উদারতা ও সহজতা: জীবনে আনে অনাবিল প্রশান্তি

সাহাবী আনাস ইবনে মালিক বলেন, একদিন আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে  রাস্তায় চলছিলাম। তাঁর গায়ে ছিল মোটা আঁচল বিশিষ্ট একটি নাজরানি চাদর। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে খুব জোরে টেনে ধরল। আমি লক্ষ করলাম, জোরে টানার কারণে নবীজির কাঁধে চাদরের দাগ পড়ে গেছে। বেদুইন লোকটি বলল, আল্লাহর যে সম্পদ আপনার কাছে আছে, তা থেকে আমাকে কিছু দেয়ার নির্দেশ দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং তাকে কিছু সম্পদ দেয়ার নির্দেশ দিলেন। (সহি বুখারী, হাদীস ৩১৪৯)

নবীজি তাকে ধমক দেননি, তার প্রতি রাগও প্রকাশ করেননি। অথচ লোকটি যে আচরণ করেছে এবং যে ভাষায় কথা বলেছে, একারণে তাকে শাসিয়ে দেয়া এবং তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করা ছিল যৌক্তিক ও আইনত অধিকার। নবীজি তার সাথে যে আচরণ করেছেন এর মধ্য দিয়ে অনেকগুলো উত্তম আখলাক বা সুন্দর স্বভাবের প্রকাশ ঘটেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে উদারতা ও সহজতা। 

উদারতার পরিচয়

উদারতা মানে-

  • সহজ পথ অবলম্বন করা।
  • নিজের অধিকারে কিছুটা ছাড় দেয়া।
  • কারো থেকে ছোট খাটো ভুল হয়ে গেলে এড়িয়ে যাওয়া
  • পীড়াপীড়ি না করে স্বাচ্ছন্দ্যতা ধরে রাখা।

বস্তুত উদারতা ও সহজতা ইসলামের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে বলেছেন, আমি প্রেরিত হয়েছি সঠিক ও সহজ-সরল ধর্ম নিয়ে। (মিরকাত, ৬/১৯১) নবীজি আরোও বলেছেন, যে বস্তুতেই কোমলতা আসে তা সুন্দর হয় আর যে বস্তু থেকেই তা উঠিয়ে নেয়া হয় তা ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে। (সহি মুসলিম, হাদীস ২৫৯৪)

একটি উদাহরণ

এজন্য আমরা ইসলামের সমস্ত বিধানের ক্ষেত্রে এই সহজতা সরলতা ও উদারতার উপস্থিতি ব্যাপকভাবে দেখতে পাই।

ইসলামের দ্বিতীয় রুকন নামাজের কথাই ধরা যাক। নামাজের মূল বিধান হচ্ছে দাঁড়িয়ে আদায় করা। কিন্তু অসুস্থতার কারণে কোন ব্যক্তি যদি দাঁড়াতে অক্ষম হন, তাহলে বসে নামাজ পড়বেন। কেউ যদি বসতে না পারেন তাহলে তাকে শুয়ে আদায় করার অনুমতিও দেয়া হয়েছে। (সহি বুখারি, হাদীস ১১১৭) আল্লাহ তায়ালা যেমন ইসলামের প্রতিটি বিধানে উদারতা ও সহজতা রেখেছেন, ঠিক তেমনি ইসলাম মানুষকে তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উদারতা ও সহজতা লালন করার শিক্ষা দিয়েছে।

উদারতার ক্ষেত্র ও একটি ভ্রান্তির অপনোদ

কুরআন হাদীসের সামগ্রিক বক্তব্যকে সামনে রাখলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে তাহলো, উদারতা ও সহজতার ক্ষেত্র হচ্ছে-

দৈনন্দিন কাজকর্ম, নিজের ব্যক্তিগত বিষয়, লেনদেন, কেনা-বেচা, পারষ্পরিক সম্পর্ক, চলাফেরা, কথাবার্তা, মানুষ পরিচালনা করা, শিক্ষাদান, সামাজিক বিভিন্ন সম্পর্ক-রীতি-অনুষ্ঠান ইত্যাদি।

তার মানে, অপর ব্যক্তির আর্থিক বা অন্য কোন অধিকারের ক্ষেত্রে প্রাপ্য অংশ না দেয়া উদারতা নয়। এটি বরং গাফলতি ও অন্যায়। একই কারণে কোন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে অবহেলাকেও উদারতা হিসেবে গণ্য করা হবে না।

অপরদিকে যিনি প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিচ্ছেন কিংবা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করছেন, তাদের কাউকেই ‘কঠোর’ বা ‘অনুদার’ বলারও অবকাশ নেই। 

উদারতা প্রসংগে একটি জরুরি বিষয়

অনেককেই দেখা যায়, ধর্মীয় কোন বিধান পালন করছেন না অথবা ইসলামে নিষিদ্ধ কোন কাজ করে ফেলছেন। এরপর নিজের খুশিমতো একে নাম দিচ্ছেন ‘উদারতা’। এর মাধ্যমে তারা নিজেকে প্রমাণ করতে চান ‘উদার’ ‘যুগের সাথে চলা মানুষ’ বা ‘অসাম্রদায়িক’ হিসেবে।

বিপরীতে তাদের আরোপিত এই উদারতা গ্রহণ না করে যারা ইসলামের মূল শিক্ষাকে ধারণ করেন মজবুতভাবে, তাদেরকে অভিহিত করতে চান ‘সেকেলে’ ‘গোড়া’ ‘কট্টর’ জাতীয় নেতিবাচক অভিধায়। 

খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা  দরকার, তাদের এই আচরণ ভ্রান্ত, অন্যায় ও ইসলামী শিক্ষার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। 

তার কারণ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা ইসলামে যে সকল বিধান দিয়েছেন সব কিছুতেই নিজ থেকে শুরুতেই সহজতা ও উদারতা রেখেছেন। (দ্রষ্টব্যঃ  সূরা হজ, আয়াত ৭৮) ফলে কোন মুসলিম “উদারতা”র নাম দিয়ে দ্বীনের কোন বিশ্বাস বিধান বা শিক্ষাকে বর্জন করার  অধিকার রাখেন না। এমনিভাবে ইসলামে নিষিদ্ধ কোন বিষয়কেও গ্রহণ করতে পারেন না। যদি করেন তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে এটি “উদারতা” নয়, মুদাহানা বা শীথিলতা হিসেবে গণ্য হবে। ইসলামে শীথিলতা অপরাধ ও গোনাহের কাজ। (দ্রষ্টব্য, সুরা কলম, আয়াত ৯) 

তাছাড়া নিজের ধর্ম পালন করলে সাম্প্রদায়িকতা হয়ে যাবে এবং “অসাম্প্রদায়িক” হওয়ার জন্য ধর্মীয় কিছু বিধানকে এড়িয়ে যেতে হবে, সাম্প্রদায়িকতার এমন সংজ্ঞা ও পরিচয় কিছু মানুষের নিজস্ব আবিষ্কার। এর পক্ষে যুক্তিও নেই, দলীলও নেই। 

মূল কথা হচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে আকীদা বিশ্বাস, ধর্মীয় বিধি বিধান, ইসলামি আদর্শ  চেতনা ও মূল্যবোধ, এসকল ক্ষেত্রে উদারতা দেখানোর কোন সুযোগ নেই। বরং এগুলোকে মজবুত ও শক্তভাবে আকড়ে ধরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ।  (দ্রষ্টব্য- সুরা যুখরুফ, আয়াত ৪৩ , সুনানে তিরমিযি, হাদীস ৪৬০৭)

হাদীসের আলোকে উদারতার কয়েকটি ফলাফল

১. নবীজি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করুন সেই ব্যক্তিকে যে উদারতা অবলম্বন করে কোন কিছু বিক্রি করার সময়, কিছু কেনার সময় এবং ঋণ আদায়ের সময়। (সহি বুখারি, হাদীস ২০৭৬) তার মানে উদারতা অবলম্বন করার মাধ্যমে যে কেউ নবীজির রহমতের দোয়া লাভ করতে পারে! কী অসাধারণ সৌভাগ্য!

২. সহি মুসলিমে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্থ ব্যক্তির জন্য সহজতা করবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার জন্য সহজতা তৈরি করবেন। (হাদীস: ২৬৯৯) পাওনা আদায়ে সময় ও সুযোগ দেয়া, কিছু অংশ বা পুরো অংশ ক্ষমা করে দেয়া, এসবই সহজতার অংশ। 

৩. অন্যত্র নবীজি ইরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে বলে দিব, জাহান্নাম কার উপর হারাম? ঐ ব্যক্তির উপর জাহান্নাম হারাম, যে (মানুষের) ঘনিষ্ট, সহজ, উদার। (সুনানে তিরমিযি, হাদীস ২৪৮৮) 

৪. আরেক হাদীসে এসেছে, ঈমানের সর্বোত্তম (শাখা) হল, উদারতা-সহজতা ও ধৈর্য্যধারণ করা। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস ৩১০৩২, কানযুল উম্মাল, হাদীস ৭৪)

দৈনন্দিন জীবনে উদারতার বিস্তৃত প্রভাব

একটু খেয়াল করলে বাস্তব জীবনে উদারতা ও সহজতার বিপুল কল্যাণ উপলদ্ধি করা যায়। যে ব্যক্তি উদার, সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, তার জীবন হয় নির্ঝঞ্ঝাট, অযাচিত পেরেশানি ও জটিলতা থেকে মুক্ত। এই সহজতার কারণে মানুষের ভালোবাসা যেমন লাভ করেন, তার অন্তরও হিংসা বিদ্বেষ থেকে পবিত্র থাকে। ফলে তার মন ভালো থাকে, প্রফুল্লতা ও উদ্যম হয় তার নিত্য সঙ্গী। এভাবে হাদীসে বর্ণিত বিপুল সওয়াবের সাথে সাথে বাস্তব জীবনেও উদার মানুষ দারুণ লাভবান হয়ে থাকেন।

উদারতার কয়েকটি দিক

গুরুত্বের বিচারে উদারতার কয়েকটি দিক এখানে আলোচনা করতে চাই।  

১. দাম্পত্য জীবনে উদারতা

স্বামি-স্ত্রী একে অন্যের সাথে ক্ষুদ্র থেকে বড় প্রায় সকল বিষয়ে অংশীদার। মানুষ হিসেবে দুজনের পছন্দ অপছন্দ, রুচিবোধ, বিচার বিশ্লেষণ ভিন্ন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এজন্য স্বামী বা স্ত্রী চাইলে অগণিত বিষয়ে একে অন্যের সাথে দ্বিমত করতে পারে, প্রকাশ করতে পারে নিজের দ্বিমত বা অপছন্দ। এখন যদি বিষয়টি শরীয়তের নিষিদ্ধ কোনো কিছু না হয়ে থাকে তাহলে অপর পক্ষের তা নিয়ে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা করা কি উচিত?

দুজই যদি নিজ নিজ অধিকার, বক্তব্য বা অবস্থানে অনড় থাকেন, ধীরে ধীরে তাদের বন্ধন হালকা হতে থাকবে। সময়ের সাথে বেড়ে চলবে পারিষ্পরিক দূরত্ব। অথচ মূল বিষয়টি অতো বড় কোন ব্যাপার ছিল না। শুধু ছিল সহজভাবে গ্রহণ করা ও উদারতার ঘাটতি। তাই এ জায়গাটাতে উদারতার চর্চা খুব বেশি প্রয়োজন। 

২. বিয়ের আয়োজন অনুষ্ঠানে সহজতা

মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষঙ্গটিকে অদরকারি বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করে জটিল করে তোলা হয়েছে। অনেক সময় এমন হয়, সব কিছু ঠিকঠাক ও চূড়ান্ত, তখন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়কে অনেক বড় করে দেখা হয় এবং এই সূত্র ধরে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পথে তৈরি হয় বাধা। এখানেও আমাদের অনেক বেশি উদারতা অবলম্বন করে বিয়েকে স্বাভাবিক ও সহজ রাখা কর্তব্য।

৩. সামাজিক অন্যান্য আয়োজন অনুষ্ঠানে উদারতার চর্চা

সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই। ইসলামের মৌলিক নির্দেশনাও এমনই। এক মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে নানা সূত্রে যুক্ত হবে। তাদের মধ্যে থাকবে সম্প্রীতি সৌহার্দ্য ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারষ্পরিক সহযোগিতা। এর প্রকাশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় সামাজিক বিভিন্ন আয়োজন। কিন্তু সামাজিক এই সম্পর্ক ও আয়োজনকে ঘিরে আমাদের মধ্যে নানা রকমের সংকট তৈরি হয়ে যায়। কে কাকে দাওয়াত করল? কখন ও কিভাবে করল? কী উপহার আনল? কিভাবে আপ্যায়ন করল? কতরকম বিপত্তি ও সমস্যা তৈরি হয়ে যায়! ফলে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির আয়োজন থেকে তৈরি হয় মনোমালিন্য আর দূরত্ব। 

৪. ক্ষমা ও মার্জনায় উদারতা

মানুষ হিসেবে যে কেউ ভুল করতে পারে। ছোট বড় ভুল আমরা সবাই করি। বুদ্ধিমান মানুষ ভুল করার পর ভুল স্বীকার করেন এবং ক্ষমা প্রার্থণা করেন। কেউ যদি ভুল কাজ বা আচরণ করেন, তারপর অনুতপ্ত হয়ে, ভুল বুঝতে পেরে দু:খ প্রকাশ করতে আসেন, তাহলে উদারতার দাবী হচ্ছে তাকে স্বাদরে গ্রহণ করা। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার উপর চড়াও না হওয়া। তিনি ক্ষমা চাচ্ছেন, তার এই উপলব্ধি ও আচরণকে সম্মান জানানো।

৫. অধীনস্থদের প্রতি উদারতা

দুনিয়ার চিরায়ত নিয়ম হিসেবে আল্লাহ তায়ালা কিছু মানুষকে অপর কিছু মানুষের অধীনস্থ করেছেন। তারা তাদের অধীনে থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্র, যেমন—বাসা বাড়ি, দোকান, মিল ফ্যাক্টরি, অফিস-আদালত, বিদ্যালয় ইত্যাদিতে কাজ করে থাকেন। এসকল জায়গায় কিছু বিষয় থাকে যেগুলো মৌলিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরে কিছু বিষয় থাকে সম্পূরক, যেগুলো মৌলিক নয়। যদি বিশেষ ক্ষতি না হয় তাহলে এমন ছোট খাটো বিষয়ে কঠোরভাবে পাকড়াও না করা চাই। এমনিভাবে দায়িত্বপালনে যিনি সব সময় যত্নবান, তার থেকে কদাচিৎ যদি ভুল বা গাফলতি হয়ে যায়, তাহলেও সামগ্রিক অবস্থা মূল্যায়ন করে ছাড় দেয়া উচিত। এই উদারতাটুকু মানুষকে নিজ কাজে আন্তরিক করে তোলে, আবার পারষ্পরিক ভালো সম্পর্ক তৈরিতেও ভূমিকা রাখে। 

৬. বাচ্চাদের সাথে উদারতা

বাচ্চাদের সাথেও উদারতা ও সহজতা অবলম্বন করা জরুরি। তাদের অভিজ্ঞতা জ্ঞান ও বুঝশক্তি কম থাকার কারণে বারবার ভুল করে থাকে। নিষেধ করার পরও মানতে চায় না। এক্ষেত্রে প্রতিবারই যদি আমি তাকে ধরি এবং শাসন করতে থাকি তাহলে নানা রকম সমস্যা তৈরি হবে। যেমন, বাচ্চারা শাসন গ্রহণ করতে চাইবে না, বরং চ্যালেঞ্জ করা শুরু করতে পারে। আমি নিজেও ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে যেতে পারি। এজন্য বাচ্চাদের মনস্তত্ত্ব বুঝে তাদেরকে তাদের জায়গা থেকে আচরণ করা চাই। একই কারণে বারবার পাকড়াও না করে ক্ষেত্রবিশেষে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। 

৭. লেনদেনে উদারতা

কোন কিছু ক্রয় বা বিক্রি করা, দোকান-বাসা ভাড়া দেয়া কিংবা নেয়া, এমন নানা রকম লেনদেন আমাদের করতে হয়। এটিও উদারতা ও সহজতা অবলম্বনের বিশেষ ক্ষেত্র। যদি দেখা যায়, এই মূল্যে একটা জিনিস কিনলে বা বিক্রি করলে আমার চলে, তাহলে এক্ষেত্রে খুব বেশি দরকষাকষি না করা কর্তব্য। কিছু টাকা কম দিয়ে কিংবা ক্রেতা থেকে একটু বেশি পয়সা আদায় করে আমাকে ‘’জিততে’ হবে, এই মানসিকতা উদারতার সাথে সাংঘর্ষিক। এতে হয়তো এক পক্ষের বাহ্যিক কিছু লাভ হয় কিন্তু পারষ্পরিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মনে তৈরি হয় কষ্ট ও গ্লানি। ভাড়া দেয়া বা নেয়ার ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। এমনিভাবে যদি সুযোগ থাকে তাহলে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেয়া এবং বিক্রিত মাল ফেরত নেয়া— এসবও লেনদেনে উদারতার অন্তর্ভুক্ত। লেনদেনে উদারতা অবলম্বনকারির জন্য রহমতের দোয়া করা হয়েছে। 

সহি বুখারির বর্ণনা, নবীজির কাছে এক ব্যক্তি একটি উট পেতো। কিন্তু নবীজির কাছে সমপর্যায়ের উট ছিল না, ছিল আরো উন্নত উট। নবীজি বড় উটটিই পাওনাদারকে দিতে বললেন। পাওনাদার বলল, আমাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন, আল্লাহ আপনাকে পরিপূর্ণ করে দিন! তখম নবীজি বললেন, তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ হল যারা সবচেয়ে উত্তমরূপে পাওনা আদায় করে। (হাদীস ২৩০৫)

৮. অমুসলিমদের সাথে উদারতা

ইসলামের উদারতার এই শিক্ষা শুধু মুসলিমদের জন্য সীমিত নয়। এটি ব্যাপক একটি গুণ। বিদ্রোহি বিদ্বেষী নয় এমন অমুসলিমের প্রতিও ইসলাম উদারতার নির্দেশ দেয়। ইসলামের ইতিহাসে অমুসলিমদের প্রতি উদারতার অগণিত উদাহরণ রয়েছে। এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। প্রথম খলীফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর খেলাফতকালে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাঃ ইরাকের হিরাতবাসীদের সাথে (যারা খ্রিষ্টান ছিল) জিযিয়া-চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তির মধ্যে এটাও ছিল, যে বৃদ্ধ কাজ করতে অক্ষম হয়ে যাবে, অথবা কোন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে, কিংবা দরিদ্র হয়ে যাবে, তাহলে আমি তার জিযিয়া (কর) রহিত করে দিব। এবং তাকে ও তার পরিবারকে মুসলিমদের বাইতুল মাল থেকে ভরণপোষণ করা হবে। (কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফঃ ১৫৭) 

বস্তুত অমুসলিমদের সাথে উদারতার ধরণ এটাই। ফলে  হাল আমলে কাফেরদের সাথে উদারতা প্রদর্শনের জন্য তাদের সংস্কৃতি শিক্ষা মূল্যবোধ এমনকি তাদের বিশ্বাস ও আদর্শ গ্রহণ করার যে চর্চা গড়ে উঠছে, এর সাথে ইসলামী ‘’উদারতা’র সম্পর্ক নেই। এটি মূলত হীনমন্যতা ও মারত্মক পর্যায়ের ঈমানি দুর্বলতার পরিচায়ক।

শুরুতে যেমনটি আমরা দেখেছি, উদারতা ও সহজতা হচ্ছে ইসলামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক মুসলিমের জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই গুণটি বিস্তৃত হবে, এটা ঈমান ইসলামের একান্ত দাবী। উদারতার কয়েকটি দিক এখানে আলোচিত হয়েছে, নিজেরা চিন্তা করলে আরো বহুদিক বের করতে পারব। উদারতা ও সহজতা আমাদের জীবনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হোক, আল্লাহর দরবারে এটাই ফরিয়াদ করি! 

(সৌজন্যে, ত্রৈমাসিক ‘আলকাউসার- নারী’)

Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
ক্রোধ সংবরণ: কেন ও কিভাবে
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি