- শুরুর কথা
আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মানবজাতির কাছে নবীজিকে প্রেরণ করার মৌলিক উদ্দেশ্য কী, কোন লক্ষ্য ও মিশন দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁকে পাঠিয়েছেন, এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে অনেক আয়াতে তিনি ব্যক্ত করেছেন। এর মধ্যে সূরা আল ইমরানের নিম্নোক্ত আয়াতটি অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন—
لَقَدْ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا۟ مِن قَبْلُ لَفِى ضَلَٰلٍ مُّبِينٍ
অর্থ : প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি (অতি বড়) অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, আর নিশ্চয় এর আগে তারা সুস্পষ্ট গুমরাহীর মধ্যে ছিল। [আয়াতক্রম :১৬৪]
এই আয়াতে নবীজির প্রধান তিনটি দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে—এক. মানুষকে কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত বা পাঠ করে শোনানো। দুই. কুরআন ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দেয়া, এর মর্ম ব্যাখ্যা করা। তিন. মানুষের অন্তরকে পবিত্র পরিশুদ্ধ করা।
অন্তর পবিত্র করার মর্ম হচ্ছে, কুফর ও শিরকি বিশ্বাস, অহংকার হিংসা ঘৃণা লোভ ক্রোধ দুনিয়ার প্রতি আসক্তি প্রভৃতি নিন্দিত বিষয় থেকে মানুষের অন্তর ও অভ্যন্তরকে মুক্ত করা। সাথে সাথে ঈমান বিশ্বাস, আল্লাহ তাআলার প্রতি প্রেম ভালবাসা, তাঁর উপর ভরসা, বিনয় নম্রতা, সবকিছু আল্লাহর জন্য করার (ইখলাস) মতো প্রশংসনীয় উত্তমগুণাবলি দ্বারা অন্তরকে সজ্জিত ও সমৃদ্ধ করা। যেহেতু এই তাযকিয়া বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার কাজটি নবীজির অন্যতম মিশন, প্রধানতম দায়িত্ব, ফলে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না এই আত্মশুদ্ধি ইসলামে কতখানি জরুরি ও আবশ্যকীয় বিষয়!
ইসলামের সাথে আত্মশুদ্ধির গভীর এই সম্পর্কটি আমরা প্রসিদ্ধ একটি হাদীসের সাহায্যেও বুঝতে পারি। মুহাদ্দিসদের নিকট অতিপ্রসিদ্ধ এ হাদীসের নাম হচ্ছে, হাদীসে জিবরীল। নবীজির ওফাতের কিছুকাল পূর্বে একজন প্রশ্নকারীরূপে জিবরীল আ. নবীজির মজলিসে উপস্থিত হয়েছিলেন। হযরত উমর রাযি. সহ শীর্ষস্থানীয় অনেক সাহাবীই সে মজলিসে ছিলেন। জিবরীল প্রশ্ন করেছিলেন মোট চারটি। এর মধ্যে তিনটি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে ইসলামের মৌলিক ও সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠেছে।
প্রথম প্রশ্নটি ছিল ঈমান সম্পর্কে : ঈমান কী? উত্তরে নবীজি ঈমানের ছয়টি রুকন : আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, নবী-রাসূল, পরকাল এবং তাকদীরের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাসের কথা তুলে ধরেন।
দ্বিতীয় প্রশ্নে জিবরীল জানতে চান, ইসলাম কী? জবাবে নবীজি ইসলামের প্রধান পাঁচটি আমল বা রোকন বর্ণনা করেন। এই দুই প্রশ্নের উত্তরে দ্বীনের মৌলিক দুটি দিক তথা আকীদা-বিশ্বাস এবং ইবাদত ও আমলের বিবরণ চলে এসেছে।
এরপর তিনি তৃতীয় প্রশ্নটি করেন : ইহসান কী? নবীজি উত্তর দিলেন, ইহসান হলো, তুমি এমনভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে যেন তুমি সরাসরি তাঁকে দেখছ, আর দেখার এই অবস্থা যদি নাও হয় তাহলে তিনি তো তোমাকে দেখছেন, (তাহলে সেভাবেই তাঁর ইবাদত করো)। [সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ৫০]
মনোযোগের সাথে হাদীসটি পাঠ করলে আমরা দেখব, এখানে আকীদা বিশ্বাস এবং ইবাদত ও আমল বর্ণনার পর আলাদা করে ‘ইহসানের’ কথা বলা হয়েছে। এ হাদীসে যে বিষয়টিকে ইহসান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে কুরআনে কারীমের বিপুল সংখ্যক আয়াতে একেই ‘তাযকিয়া’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। শব্দ দুইটি ভিন্ন হলেও মূল বিষয় এক ও অভিন্ন।
হাদীসের নির্দেশনাকে সামনে রাখলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো, ইসলাম একজন মুসলিমকে সুনির্দিষ্ট কিছু আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করতে বলে। একইভাবে কিছু আমল ইবাদত— যেমন নামায-রোযা-যাকাত ইত্যাদি পালনের নির্দেশ দেয়। এই দুটি জিনিসের সাথে সাথে নিজের অন্তর ও অভ্যন্তরে এমন কিছু বিষয় ও গুণাবলি অর্জন ও ধারণ করতে নির্দেশ দেয়, যা ঈমান আকীদা বিশ্বাস এবং আমল ইবাদতে পূর্ণতা এনে দেবে। ফলে পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয়কে যেমন ধারণ করতে হয়, ঠিক একইভাবে তৃতীয় বিষয়কেও ধারণ করতে হবে। এই তৃতীয় বিষয়টি ছাড়া ঈমান আকীদা বিশ্বাস ও আমল ইবাদতে অপূর্ণতা বা ঘাটতি থেকে যাবে।
তাযকিয়া ইহসান বা আত্মশুদ্ধি না থাকলে কীভাবে ঈমান-আমলে অপূর্ণতা বা ত্রুটি তৈরি হয়, বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করে বলি। কোনো ব্যক্তি ইসলামে যে সকল বিষয়ে ঈমান আনা আবশ্যক সে সবকিছু বিশ্বাস করে। এবং আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা অনুযায়ী সে নামায আদায় করে। কিন্তু তাঁর অন্তরে আল্লাহ তাআলার প্রতি যে গভীর ভালোবাসা মহব্বত থাকার কথা ছিল, আত্মশুদ্ধির অভাবে তা নেই। তাহলে কী হবে? সে আল্লাহর বিধান হিসেবে নামায পড়বে ঠিকই, কিন্তু অলসতার সাথে পড়বে। ধীরস্থিরতার পরিবর্তে সে তাড়াহুড়া করবে।
একইভাবে কোনো ব্যক্তির অন্তরে যদি কৃপণতা থাকে, তাহলে যাকাত সদকা আদায়ে সে অবহেলা করবে। হজ পালনেও গড়িমসি করতে পারে। আবার কারো অন্তরে বিনয় ও সহনশীলতার পরিবর্তে যদি অহংকার ও ক্রোধ থাকে তাহলে সে যে কোন ব্যক্তির উপর জুলুম করে বসবে! [হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. রচিত আত-তাকাশশুফ, পৃষ্ঠাক্রম : ৭]
ফল কথা, আত্মশুদ্ধি অর্জিত না হওয়ার কারণে একদিকে শরীয়তের অনেক বিধান লঙ্ঘিত হয় কিংবা সেগুলো পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা তৈরি হয়। অপরদিকে শরীয়ত নিষিদ্ধ বহু বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
আর এ কারণেই আমরা দেখি কুরআন হাদীসে একদিকে যেমন সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন আমল ও ইবাদতের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে একইভাবে অন্তরে বিশেষ অবস্থা ও গুণাবলি অর্জন করার জোরালো তাকিদ করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে এমন কিছু নির্দেশনা তুলে ধরছি—
১. আল্লাহ তাআলার প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা—
والذين آمنوا أشد حبا لله
অর্থ : আর যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ ভালবাসা রাখে। [সূরা বাকারা, আয়াতক্রম : ১৬৫]
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত এই দুআ করতেন—
اللَّهمَّ اجعلْ حبَّكَ أحبَّ الأشياءِ إليَّ
অর্থ : হে আল্লাহ, আপনার ভালোবাসাকে আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে প্রিয় করুন! [রিয়াযুল কুদস, আয়াতক্রম : ৩/৩১০]
২. সবর বা ধৈর্যধারণ করা—
يا أيها الذين آمنوا اصبروا
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো। [সূরা আলে ইমরান, আয়াতক্রম : ২০০]
৩. শুকর বা আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা—
واشكروا لي ولا تكفرون
অর্থ : এবং তোমরা আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো। অকৃতজ্ঞ হয়ো না। [সূরা বাকারা, আয়াতক্রম : ১৫২]
৪. ইখলাস বা সবকিছু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য করা—
وَمَآ أُمِرُوٓا۟ إِلَّا لِيَعْبُدُوا۟ ٱللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ
অর্থ : তাদেরকে কেবল এই আদেশই করা হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই জন্য খালেস রেখে। [সূরা বায়্যিনাহ, আয়াতক্রম : ৫]
৫. আল্লাহ তাআলার ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা—
وارض بما قسم الله لك تكن أغنى الناس
অর্থ : আল্লাহ তোমার জন্য যা বণ্টন করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকো, তাহলে তুমি সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হয়ে যাবে। [তিরমিযী শরীফ : ২/৫৬]
৬. হিংসা থেকে বেঁচে থাকা—
إيّاكُم والحَسَدَ، فإنّ الحَسَدَ يأكلُ الحَسَناتِ، كما تأكلُ النارُ الحَطَبَ
অর্থ : তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা হিংসা পুণ্য ও নেক আমলসমূহ খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন কাঠকে ভস্মিভূত করে। [আবু দাউদ, হাদীসক্রম : ৪৯০৩]
উল্লিখিত নির্দেশনার সবগুলোই মানুষের বাতেন বা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত। এবং স্পষ্ট কথা এগুলো আকীদা বিশ্বাস ও বাহ্যিক আমল ইবাদত থেকে ভিন্ন তৃতীয় একটি বিষয়। এই আত্মশুদ্ধি অর্জন করা যে আবশ্যক কুরআন-হাদীসের এ সকল নিদর্শনা থেকে খুবই পরিষ্কার।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, কীভাবে এই আত্মশুদ্ধি (তাযকিয়া ও ইহসান) অর্জন করব? কোন মাধ্যম উপকরণ অবলম্বন করলে অন্তর পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হবে?
শরীয়ত এ বিষয়ে মৌলিক কিছু নীতিমালা ও নির্দেশনা দিয়েছে এবং এ জায়গায় বেশ প্রশস্ততা রেখেছে। ফলে এ বিধানটি বাস্তবায়নের জন্য শরীয়তের কোন বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, এমন যেকোনো উপায় ও মাধ্যম অবলম্বন করা যাবে। এবং এই প্রশস্ততা ও ছাড় দেয়াটা যুক্তির দাবিও বটে। যাতে যুগের সাথে সাথে মানুষের যোগ্যতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে সে অনুযায়ী উপযুক্ত মাধ্যম ও পদ্ধতি প্রবর্তন করা সম্ভব হয়। [মাওলানা মনযূর নুমানী সংকলিত ‘তাসাউফ কিয়া হ্যায়’, পৃষ্ঠাক্রম : ৫০; মাওলানা আব্দুল মালেক রচিত ‘তাসাউফ : তত্ত্ব ও পর্যালোচনা’, পৃষ্ঠাক্রম : ৬৮-৬৯]
তাসাউফ কী?
আমরা জেনেছি, আত্মশুদ্ধি অর্জন করা ইসলামের আবশ্যক বিধান। আর এই আত্মশুদ্ধি অর্জন করার জন্য কোনো ব্যক্তি আল্লাহওয়ালা অভিজ্ঞ বিচক্ষণ কোনো বুযুর্গের কাছে যাবেন। তিনি তাঁকে অন্তর পবিত্র করার পদ্ধতি বিশদভাবে শেখাবেন। সেসব গুণাবলি কীভাবে অর্জন করতে হয়? নিন্দনীয় গুণাবলির ব্যাখ্যা কী? কীভাবে এগুলো থেকে নিজের অন্তরকে পবিত্র করা যায়? এই পথে অন্তরায়গুলো কী কী? কীভাবে অন্তরায়গুলো অতিক্রম করা যায়? আল্লাহওয়ালা অভিজ্ঞ এই বুযুর্গ কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা, পূর্ববর্তী মনীষী ও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এইসব গুণাবলি অর্জনের জন্য কিছু কাজ ও আমল বিশেষ পদ্ধতিতে করতে বলবেন। আল্লাহ তাআলার বেশি বেশি যিকির, মুরাকাবা, খালওয়াত বা একাকী নির্জন অবস্থান প্রভৃতি। বিশেষ এই কাজগুলো মূলত আত্মশুদ্ধি অর্জনের ‘মাধ্যম ও উপকরণ’ হিসেবেই গণ্য হবে। আর আত্মশুদ্ধি অর্জনের এই মাধ্যম ও উপকরণগুলোর পারিভাষিক নামই হচ্ছে, তাসাউফ। যে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধির জন্য অভিজ্ঞ বুযুর্গ ব্যক্তির কাছে যাবে তাকে বলা হয় মুরীদ। আর আল্লাহওয়ালা অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বলা হয় পীর বা শায়েখ।
এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে তাসাউফে আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য যে সকল মাধ্যম ও উপকরণ গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়, এগুলো প্রধানত দুই ধরনের—
১. কিছু মাধ্যম এমন রয়েছে যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন : অধিকতর মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। মুহাসাবা বা নিজের কাজ কর্মের হিসাব গ্রহণ করা।
২. আবার কিছু মাধ্যম রয়েছে যেগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়নি। আবার শরীয়তের কোনো বিধানের পরিপন্থীও নয়। বরং হকপন্থী মাশায়েখ-বুযুর্গগণ স্থান-কাল পরিবেশ ও মুরীদের অবস্থার বিচারে সেগুলোর নির্দেশ দিয়ে থাকেন, শরীয়তের কোনো বিধান হিসেবে নয়, বরং শরীয়তের বিধান পালনের মাধ্যম হিসেবে, চিকিৎসা স্বরূপ। যেমন : যিকির করার সময় বিশেষ পদ্ধতিতে মাথা ঝাঁকানো, বিশেষ পদ্ধতিতে বসা, নির্দিষ্ট সংখ্যায় যিকির করা। এগুলোকে শরীয়তের বিধান বা সুন্নত মনে করা হয় না। কেউ যদি শরীয়তের বিধান বা সুন্নত মনে করে তাহলে সে ভুল করবে। তাসাউফের বরেণ্য ব্যক্তিরা স্পষ্ট ভাষায় এ কথা ব্যক্ত করেছেন। [শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, মাওলানা ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী, হাকীমুল উম্মত থানভী প্রমুখের বক্তব্য পাঠ করুন—‘তাসাউফ কিয়া হ্যায়’, পৃষ্ঠাক্রম : ৭৪-৭৫; ‘তাসাউফ : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ’, পৃষ্ঠাক্রম : ৬৮-৬৯]
তাসাউফের বিশেষ কাজ ও পদ্ধতিগুলো শরীয়তের বিধান পালনের মাধ্যম ও উপকরণ মাত্র, শরীয়তের স্বতন্ত্র কোনো বিধান নয়—এর বিশেষ একটি দিক হচ্ছে, এ কাজ ও পদ্ধতিগুলোতে অভিজ্ঞ শায়েখ ও বুযুর্গগণ স্থান-কাল-ব্যক্তি ভেদে কমবেশি ও পরিবর্তন করে থাকেন। তারা সবার জন্য সব সময় এক পদ্ধতি দেন না। [সিরাতে মুস্তাকিম, ইসমাঈল শহীদ সংকলিত, পৃষ্ঠাক্রম : ৭; তাসাউফ কিয়া হ্যায়, পৃষ্ঠাক্রম : ৭৪ এর বরাতে]
অথচ শরীয়তের বিধান হলে এতে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ থাকত না।
তাসাউফের বিশেষ পদ্ধতিগুলো শরীয়তের বিধান না হওয়ার আরেকটি দলীল হচ্ছে, যখন কারো আত্মশুদ্ধি হাসিলে হয়ে যায়, তখন তাকে এই পদ্ধতি মেনে চলতে হয় না। মাওলানা ইসমাঈল শহীদ ও মাওলানা গাংগুহী রহ. বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। [দেখুন—তাসাউফ কিয়া হ্যায়, পৃষ্ঠাক্রম : ৭৩, ৭৫, ৭৬]
এর আরেকটি দলীল হলো, তাসাউফের পদ্ধতি ছাড়া যদি অন্য কোনো বৈধ উপায়ে কেউ আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারে, তাহলে এই সুযোগ অবশ্যই তার রয়েছে। আল-কাওলুল জামিলে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যেন কিছুতেই এ ধারণা পোষণ না করে—আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক কেবল এই শুগল বা বিশেষ পদ্ধতিতেই অর্জিত হয়! [তাসাউফ কিয়া হ্যায়, পৃষ্ঠাক্রম : ৭৪; তাসাউফ : তত্ত্ব ও পর্যালোচনা, পৃষ্ঠাক্রম : ৭৪]
তাসাউফের এই পদ্ধতি উম্মতে মুসলিমার বিশেষজ্ঞ আলেম, বরেণ্য ফকীহ, স্বীকৃত মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণ প্রণয়ন করেছেন। নিজেরা অবলম্বন করেছেন। এর সমর্থন ও প্রচার করেছেন।
ইবরাহীম আদহাম, ফুযাইল ইবনে ইয়ায, হারিস মুহাসিবী, জুনাইদ বাগদাদী, আবুল কাসিম কুশাইরি, আবু হামেদ আল গাযালী, আবদুল কাদের জিলানী, ইয ইবনে আবদুস সালাম, ইবনে আতাউল্লাহ ইস্কান্দারী, তাজুদ্দীন সুবকি, যাকারিয়া আল-আনসারী, ইবনে হাজার মাক্কী, সুয়ুতী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী, ইসমাঈল শহীদ, কাসেম নানুতবী, রশীদ আহমদ গাংগুহী, আবদুল হাই লাখনবী, শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, আশরাফ আলী থানভী, আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী, হুসাইন আহমদ মাদানী-সহ আরো হাজারো লাখো মুসলিম মনীষী, কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যে ছিলেন কালের শীর্ষ ও সর্বজন স্বীকৃত আলেম, তাঁরা সকলেই তাসাউফের এ পথ অবলম্বন করেছেন। এ পথে তাঁরা নিজেদের আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করেছেন, এবং পরম বিশ্বস্ততা ও দায়িত্বের সাথে পরবর্তীদের এ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। এটা ইসলামের মহান মনীষীদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ও তাঁদের সত্য সাক্ষ্য। এ জন্য এখনো আহলে হক আলেমগণ তাঁদের পূর্ববর্তী আদর্শ আলেমদের অনুসরণে, নিজেদের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সবাইকে এ পথে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার কথা বলেন।
মাধ্যম ও উপায় অবলম্বনে কি ইসলাম ছাড় দিয়েছে?
এই যে আত্মশুদ্ধির জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ও উপকরণ অবলম্বন করা, যাকে তাসাউফ বলা হয়েছে, ইসলামে কি এর অন্য কোনো দৃষ্টান্ত রয়েছে? এটি অত্যন্ত জরুরি একটি প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে অনেক বিষয়ই সমাধান হয়ে যাবে।
মূলত ইসলাম এমন অনেক বিধান দিয়েছে যেগুলো পালনের জন্য কোনো মাধ্যমকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়নি। বরং এ সকল ক্ষেত্রে স্থান কাল ও পরিবেশের অবস্থা মাফিক প্রয়োজনীয় উপায় ও উপযুক্ত মাধ্যম গ্রহণ করতে হয়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত খেয়াল করুন—
১. ইসলাম কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার নির্দেশ করেছে। কিন্তু কী দিয়ে জিহাদ করা হবে,এটা নির্দিষ্ট করে দেয়নি। ফলে যুগের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী এতে পরিবর্তন এসেছে। একসময় যুদ্ধ হয়েছে তরবারি-বর্শা দিয়ে, কিন্তু এখন সে যুগ নেই।
২. একইভাবে আবশ্যিক পরিমাণ দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য ফরয। এই দ্বীনী জ্ঞান কীভাবে অর্জন করা হবে, এর একক কোনো মাধ্যম ইসলাম নির্ধারণ করে দেয়নি। ফলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদরাসায় ভর্তি হয়ে, কোনো আলেমের কাছে দ্বীনী বিষয় শ্রবণ করে, দ্বীনী বইপত্র অধ্যয়ন করে কিংবা কোনো আলেমকে দেখে দেখে এই জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ রয়েছে।
৩. অনুরূপভাবে নবীজির হাদীস সংরক্ষণ করা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম কর্তব্য। কিন্তু কীভাবে এই সংরক্ষণের কাজটি করা হবে? এর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বা মাধ্যম নবীজি সা. নির্ধারণ করে দেননি। ফলে প্রয়োজনের তাগিদে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ সনদ-সূত্র-সূত্র জরাহ তাদিলসহ বিভিন্ন শাস্ত্র আবিষ্কার করেছেন। এগুলোর সাহায্যে হাদীসের মান যাচাই করেছেন। এসবের কল্যাণে আমরা সহীহ বুখারির সহিহ মুসলিম সহ হাদীসের অন্যান্য সংকলন পেয়েছি। এভাবে নবীজির হাদিস কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য সংরক্ষিত হয়ে থাকবে। অথচ এই ব্যবস্থাগুলোর কথা কুরআন হাদীসে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
আত্মশুদ্ধি ও তাসাউফ: মুসলিম সমাজের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান
১. আত্মশুদ্ধি সম্পর্কে উদাসীনতা :
মুসলিম সমাজের মধ্যে যাঁরা ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিবিধান পালন করেন তাঁদের একটি অংশ ঈমান-আকীদা ও ইবাদত-আমলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। তাঁদের মধ্যে অন্তর জগতের প্রতি মনোযোগ দেয়া ও যত্ন নেয়ার কোনো প্রেরণা-পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁদের এই অবস্থান খুবই অসঙ্গত। কেননা, শুরুর আলোচনায় আমরা দেখেছি, ইসলাম আকীদা ও আমলের সাথে সাথে তাযকিয়া-ইহসান তথা আত্মশুদ্ধি অর্জনের জোরালো নির্দেশ দিয়েছে। এও দেখেছি, তাযকিয়া ও ইহসান অর্জন করা ছাড়া ঈমান আমল ও ইবাদতে পূর্ণতা আসে না। বরং এর অনুপস্থিতিতে তৈরি হয় বিশাল ঘাটতি।
২. তাসাউফ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও অপপ্রচার :
মুসলিম সমাজে আরেকটি শ্রেণি রয়েছে যাঁরা ধর্মীয় বিধি-বিধান চর্চা করেন এবং আত্মশুদ্ধির গুরুত্বও উপলব্ধি করেন। কিন্তু আত্মশুদ্ধি অর্জনের স্বীকৃত একটি মাধ্যম তাসাউফ সম্পর্কে অনেক অমূলক ধারণা ও ভ্রান্তি লালন করে থাকেন। এখান থেকে তাঁরা তাসাউফের ঘোর বিরোধিতায় লিপ্ত হন। তাঁদের তাসাউফ বিরোধিতার মাত্রা এতটাই তীব্র যে, শেষ পর্যন্ত তাসাউফের পথ ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমকে অবলম্বন করেও তাঁরা আত্মশুদ্ধি অর্জনের পথে অগ্রসর হন না। ফলে এই শ্রেণিটি কার্যতঃ প্রথম শ্রেণির মতো শুধু আকীদা ইবাদতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। অন্তরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা, উত্তম গুণাবলি ধারণ করা এবং নিন্দনীয় গুণাবলি থেকে বেঁচে থাকার কোনো প্রচেষ্টা উদ্যোগ তাঁদের কাজকর্মে অনুপস্থিত থেকে যায়। সামনের আলোচনায় আমরা তাসাউফ সম্পর্কে এ শ্রেণিটির কিছু ভ্রান্তি-ভুল ধারণা এবং তার পর্যালোচনা তুলে ধরছি।
- ভ্রান্তি—১ : তাসাউফের কথা কুরআন-হাদীস কোথাও নেই। ফলে এটি ইসলামে নবআবিষ্কৃত একটি বিদআত। সকল বিদআতই পরিত্যাজ্য। ফলে তাসাউফ চর্চা করা কাঙ্ক্ষিত বা বৈধ তো নয়ই বরং সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয় বিষয়।
- পর্যালোচনা
এ ক্ষেত্রে মূল কথাটি হলো, আত্মশুদ্ধি অর্জন করা কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক মুমিনের জন্য অতীব জরুরি একটি বিধান। যেকোনো মূল্যে এটি অর্জন করতেই হবে। আর তাসাউফ ও তাসাউফের বিভিন্ন কাজ-পদ্ধতি মূলত আত্মশুদ্ধি অর্জনের একটি উপায় ও মাধ্যম।
এটা স্বীকৃত বিষয় যে, উপায় ও মাধ্যমের ক্ষেত্রে শরীয়ত সীমাবদ্ধতার পথ অবলম্বন করেনি। ফলে একে মূল বিধান মনে না করে কেউ যদি ‘মাধ্যম ও উপায়’ হিসেবে তাসাউফ অবলম্বন করে তাহলে এটি কোনো অবস্থাতেই বিদআত হতে পারে না।
ইমাম শাতেবী তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ আল-ইতিসামে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের বরেণ্য ইমাম ও আলেমগণ যে তাসাউফের চর্চা করেন, এটি যে বিদআত নয়, তিনি পরিষ্কার শব্দে ব্যক্ত করেছেন। ইমাম শাতেবি লেখেন—
فالتصوف بالمعنى الأول لا بدعة في الكلام فيه.. وأصوله في الكتاب والسنة ظاهرة، فلا يقال في مثله بدعة
অর্থ : প্রথম অর্থে তাসাউফের আলোচনায় কোনো বিদআত নেই।… কুরআন ও হাদীসে এর মূলনীতি বিদ্যমান রয়েছে। ফলে এ জাতীয় বিষয়কে বিদয়াত আখ্যায়িত করা যাবে না।
তিনি আরো বলেন—
وليس من شأن العلماء إطلاق لفظ البدعة على الفروع المستنبطة التي لم تكن فيما سلف، وإن دقت مسائلها، فكذلك لا يطلق على دقائق فروع الأخلاق الظاهرة والباطنة أنها بدعة، لأن الجميع يرجع إصول الشريعة
অর্থ : ফিকহের উদঘাটিত সেসকল সূক্ষ্ম মাসায়েল, যা আতীতকালে (সাহাবী-তাবিয়ীদের সময়) ছিল না, আলেমগণ এগুলোকে বিদআত হিসেবে আখ্যায়িত করেন না। একইভাবে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ আখলাক স্বভাবের সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখাকেও (তাসাউফ) বিদআত বলা হবে না। কেননা সবগুলোর পেছনে শরীয়তের মূলভিত্তি রয়েছে। [আল-ইতিসাম : ১/৩৪৯]
তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাসাউফকে আত্মশুদ্ধির একটি মাধ্যম ও উপায় হিসেবে গ্রহণ করলেও যদি বিদআত হয়ে যায়, তাহলে শরীয়তের অন্যান্য মাধ্যম ও উপায়গুলোর ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। দ্বীন শেখা ও শেখানোর জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামী বিভিন্ন বিষয়ে স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা, হাদীসের কিতাব সংকলন, হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য মূলনীতি উদ্ভাবন প্রভৃতি কোনো কিছুর কথাই তো কুরআন হাদীসে স্পষ্ট শব্দে উল্লেখ করে গ্রহণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়নি! তাহলে কি এগুলোকে অস্বীকার করা হবে? বিদআত আখ্যায়িত করে বর্জন করা জরুরি হয়ে যাবে? মূলত কুরআন-হাদীসে বিদআতের যে সংজ্ঞা ও স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, এ সম্পর্কে অবগত ব্যক্তি মাত্রই এগুলোকে বিদআত ও পরিত্যাজ্য আখ্যায়িত করবেন না।
- ভ্রান্তি—২ : তাসাউফের কাজ কর্ম ও পদ্ধতিটি যদি জরুরি হতো তাহলে নবীজি ও সাহাবীর যুগে কেন এসবের অস্ত্বিত্ব ছিল না?
- পর্যালোচনা
প্রথম কথা হচ্ছে, হকপন্থী আলেমদের মধ্যে কেউই তাসাউফকে জরুরি ও আবশ্যক বলেন না। যে বিষয়টি আবশ্যক ও জরুরি তা হল, আত্মশুদ্ধি বা তাযকিয়া ও ইহসান। ফলে তাসাউফের পথ ও পদ্ধতি ছাড়া বৈধ স্বীকৃত অন্য যেকোনো পদ্ধতিতে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার পূর্ণ সুযোগ রয়েছে। এ শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ স্পষ্ট শব্দে এ কথা ব্যক্ত করেছেন।
দ্বিতীয় কথাটি হলো, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর মহান সাহাবীদের সময়কাল ছিল শ্রেষ্ঠ সময়। নবীজির বরকতময় উপস্থিতি, তাঁর রূহানী শক্তি, সাহাবীদের আত্মিক যোগ্যতা—এসব কারণে আত্মশুদ্ধির জন্য আলাদা কাজকর্ম বা উপায় অবলম্বন করার প্রয়োজন ছিল না। বরং নবীজির শুধু সাহচর্যই এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যথেষ্ট ছিল।
কিন্তু সময়ের অতিক্রমের সাথে সাথে মানুষ নবীজির যুগ থেকে যতই দূরে যেতে থাকে, তাদের ঈমান-আমলে দুর্বলতা তৈরি হয়। এখন শুধু উত্তম ব্যক্তির সাহচর্য অন্তর পরিশুদ্ধ করতে সক্ষম হয় না। ফলে অভিজ্ঞ আলেমগণ কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা ও নিজেদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন উপায় ও মাধ্যম প্রণয়ন করেন, যা মানুষকে আত্মশুদ্ধি অর্জনের পথে সহায়তা করতে পারে। তারা আল্লাহ তাআলার অধিকহারে যিকির, ফিকির, মুরাকাবা, নির্দিষ্ট দিনের জন্য নির্জনবাস প্রভৃতি প্রণয়ন করেন।
এই যে প্রয়োজন ও চাহিদা না থাকার কারণে সাহাবীদের সময়ে কোনো বিষয় না থাকা, এর বহু দৃষ্টান্ত ইসলামে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ইসলামী জ্ঞানঅর্জনের জন্য আরবী ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র বা ভাষাজ্ঞান, এর কোনো শাস্ত্রই আলাদা করে অধ্যয়ন করার প্রয়োজন হতো না। জন্মগতভাবেই তাঁরা এগুলো অর্জন করতেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় মানুষের ভাষাজ্ঞান যখন দুর্বল হতে থাকল, তখন কুরআন-হাদীস অধ্যয়নের জন্য এইসব শাস্ত্র প্রণয়ন করা অতীব জরুরি হয়ে উঠল। ফলে মুসলিম উম্মাহর একটি বিশেষজ্ঞ দল এ সম্পর্কিত মূলনীতি প্রণয়ন করলেন। এখন কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য এ সকল শাস্ত্র পড়তেই হয়। যাঁরা ইসলামের গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন, এখন করছেন এবং ভবিষ্যতে করবেন, সবাইকে এই ‘মাধ্যম ও উপায়গুলো’ অবলম্বন করতেই হবে।
যদিও এই মাধ্যমগুলো শাস্ত্র আকারে নবীজি ও সাহাবীদের যুগে ছিল না। বরং পরবর্তীতে প্রয়োজন ও চাহিদার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। তাছাউফের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাহাবীদের যুগে তাসাউফের মূল উদ্দেশ্য শুধু নবীজির সুহবতের বরকতেই হাসিল হয়ে যেত। কিন্তু পরবর্তীতে শুধু বুযুর্গ ব্যক্তির সাহচর্যের দ্বারা আত্মশুদ্ধি অর্জিত না হওয়ায়, অতিরিক্ত কিছু কাজ উপায় ও মাধ্যম অবলম্বন করতে হয়েছে।
- ভ্রান্তি—০৩
তাসাউফবিরোধীদের একটি অংশের বক্তব্য হলো, তাসাউফের হাত ধরে মুসলিম সমাজে নানা রকম ভুল বিশ্বাস ও ভ্রান্ত আমল-কর্মকাণ্ড প্রবেশ করেছে। এ জন্য তাসাউফ বর্জন করা জরুরি।
- পর্যালোচনা
এটি বাস্তব সত্য, যে তাসাউফ ছিল আত্মশুদ্ধি অর্জনের উপায় ও মাধ্যম, যার চর্চা করে মানুষ ঈমান ও আমলে পূর্ণতা অর্জন করত, একশ্রেণের মানুষ সে তাসাউফকে ভুল ও অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে। তাসাউফের নামে মাজারে মাজারে ওরস, মানত, কবরে সেজদা, গান বাদ্য এবং কুরআন হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনাবিরোধী বিশ্বাস ও কাজের তালীম দেয়া হয়েছে। ফলে এই শ্রেণিটি তাসাউফকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে যে সকল শিরকি ও বিদআতি বিশ্বাস ও কাজকর্ম ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার সাথে হকপন্থী আল্লাহওয়ালা আলেম ও বুযুর্গদের চর্চিত তাসাউফের দূরতম সম্পর্ক নেই। আর এখান থেকেই তাসাউফের দুটি ধারা তৈরি হয়েছে—১. কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনার আলোকে শিরক ও বিদআত মুক্ত তাসাউফ। ২. শিরক ও বিদআত মিশ্রিত তাসাউফ।
এই দ্বিতীয় প্রকার তাসাউসপন্থীরা তাসাউফের নাম ও এর কিছু পদ্ধতির আড়ালে যে শরীয়তবিরোধী কার্যক্রম করে থাকে, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর বিপদজনক ও স্পর্শকাতর। এ বিবেচনায় প্রথম প্রকারের তাসাউফ চর্চাকারী হক্কানী বুযুর্গগণ সর্বদা এই বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করেছেন। মানুষ যেন শুধু নাম ও বাহ্যিক কিছু কাজ দেখে ভুল তাসাউফের চর্চায় লিপ্ত না হয়, এ জন্য সূফী=সাধকগণ প্রচুর বই-পুস্তক রচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মাকতুবাত, শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. সংকলিত সিরাতে মুস্তাকিম, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.-এর মাকতুবাতে রশিদিয়া, হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. লিখিত তাকাশশুফ, তাশাররুফ, কাসদুস সাবিল, মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব রচিত তাসাউফ তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ-জাতীয় পুস্তকে কুরআন-সুন্নাহসম্মত তাসাউফ বর্ণনার সাথে সাথে তাসাউফের নামে চর্চিত ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বস্তুতঃ তাসাউফকে বিকৃতি ও ভ্রান্ত ব্যক্তিদের হাত থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা সবসময় ছিল, এখনো চলমান রয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ কর্তৃক তাসাউফের ভুল ব্যবহার ও বিকৃতির কারণে মূল তাসাউফকেই বর্জন করতে হবে, এটি একেবারেই অযৌক্তিক দাবি। কেন অযোক্তিক? এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, এমন ভুল ও বিকৃতির হাত থেকে ইসলামের বেশির ভাগ শাস্ত্র ও শাখাই নিরাপদ ছিল না। হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাসের দিকে তাকান। এক্ষেত্রে এমন কিছু মানুষ পাওয়া যাবে, যারা জাল হাদীস তৈরি করত এবং মানুষের কাছে বর্ণনা করত। হাদীস নিয়ে তাদের এমন অন্যায়ের কারণে মুহাদ্দিসগণ সমস্ত হাদীসকে বর্জন করেননি। বরং ভুল ও জাল হাদীসকে বাদ দিয়েছেন। এসব নির্ণয় ও যাচাই করার জন্য নতুন নতুন শাস্ত্র আবিষ্কার করেছেন।
তাফসীর শাস্ত্রে দেখুন, এখানেও একই কথা প্রযোজ্য। তাফসীরের অনেক কিতাবে অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা ও বক্তব্য এসে গেছে। তবে বিজ্ঞ মুফাসসিরগণ ভুল-শুদ্ধ নির্ণয় করে সঠিক ও যথাযথ বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ইসলামী ফিকহশাস্ত্র, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ও এ বাস্তবতার ব্যতিক্রম ছিল না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বাস্তবতা শুধ ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবন চলার পথে সর্বত্র এই ভালো-মন্দ সঠিক ও ভুলের মিশ্র উপস্থিতি দেখতে পাই। রোগীর চিকিৎসা করেন যে ডাক্তার শ্রেণি তাদের মধ্যে কি দক্ষ ও অদক্ষ, স্বীকৃত ও ভুয়া দুই রকম ডাক্তার নেই? ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে উকিল-শিক্ষক সবশ্রেণির মধ্যেই এই মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়।
মূল কথা হলো, ভালো মন্দের এই মিশ্রণের কারণে আমরা মন্দের সাথে সাথে ভালো ও যোগ্যদের বর্জন করি না। বরং সর্বোচ্চ যাচাই বাছাই ও পর্যবেক্ষণ করে ভালো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষককে গ্রহণ করি।
এই যাচাই বাছাই ও পর্যবেক্ষণের কাজটি আমরা আত্মশুদ্ধির মাধ্যম তাসাউফের ক্ষেত্রে কেন করব না? এক শ্রেণির মানুষ ভুল ও অন্যায়ভাবে একে ব্যবহার করছে, এ কারণে কি আমরা মূল তাসাউফকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে পারি? সন্দেহ নেই, এটি অন্যায় কাজ এবং প্রকৃতপক্ষে এর অধিকারও আমাদের নেই।
- ভ্রান্তি—০৪ :
তাসাউফ সম্পর্কে প্রচলিত আরেকটি ভ্রান্তি হলো, অনেকে মনে করেন—তাসাউফের কারণে মানুষ কর্মবিমুখ হয়ে যায়। জীবন জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ধরনের ‘সন্ন্যাস’ গ্রহণ করে। একইভাবে যারা তাসাউফ চর্চা করেন তারা দ্বীনী শিক্ষার প্রচার-প্রসার, দ্বীনী আন্দোলন-সংগ্রাম-জিহাদ-জিহাদ থেকে সব সময় নিজেদের দূরে রাখেন। তাঁরা খানকাহতে এক ধরনের আবদ্ধ জীবন যাপন করেন। এ ধারণা পোষণকারীগণ তাসাউফকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে বাধা ও অন্তরায় মনে করেন। মানুষ যেন কোনোভাবেই তাসাউফের কাছেও না যায় এ বিষয়ে দীর্ঘ সতর্কবাণী তাঁরা প্রচার করে থাকেন।
- পর্যালোচনা
এ আপত্তিটি যদিও প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখক ও চিন্তক উত্থাপন করেছেন, কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য ও বাস্তবতার মানদণ্ডের বিচারে এটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য দাবি। মূলত এ ভ্রান্তির পেছনে দায়ী হলো, তাসাউফের সঠিক চর্চাকারী হক্কানী বুযুর্গদের সংস্পর্শে না যাওয়া, তাসাউফের মূল উৎসগ্রন্থ থেকে এর পরিচয় ও স্বরূপ না জানা, বরং তাসাউফের দাবিদার কিছু ভ্রান্ত লোকদের কর্মকাণ্ড দেখেই ধারণা ও অনুমান থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
বিগত কয়েক শতকের ইসলামী ইতিহাসের দিকে তাকালে আমাদের সামনে যে সত্যটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তা হলো, এই দীর্ঘ সময়ে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার প্রচার-প্রসার, দ্বীনী ইসলাহী আন্দোলন-সংগ্রাম ও জিহাদ যা কিছু হয়েছে, এর প্রধান ও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন সেসকল ব্যক্তিবর্গ যাঁরা শুধু নিজেরা তাসাউফ চর্চা করতেন তা-ই নয় বরং তাসাউফের জোরদার সমর্থক ও প্রচারকও ছিলেন।
মুঘল বাদশাহ আকবরের দ্বীন-ইলাহী উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বকে যখন সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিল, তখন এই ভয়াল ফেতনার মুকাবিলার জন্য যে মহান মনীষী নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁকে পুরো পৃথিবী স্মরণ করে মুজাদ্দিদে আলফে সানী বা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক হিসেবে। তিনি ইমাম আহমদ সেরহিন্দী। তাসাউফের অন্যতম প্রসিদ্ধ ধারা নক্সেবন্দী তরীকার শীর্ষস্থানীয় বুযুর্গ ছিলেন এই মহান সংস্কারক।
পরবর্তীতে মুঘল শাসনামলের শেষ দিকে যখন মুসলিম সমাজের সর্বত্র অধঃপতন শুরু হয়েছিল, ধর্মীয় শিক্ষা রাজনীতি অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রেই মুসলিমরা যখন পিছিয়ে পড়ছিল, তখন মুসলিমদের জাগরণ ও বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছিলেন, এবং সামগ্রিক রূপরেখা পেশ করেছিলেন যে মহান পুরুষ তিনি শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী। উঁচু পর্যায়ের মুহাদ্দিস হওয়ার সাথে সাথে তিনি উঁচুস্তরের সূফী-সাধকও ছিলেন। তাসাউফ বিষয়ক একাধিক গ্রন্থও রচনা করেছেন। তাঁর লেখা ‘আল-কাওলুল জামিল’ তাসাউফের মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।
যে সৈয়দ আহমদ শহীদ ও মাওলানা ইসমাইল শহীদের নেতৃত্বে উপমহাদেশে মুসলিমদের ঈমানী জাগরণ তৈরি হয়েছিল, এবং শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা দুজনই সূফী ছিলেন। তাঁদের অনুসারী সকল মুজাহিদও তাসাউফের পথে দীক্ষিত ছিলেন।
১৮৩১ সালের পর ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের বড় একটি অংশ ছিলেন মুসলিম আলেম। আহমাদুল্লাহ শাহ মাদরাজী, লিয়াকত আলী এলাহাবাদী, হাফেয যামেন শহীদ, হাজী ইমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কী, মাওলানা কাসেম নানুতবী, মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুলী, মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানবী, সিপাহী বিপ্লবের পর যে সকল আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল, রেশমি রুমাল, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, এসবের নেতৃত্ব দানকারী শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী ও তাঁর সহযোদ্ধা ও শিষ্যগণ—এঁরা সবাই তো স্বীকৃত আলেম ও পণ্ডিত হওয়ার পাশাপাশি সূফি-সাধক ছিলেন। পাঠদান, আন্দোলন ও জিহাদের সাথে সাথে তাঁরা তাসাউফের দীক্ষাও দিতেন যত্নের সাথে।
তাছাড়া এটা শুধু উপমহাদেশের চিত্রই নয়, অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলেও আমরা দেখতে পাই, যাঁরা পশ্চিমা উপনিবেশের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন, কুফরি শক্তির সামনে মাথা নত করেননি, ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে দীক্ষিত করেছেন, তাঁরা এই তাসাউফের পথেই হেঁটেছিলেন। ফরাসি আগ্রাসনবিরোধী আলজেরিয়ার মহান সংগ্রামী নেতা আমীর আবদুল কাদের, ব্রিটিশবিরোধী অবিসংবাদিত মুজাহিদ সুদানের মুহাম্মদ আহমদ আল-মাহদী, ইটালি উপনিবেশিকদের আতংক লিবিয়ার সায়্যিদি আহমদ শরীফ সানুসী ও উমর আল মুখতার, রুশ আগ্রাসনবিরোধী প্রসিদ্ধ মুজাহিদ শায়েখ শামিল নকশেবন্দী—এঁরা সবাই এই পথের পথিক ছিলেন।
ভারতের বিশিষ্ট চিন্তক আলেম আবুল হাসান আলী নদবী এমন আরও উদাহরণ টেনে উপসংহারে লিখেছেন, এসব দৃষ্টান্তের বিপরীতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার একটি দৃষ্টান্ত পেশ করুন, যা এমন কোনো ব্যক্তি বা দলের হাতে সম্পন্ন হয়েছে, যাঁরা তাসাউফ থেকে দূরে ছিলেন, বরং তাসাউফবিরোধী ছিলেন! মুসলিম বিশ্বের পুরো ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে রয়েছে। এর মধ্যে একটি দ্বীনী আন্দোলন ও ইসলামী জাগরণ দেখান, যাঁরা তাসাউফের ‘বিষ’ থেকে ‘পবিত্র’ ছিল? যে আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তি শুধু নিজ মেধা, পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনার দ্বারাই সব কিছু সম্পন্ন করেছেন! এবং রূহানী সাহচর্য ও আত্মিক দীক্ষা একেবারেই গ্রহণ করেন নি! [আসরে হাযের মে দ্বীনকি তাফহীম ও তাশরীহ, পৃষ্ঠাক্রম : ১০৫]
তাসাউফের সাথে দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই গভীর সম্পর্কের রহস্য মাওলানা নদবী রহ. অন্য একটি রচনায় তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন দ্বীনের জন্য কুরবানী, আত্মত্যাগ, জিহাদ—এই সবকিছুর জন্য যে পরিমাণ রূহানী শক্তি ও ইখলাসের প্রয়োজন হয় অনেক সময় এই শক্তি আত্মিক পরিশুদ্ধি, অন্তরের পরিশীলন, মুজাহাদা ও ইবাদত ছাড়া অর্জিত হয় না। [তাসাউফ কিয়া হ্যায়, পৃষ্ঠাক্রম : ১১৩]
মূলত তাসাউফ যদি সুন্নতমাফিক হয়, সঠিক উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিতে চর্চিত হয় তাহলে এই তাসাউফ মানুষের মধ্যে কর্মশক্তি ও মনোবল তৈরি করবে। জিহাদ ও শাহাদতের প্রতি অদম্য স্পৃহা সৃষ্টি করবে।
সবশেষে তাসাউফ সম্পর্কে কর্মবিমুখতা ও পলায়ন-পরতার যে অভিযোগ বা বিভ্রান্তি এর কারণ সম্পর্কে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। আমরা আগেও দেখিয়েছি অনেকেই তাসাউফের ভুল চর্চা করেছেন। তাঁদের একটি অংশ তাসাউফ চর্চা করতে গিয়ে জীবন জগৎ থেকে নিজেদের গুটিয়ে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। এটা তাঁদের নিজস্ব উপলব্ধি ও অবস্থান। কিন্তু এর বিপরীতে তাসাউফের সমর্থক প্রচারক ও বুজুর্গদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যাঁরা আমৃত্যু দ্বীনী কর্মতৎপরতায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। মানুষের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা বিস্তার, দাওয়াত ও তাবলীগ, জিহাদ, রাজনীতি—সবকিছু একাধারে সমানভাবে করে গেছেন। ফলে তাসাউফ চর্চাকারীদের একটি অংশের ভুল কর্ম পদ্ধতিকে অবলম্বন করে পুরো তাসাউফকে সেই দোষে দুষ্ট করা, ঢালাওভাবে নেতিবাচক বক্তব্য প্রচার করা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তাসাউফ সম্পর্কে এমন ঠুনকো ও অযৌক্তিক আরো সমালোচনা সমাজের একটি শ্রেণির মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু একজন সত্যসন্ধানী মানুষের করণীয় হলো, সমালোচনাগুলোকে বাস্তবতার মানদণ্ডে যাচাই না করে অন্ধভাবে গ্রহণ না করা।
উপরের বিশ্লেষণে খুব সংক্ষেপে আমরা তাসাউফের সমালোচনা ও ভ্রান্তির কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীন পালনের সঠিক পথপন্থায় পরিচালিত করুন, আমীন।
গ্রন্থপঞ্জি,
১. تصوف كيا هے মাওলানা মঞ্জুর নোমানি
২. عصر حاضر ميں دين كي تفهيم وتشريح মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবি
৩. তাসাউফ তত্ত্ব ও পর্যালোচনা, মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব
৪. الاعتصام ইমাম শাতেবি
৫. دار العلوم ديوبند مدرسة فكرية মাওলানা উবাইদুল্লাহ আসাদি
৬. علماء ديوبند اتجاههم الفكري মাওলানা কারী তৈয়ব