিয়ে নির্দেশ দিতে থাকা বা বলতে থাকা। যেমন, ঘুম থেকে ওঠানো। মাদরাসার ক্লাস হয়তো সাড়ে নয়টায়। ঠিক নয়টায় প্রস্তুত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। এমন অবস্থায় সাড়ে আটটায় দুতিন বার ডাক দিয়ে সরে যাব। দশ মিনিট পর আবার। এরও পাঁচ সাত মিনিট পর আবার। এই বিরতিটুকু তাকে নির্দেশ মানতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি প্রথমবারেই নির্দেশ মান্য করার জন্য তাকে নানাভাবে উৎসাহিতও করতে হবে।
গ. এমন কাজ যা এখনই করতে হবে। যেমন, দাঁত ব্রাশ করে ঘুমাতে যাওয়া। এ জাতীয় কাজগুলোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় নাম্বারের পলিসি অনুসরণ করে একটু আগে থেকে নির্দেশনা দিয়ে আসলে সহজ হবে। পাশাপাশি কড়া স্বরে হুকুমের পর হুকুম বা হুমকি ধমকি না দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে এবং তার মনোযোগটা অন্য সকল কিছু থেকে বিযুক্ত করে নিজের দিকে ফেরাতে হবে। পাশাপাশি কাজটাকে তার জন্য যথাসম্ভব সহজ করে দিতে হবে। এরপরও একান্ত মানতে না চাইলে শাসন নিশ্চয়ই করা যাবে, তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন মনে হবে এখন শাসন করলে সে বিদ্রোহমূলক আচরণ করবে, তখন কিছু সময়ের জন্য তাকে স্বাধীন করে দেওয়া উচিত। যেন তার মনটা তুলনামূলক শান্ত হয়ে আসে, আমাদের নিজেদের ভিতরে জমা হওয়া ক্ষোভটাও প্রশমিত হয়। এই বিরতিটা খুবই জরুরী।
কিন্তু কথা হলো এই যে, গল্প বলতে গিয়ে কথাবার্তা শেষ পর্যন্ত অত্যাধিক গুরুগম্ভীর আর উপদেশটাইপ হয়ে গেল। এটা মোটেও ঠিক কাজ করলাম না। আর, এই লেখা কোনো কারণে শামাদানে প্রকাশ হলে শামাদানকে আর কোনোভাবেই ঘরে আনা যাবে না। জানের ডরভয় তো আসলে সবারই আছে!