নারীর জীবনলক্ষ্য ও জীবন পরিকল্পনা

ছোট হোক বা বড়, যে কোনো সফরের জন্য একটা লক্ষ্য থাকতে হয়। আমাদের জীবনও একটি সফর। ফলে জীবনের একটি লক্ষ থাকা একান্ত দরকার। লক্ষ থাকা না থাকার মধ্যে ব্যবধান অনেক। ব্যবধানটি যে কত গুরুতর একটি উদাহরণের মাধ্যমে তা আমরা বুঝতে পারি। আমরা হয়তো অনেকবার দৌড় প্রতিযোগিতা দেখেছি। সেখানে কী কাণ্ডটা ঘটে? একসারিতে শক্তসামর্থ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক দূরে পুঁতে রাখা হয় একটি খুঁটি বা ঝুলানো হয় রঙিন একটি সাইন। সারিবদ্ধ মানুষগুলোর সবার চোখেই জয়ের প্রচণ্ড নেশা। অন্য প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে যেভাবেই হোক খুঁটির কাছটিতে পৌঁছুতে হবে। এরপর যখন বাঁশি বাজে, মানুষগুলো মনের সবটুকু ইচ্ছা ও শরীরের সকল জোর একত্র করে ছুটতে থাকে। এরপর কিছু মানুষ গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এবং পৌঁছামাত্র তাদের শরীরের মধ্যে এবার উল্টো একটা গতি সৃষ্টি হয়। তারা থামতে চায়। অপরদিকে পেছনের যারা টের পায় এখন আর খুঁটির কাছে গিয়ে লাভ নেই, চারপাঁচজন ইতিমধ্যে পৌঁছে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে, তাদের মধ্যেও একটা গা ছাড়া ভাব সৃষ্টি হয়। একটু ‍আগেও যারা সমস্ত মনোযোগ একত্র করে প্রাণপনে ছুটছিলো, সেই লোকগুলো এখন আর ছুটছে না বা কোথাও যেতে চাচ্ছে না। এর কারণ একটাই—আগে একটা গন্তব্য ছিল, এখন সেটি নেই।

এই ঘটনা থেকে আমরা কিছু ফলাফল বের করতে পারি। সামনে নির্দিষ্ট একটি গন্তব্য থাকলে আমাদের ভিতরে:
১. পরিকল্পনা থাকে,
২. সময়ের তাড়া থাকে,
৩. নিজের সামর্থের সবটুকু ব্যয় করে পরিশ্রম করতে পারি,
৪. মনোযোগ টান টান হয় ও ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখা যায়,
৫. ভিতরে প্রচণ্ড জেদ ও ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ঘটে।


জীবনপথে চলতে গিয়ে যার একটি গন্তব্য থাকবে, তার মধ্যেও এই গুনগুলো সুনিশ্চিতভাবে তৈরী হবে। আর যার মধ্যে এ গুনগুলো থাকবে, সে যে জীবনে অনেকদূর যাবে, তার জীবনটা হবে সাফল্যে ভরপুর—তা বলাই বাহুল্য।
একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আমাদের জীবনলক্ষ কী? মুসলিম হিসেবে আমাদের মূল লক্ষ অবশ্যই ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করা। যার ফলে আমরা দুনিয়াতে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করব এবং পরকালে জান্নাত পাব। কিন্তু সে লক্ষ্যটি অর্জন করতে হলে আমাকে কাজ করতে হবে এবং সময় ও পরিশ্রম ব্যয় করে পৃথিবীর জীবনটাকে স্বার্থক করে তুলতে হবে। এর জন্য পরিকল্পনা দরকার। আমি জীবনে কী হতে চাই? বয়স যখন ৫০ কি ৬০ হবে তখন নিজেকে কোথায় দেখতে চাই? পৃথিবী ছেড়ে যখন চলে যাব, তখন যেন টের পাই পৃথিবীতে আমার জীবনটা অনর্থক ছিল না। সারা জীবন দিয়ে আমি দামি কিছু উপার্জন করতে পেরেছি। সেই জিনিসটা কী হবে?

এ প্রশ্নের উত্তরটা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হবে, তেমনি নারী আর পুরুষের জীবনভাবনায়ও পার্থক্য থাকবে, যেহেতু তাদের জীবনযাপনপদ্ধতি, কর্মের পরিসর, চলাফেরার ধরণ, যোগ্যতার বৈচিত্র নানা দিক দিয়ে তাদের মধ্যে ব্যবধান আছে। ফলে সবার কথা আলোচনা না করে আমরা একজন নারীর জীবন নিয়ে আলোচনা করতে পারি, এমন একজন নারী যিনি সদ্য পড়াশোনা সমাপ্ত করেছেন।

পরিকল্পনাটি হতে পারে এমন—
১. ইবাদত: সারা জীবন ফরজ ওয়াজিব সুন্নত মুস্তাহাব ইবাদতগুলো আলাদা প্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত মনোযোগিতা ও যত্নের সাথে নিয়মিত আদায় করা।
২. সুন্নাহ গাইডলাইন: সারা জীবনের জন্য সুন্নাহসম্মত জীবনযাপনের একটা সংক্ষিপ্ত গাইডলাইন তৈরী করে সে অনুযায়ী চলা। কোথায় কোন দোয়াটি পড়তে হয়, সকাল সন্ধ্যার আযকারগুলো, কোন কাজগুলো সুন্নত, কোন কোন কাজে বেশি সওয়াব হয়—অনুসন্ধান করে করে সবগুলো তালিকাবদ্ধ করা ও সে অনুযায়ী আমল করা।
৩. ইলম ও দাওয়াত: অর্জিত ইলম ধরে রাখা, নিয়মিত চর্চা করা, এবং এসবের উপর নিজে আমল করার পাশাপাশি আশপাশের নারী ও শিশুদেরকে তা শেখানো। এর জন্য মাদরাসায় পড়াতেই হবে জরুরী না। পড়ানোর সুযোগ হলে পড়ানো হবে, সুযোগ না হলে সংসার জীবনে থেকেই দাওয়াত ও ইলমচর্চার এই কাজ জারি থাকবে।
৪. বিশেষ যোগ্যতা ও গুণ: যে সব বিষয়ে নিজের বিশেষ পারদর্শিতা আছে, সেগুলো ক্রমাগত বিকশিত করা। এর দ্বারা নিজে উপকৃত হওয়া এবং অন্যদেরকেও তা শেখানো। উদাহরণত কারো হয়তো হাতের লেখা সুন্দর, কিংবা সেলাইয়ের কাজ ভালো পারেন, কিংবা ভালো ডিজাইন করতে পারেন, অথবা লেখালেখি ও অনুবাদ সুন্দর করে করতে পারেন। আবার কেউ হয়তো সুন্দর বলতে পারেন। এই যোগ্যতাগুলোকে শরীয়তের অনুশাসনের ভিতরে থেকে সর্বদা কাজে লাগানোর চেষ্টা করা।
৫. আত্মসংশোধন: প্রায় সব মানুষেরই কাজকর্ম বা আচরণ-অভ্যাস সংক্রান্ত কিছু ভুলত্রুটি থাকে। কার ভিতরে কী ভুল আছে, তা তিনি নিজেই ভালো জানেন। নিজের এই দুর্বলতাগুলোর উপর সর্বদা নজর রাখা ও এগুলোকে সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
৪. বইপড়া: প্রয়োজনীয় ও পছন্দের বিষয়ের উপর বইপত্র পড়াটা সবসময় জারি রাখা খুব জরুরী। প্রতিদিন কিছু না কিছু হলেও পড়তে হবে। সাংসারিক ব্যস্ততায় পড়াটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এর জন্য পড়ার নির্দিষ্ট একটা জায়গা থাকা খুব ভালো। বা বিছানার পাশে ছোট একটা বুক সেলফ থাকতে পারে।
৫. সম্পর্ক: স্বামী, রক্ত সম্পর্কিয় আত্মীয়, শশুরবাড়ির আত্মীয়, উস্তাদগণ, বন্ধুবান্ধব, এলাকার পাড়াপ্রতিবেশি, গ্রামের দুঃখী ও অভাবি নারীগণ—এমন বহু ধরণের সম্পর্ক আমাদের জীবনে তৈরী হয়। এ সম্পর্কগুলোর যত্ন নেওয়া ও হক আদায় করা। কোনো মানুষ যখন সম্পর্কগুলোর যত্ন নেয়, তখন সে সবার প্রিয় হয়ে উঠে।
৬. সংসার: অত্যন্ত মনোযোগ, সবর, বুদ্ধি ও পরিকল্পনার সাথে সুন্দর একটি সংসারজীবন গড়ে তোলা।
৭. সন্তান: আল্লাহ তাআলা যদি সন্তান দান করেন, তাহলে সবগুলো সন্তানকে প্রয়োজনীয় ইলম শিখিয়ে ও সঠিক তারবিয়ত দিয়ে খাঁটি মুমিন ও সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

আর এই সবগুলো কাজ করতে হলে আমাদেরকে ক্রমাগত শিখতে হবে, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে, অন্যের সাথে পরামর্শ করতে হবে, আত্মসমালোচনা করতে হবে এবং ভুলত্রুটি সংশোধন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একজন নারী যখন জীবনের শুরুতেই এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে জীবনের পথে অগ্রসর হবেন, তখন তার আর বসে থাকার ফুরসত মিলবে না, তাকে ক্লান্তি স্পর্শ করবে না এবং অনর্থক কাজে লিপ্ত হওয়ার চিন্তা মাথায়ও আসবে না। তিনি তখন অসাধারণ একজন স্ত্রী হবেন, অসাধারণ একজন মা হবেন এবং অতুলনীয় একজন পরোপকারী মমতাবান মানুষে পরিণত হবেন।

এর বিপরীতে যার এমন কোনো লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নেই, পড়াশোনা শেষ করার পর বিয়ে হলো, সংসার হলো, স্বামী সংসার নিয়ে জীবনযাপন করলেন, একসময় মৃত্যুবরণ করলেন। দুজন কাছাকাছি কাজগুলোই করে গেলেন। কিন্তু লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কারণে প্রথমজনের জীবন হবে অনেক স্বার্থক, অনেক সতেজ, প্রাণবন্ত ও কর্মচঞ্চল এবং অনেক বেশি উদ্যমতায় ভরপুর। সেই যে দৌড়ের গল্পে আমরা শুরুতে বলে এসেছিলাম: একটা গন্তব্য থাকলে আমাদের ভিতরে পরিকল্পনা থাকে, মনোযোগ থাকে, শ্রম দিই, সময়ের তাড়না থাকে, এবং প্রচণ্ড জেদ থাকে।

সুন্দর একটি জেদি মন ছাড়া জীবনে সফল হওয়া আসলে অসম্ভব।

বিজ্ঞাপন:
ইসলামে উত্তরাধিকার আইন ও সমাজের অসংগতি।
লেখক: মুফতি মাহবুবুর রহমান।
প্রকাশক: সমকালীন প্রকাশনী
ক্রয় করতে এখানে ক্লিক করুন।

শেয়ার করুন

image_print
Picture of সাবের চৌধুরী
সাবের চৌধুরী
সাবের চৌধুরীর জন্ম হবিগঞ্জ সদরে। হিফজ সম্পন্ন করেছেন হরষপুর মাদ্রাসায়। বিবাড়িয়ার দারুল আরকাম, ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ও দারুল ফিকরে কেটেছে তার শিক্ষাজীবন। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। লেখালেখি ও সম্পাদনাও করছেন নিয়মিত। মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে জীবনে রোদ্দুরে, অটুট পাথর, কোথাও নিঝুম হয়েছে কেউ~ বেশ পাঠক প্রিয় বই।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া