উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
উত্তম আখলাক সুন্দর স্বভাব চরিত্র ধারণ করা একজন মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। এছাড়া তার ঈমান ইসলাম অপূর্ণ থেকে যাবে। এ নিবন্ধে আমরা উত্তম আখলাকের মর্যাদা ও উপকারিতার কয়েকটি দিক আলোচনা করব। তবে তার পূর্বে এসম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করা জরুরী।
উত্তম আখলাক চর্চার উদ্দেশ্য কী হবে?
একজন মুসলিম যখন অন্য মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করবেন, নিজের মধ্যে সুন্দর স্বভাব লালন করবেন, তখন এর পেছনে তার কী উদ্দেশ্য থাকবে? তিনি কেন এটি করবেন?
বস্তুত এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা খুবই পরিষ্কার। ইসলামের দৃষ্টিতে উত্তম আখলাক হচ্ছে, একটি অন্যতম নেক কাজ। আর যেকোনো নেক কাজ করার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে— আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাঁর একান্ত অনুগত বান্দা হয়ে উঠা।
কোরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এভাবে শিখিয়েছেন,
قُلۡ إِنَّ صَلَاتِی وَنُسُكِی وَمَحۡیَایَ وَمَمَاتِی لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ
আপনি বলুন, আমার নামাজ, ইবাদত বন্দেগী, আমার বেঁচে থাকা এবং আমার মৃত্যু, এসবই জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত। (সূরা আনআ’ম:১৬২)
সহি মুসলিমের একটি হাদীসে বিনয়ের কথা এসেছে। সেখানেও নবিজী বিশেষভাবে এদিকটি উল্লেখ করে বলেছেন—
وما تواضع عبدٌ إلا رفعه اللهُ
যে বান্দা আল্লাহর জন্য (তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য) বিনয় অবলম্বন করবে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই উঁচু করবেন। (মুসলিম:২৫৮৮)
সুতরাং সুন্দর আখলাক চর্চার ক্ষেত্রে আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জনের এই উপলব্ধি সবসময় জাগ্রত থাকা উচিত। এবং এছাড়া অন্য কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য না থাকা কর্তব্য।
কিন্তু সমাজে কিছু মানুষ রয়েছেন যারা সুন্দর আচরণের চর্চা করেন এ উদ্দেশ্যে যে— মানুষ তাদেরকে ভালবাসবে, তাদের সুনাম হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এই মনোভাব গ্রহণযোগ্য তো নয়ই, বরং ক্ষতিকর। কেননা এটি স্পষ্ট রিয়া বা লোক দেখানো। যা যেকোন নেক আমলকে বরবাদ ও নিষ্ফল করে দেয়।
অপরদিকে কিছু মানুষ আছেন যারা উন্নত আখলাক ধারণ করেন জাগতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। যেমন পদ-নেতৃত্ব অর্জন বা ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে। কোন মুসলিমের জন্য এই মনোভাবও শোভনীয় নয়। এর একটি মন্দ দিক হল, যদি এই ব্যক্তিদের স্বার্থে কখনো আঘাত আসে, তাহলে তারা বিপরীত চরিত্র ধারণ করতে এতটুকু বিলম্ব করবে না।
হ্যাঁ এটা ভিন্ন বিষয় যে—কেউ যখন আল্লাহর জন্য সুন্দর স্বভাব-চরিত্র লালন করে আল্লাহ তাকে আখেরাতের পূর্বে দুনিয়াতেই সম্মানিত করেন। মানুষের হৃদয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন।
উত্তম আখলাকের ছয়টি মর্যাদা ও ফজিলত
উত্তম আখলাক যেহেতু ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, সেজন্য এর ফজিলত সওয়াব ও মর্যাদাও অপরিসীম। এ ব্যাপারে বিপুল আয়াত ও হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এখানে খুব সংক্ষেপে উত্তম আখলাকের মর্যাদার কয়েকটি দিক তুলে ধরছি।
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা অর্জন
উত্তম আখলাক এর অন্যতম একটি মর্যাদা হচ্ছে, এর মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। অর্জন করে আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূলের ভালোবাসা।
নবীজি বলেছেন,
أحب عباد الله إلى الله أحسنهم خلقًا
আল্লাহর নিকট তার বান্দাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সবচে প্রিয়—যার আখলাক স্বভাব চরিত্র সবচে সুন্দর। (মুস্তাদরাকে হাকেম: ৮২১৪)
অপর একটি হাদীসে নবীজি বলেছেন,
إنَّ من أحبكم إليَّ وأقربكم مني مجلسًا يوم القيامة أحاسنكم أخلاقًا
তোমাদের মধ্যে যারা আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কেয়ামতের দিন যারা আমার সবচেয়ে নিকটে আসন লাভ করবে, তাদের অন্যতম হচ্ছে— সে সকল ব্যক্তি যারা স্বভাব-চরিত্রের বিচারে তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (তিরমিযি:২০১৮)
বলার অপেক্ষা রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা অর্জন করা এবং কিয়ামতের দিন নবীজির সবচেয়ে কাছে থাকতে পারা একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। যার কোন তুলনা হয় না।
২. ঈমানের পূর্ণতার নিদর্শন
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, উত্তম আখলাক হল একজন মুমিনের ঈমানের পূর্ণতার একটি বিশেষ নিদর্শন। হাদিসের ভাষ্য হচ্ছে,
أكمل المؤمنين إيمانًا أحسنهم خلقا
মুমিনদের মধ্যে যার আখলাক সবচে সুন্দর, সেই সবচেয়ে’ পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী। (আবু দাউদ:৪৬৮২)
৩. মিজানের পাল্লায় সবচে ভারী জিনিস
আমরা এই পৃথিবীতে ভালো-মন্দ যা কিছু করছি, কেয়ামতের দিন এসব কিছু দাড়ি পাল্লায় ওজন করা হবে। সেই ওজনে যার নেকির পাল্লা ভারী হবে, সেই হবে সম্মানিত, জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতের উত্তম জীবন লাভ করবে। (সূরা আরাফ:০৮, সূরা আল কারিয়া: ৬-৭)
এখন জানার বিষয় হল, সেই দাড়িপাল্লায় সবচেয়ে ভারী জিনিস কী হবে? এ ব্যাপারে নবীজি বলেছেন,
ما من شيء في الميزان أثقل من حسن الخلق
কেয়ামতের দিন মিজানের পাল্লায় সবচেয়ে ওজনদার বস্তু হবে উত্তম আখলাক সুন্দর চরিত্র। (তিরমিজি:২০০২)
৪. ঘর বাড়ি আবাদ হয়, হায়াতে বৃদ্ধি ঘটে
আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ থেকে মুসনাদে আহমাদে উত্তম আখলাকের আরেকটি মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসে নবীজী বলেন,
حسن الخلق وحسن الجوار يعمران الديار ويزيدان في الأعمار
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক রাখা এবং উত্তম আখলাক ধারণ করা— এগুলো ঘরবাড়িকে আবাদ রাখে এবং মানুষের হায়াতে বৃদ্ধি ঘটায়। (মুসনাদে আহমদ:২৫২৫৯)
৫. নফল নামাজ ও রোজা রাখার মর্যাদা
এখানেই শেষ নয়, উত্তম আখলাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত হচ্ছে— এর মাধ্যমে একজন মুমিন নফল নামাজ ও রোজা রাখার মর্যাদা লাভ করতে পারে। সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত এক হাদীসে নবীজী বলেন,
إن الرجل ليدرك بحسن خلقه درجات قائم الليل صائم النهار
একজন মুমিন তার উত্তম আখলাক চরিত্র দ্বারা রাতে নামাজ আদায়কারী ও দিনে রোজা পালনকারী ব্যক্তির মর্যাদা অর্জন করে। (হাদীস:৪৭৯৮)
৬. জান্নাতের সুউচ্চ আসন লাভ
এ সকল কারণে যে কয়েকটি বিষয় মানুষকে সবচেয়ে বেশি হারে জান্নাতে নিয়ে যাবে, হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী উত্তম আখলাকও তার মধ্যে অন্যতম। মহান সাহাবী আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণিত হাদিসে এসেছে,
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن أكثر ما يدخل الناس الجنة فقال: تقوى الله وحسن الخلق،
খোদাভীতি আর উত্তম আখলাক মানুষকে সবচেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে। (তিরমিজি:২৬৪২)
শুধু জান্নাতেই প্রবেশ নয়, নবীজি বলেছেন যে ব্যক্তি তার আচরণকে সুন্দর করবে আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ ঘরবাড়ির দায়িত্বশীল হয়েছি। (আবু দাউদ: ৪৮০০)