মাকাসিদে শরীয়া নাকি  ‘প্রবৃত্তির মাকাসিদ’? ড. ফাহাদ আজলান

‘শরিয়তের মাকাসিদের আলোকে এই বিধানের ব্যপারে  আমাদের পূণর্বিবেচনা করতে হবে’; অথবা ‘এ বিষয়টি আলোচনার সময় অবশ্যই শরিয়তের মাকাসিদের দিকটি খেয়াল রাখতে হবে—শরিয়তের বিধান, কুরআনের আয়াত এবং হাদিস বিষয়ে আলোচনা করার সময় বিকৃত ও অসংগত চিন্তার লোকদেরকে এ ধরনের বিচিত্র ঢংয়ের বক্তব্যগুলো হাজির করতে দেখা যায়। মূলত এ ধরণের লোকগণ যখন শরিয়তের কোন বিধানকে যখন পাশ কাটিয়ে যেতে চান বা স্বীকার করার ইচ্ছা করেন, তখন ‘মাকাসিদে শরীয়া’র এই  প্লে-কার্ডটি ব্যবহার করেন। সত্যিকার অর্থে এটি শরীয়ত বিরোধী কাজের ‘শরয়ী ছাড়পত্র’।

মাকাসিদে শরীয়া সম্পর্কে ইসলামের মহান ফকীহগণ বিস্তর আলোচনা করেছেন। ইমাম জুয়াইনি, ইমাম গাযালী, সুলতানুল উলামা ইয ইবনে আব্দুস সালাম, ইমাম কারাফি, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ এবং ইমাম শাতেবী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তবে তারা যে মাকাসিদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন আর বর্তমান সময়ের অনেক লেখক ও চিন্তক যে ‘মাকাসিদ’ এর কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। 

ফুকাহায়ে ইসলামের মতে, মাকাসিদে শরীয়া হল এমন কিছু মৌলিক নীতিমালা, যা কুরআনের সমস্ত আয়াত, হাদীস এবং শরীয়তের শাখাগত বিধানাবলীর পরিপূর্ণ অনুসন্ধানের পর নির্ধারণ করা হয়েছে। এবং এই মৌলিক নীতিমালা দ্বারা শরিয়তের কোন বিধান অথবা পবিত্র কুরআনের কোন আয়াত কিংবা কোন হাদীসকে প্রত্যাখ্যান বা বর্জন করা বৈধ নয়। এর ঠিক বিপরীত হল সেইসব ‘মাকাসিদ’, যেগুলো মূলত সুযোগ সন্ধানী এই সেই লোকদের প্রবৃত্তির বাসনাসমূহকেই প্রতিফলিত করে, এবং যেগুলোর দিকে তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ–অপন্দসমূহ সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এর সাহায্যে তারা কুরআন হাদীস ও শরীয়তের বিধানাবলীর উল্ল্যেখযোগ্য একটা অংশকে প্রত্যখ্যান করার চেষ্টা করেন।

মাকাসিদে শরীয়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি হল, কোন মাকাসিদের মাধ্যমে শরিয়তের শাখাগত কোন বিধান বর্জন করা যাবে না। যখন শরিয়তের কোন দলিল বা ফিকহি কোন বিধান প্রমাণিত হয়ে যাবে, তখন ‘মাকাসিদগত মূলনীতির বিরোধী’- এই কথা বলে একে বর্জন করা বা এড়িয়ে যাওয়া কোনভাবেই বৈধ নয়। কেননা এমন দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন; মাকাসিদ শাস্ত্রের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। ইমাম শাতেবীর ভাষায়—‘এমন বিষয়, যা শরিয়তের কোন মূলনীতি বা বিধানকে আঘাত করে, সেটা প্রকৃতপক্ষে বাতিল বিষয়’। (১)

মাকাসিদে শরীয়ার ক্ষেত্রে শরিয়তের মৌলিক বিষয়গুলো(كليات ) –কে আমলে নেয়া যেমন আবশ্যক, তেমনি শাখাগত বিষয়গুলো جزئيات) )-ও  সমান গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম শাতেবীর মতে-‘যে ব্যাক্তি শরিয়তের মৌলিক বিষয়কে উপেক্ষা  করে শাখাগত বিষয়কে গ্রহন করবে, সে ভুল কাজ করবে। একইভাবে শাখাগত বিষয় বর্জন করে কেবলই মৌলিক বিষয়গুলোকে আমলে নেয়াও ভুল অবস্থান।(২)

বস্তুত মাকাসিদে শরীয়া শরিয়তের বিস্তৃত শাখাগত বিধানাবলির উপরই নির্ভরশীল। ফলে মাকাসিদে শরীয়া শাখাগত বিষয়গুলোকে অস্বীকার করা কল্পনাতীত ব্যপার। কারণ, তখন তো এগুলো নিজেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে।

এমনকি কখনো যদি মাকাসিদের কোন মূলনীতির সাথে শরীয়তের শাখাগত বিধানের সংঘর্ষ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে, শাখাগত বিধানটি অস্বীকার না করা; বরং ইমাম শাতেবীর ভাষায়—‘সর্বোচ্চ অনুসন্ধানের পর যখন কোন একটি মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, অতঃপর কোরআনের আয়াত বা হাদীসে বর্ণিত কোন বিধান কোনভাবে সেই মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে উভয়টির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা আবশ্যক।’ (৩)

এই বৈপরীত্যের সময় উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করা জরুরি, কারণ, মৌলিক নীতিমালা এবং শাখাগত বিধানাবলী–প্রত্যেকটি আপন জায়গায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ব্যাপারটি  ‘প্রবৃত্তির মাকাসিদ’-সন্ধানীরা মোটেও অনুধাবন করেন না। তাদের কর্মপদ্ধতি হল, প্রথমে তারা পবিত্র কোরআনের আয়াত, হাদিস এবং শরীয়তের বিধানকে অস্বীকার করেন, অতঃপর তাদের এই প্রত্যাখ্যানকে সমর্থন করে, মাকাসিদের এমন কোন পথের তালাশে নেমে পড়েন।

অযোগ্য লোকদের হাতে মাকাসিদের ব্যবহার কতটা ভয়ঙ্কর, এ বিষয়ে ইমাম শাতেবী পূর্ণ সচেতন ছিলেন। মূলত এ কারণেই তাদেরকে তিনি  ‘আল মুয়াফকাত’ (শাতেবী রচিত মাকাসিদ বিষয়ক বিখ্যাত কিতাব) অধ্যায়ন করতে নিষেধ করেছেন কঠোরভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘উলুমে শরীয়া তথা শরীয়তের মৌলিক ও শাখাগত এবং আকলী ও নকলী জ্ঞানের সমস্ত শাখায় পূর্ণ ব্যুৎপত্তি ও গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করার পূর্বে কোন পাঠকের জন্য কিছুতেই এ কিতাব অধ্যয়নের অনুমোদন নেই’। (৪)

শরীয়তের শাখাগত বিধানাবলীর প্রতি যত্নবান থাকা অতি জরুরী এবং মাকাসিদ মূলত এ প্রকারের বিধানাবলীর উপরই প্রতিষ্ঠিত—এই কথাগুলো ইমাম শাতেবী তাঁর কিতাবে বারবার আলোচনা করেছেন। কেননা, তাঁর নিকট স্পষ্ট ছিল যে, মাকাসিদ এবং এর অতি ব্যাপক মূলনীতিগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই অযোগ্য লোকেরা অনুপ্রবেশ করবে এবং  শাস্ত্রটিকে কিছু ভ্রষ্ট ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে। পরিণতিতে যা মূল শরীয়তকেই অকার্যকর করে দিবে।

প্রকৃতপক্ষে মাকাসিদের অযাচিত ও লাগামহীন ব্যবহার শরীয়তের সমস্ত বিধানকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এভাবে অকাট্য সুপ্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনস্বীকৃত বিধানকে ভণ্ডুল করা সম্ভব। কারণ, শরীয়তের একটি বিধানকে অস্বীকার করে  ‘বড় রকমের কোন মাকসাদের’ দোহাই দেয়া খুবই সহজ কাজ। এবং এটা শুধু আশংকার কথা নয়; এই সময়ের কত লোক শরিয়তের প্রতিষ্ঠিত বিধানাবলীর সাথে এমন বিচিত্র অসংযত আচরণ করেছে, তার সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ পাকের কাছে রয়েছে।

কেউ শরীয়তের দণ্ডবিধি ও মুরতাদের শাস্তি অস্বীকার করছেন। যুক্তি হিসেবে বলছেন, এগুলো শরীয়তের অনেক মাকাসিদ–যেমন, রহমত করুণা নিরাপত্তা উদারতা ও স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক। কেউ কেউ পর্দার বিধান ও সুদের নিষিদ্ধতার বিপক্ষে কথা বলছেন। তাদের মতে, এগুলো মানুষের জীবনে অসুবিধা সৃষ্টি করে। আর অসুবিধা দূর করা শরীয়তের অন্যতম মাকসাদ বা উদ্দেশ্য।

মাকাসিদের এই সীমাহীন ব্যাপকতা সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া খুব সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি স্পষ্ট বলেছেন, আল্লাহ পাক যে বিধান দিয়েছেন, সেটা উপেক্ষা করে কোন ব্যক্তি নিজ খেয়াল খুশিমত যা ন্যায় ও সঠিক মনে করে, সে অনুযায়ী মানুষের মাঝে ফায়সালা করাকে যদি বৈধ বলে বিশ্বাস করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। (৫)

মাকাসিদগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এসবের মধ্যে সীমাহীন ব্যাপকতা রয়েছে রয়েছে রয়েছে। ফলে এর মধ্যে অধিকাংশ মতবাদ–চিন্তা–দর্শন সমানভাবে অংশীদার রয়েছে। মাকাসিদগুলো তখনই “শরয়ী” হয়ে উঠবে যখন শরীয়ত নিজস্ব দর্শনের আলোকে মাকাসিদগুলোর রূপরেখা ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করবে। এবং এর সীমারেখা নির্ধারণ করে দিবে। ফলে কোন ব্যক্তি যদি এ বিষয়টি বিবেচনা না করে করে শুধু মুক্ত ও ব্যাপক মাকাসিদগুলোকে অবলম্বন করে, তাহলে এই কর্মপদ্ধতির সাথে শরীয়তের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তখন এগুলো “শরীয়তের মাকাসিদ”(مقاصد الشريعة) না হয়ে নিজের “প্রবৃত্তির মাকাসিদ”(مقاصد النفوس) হয়ে উঠবে।

“প্রবৃত্তির মাকাসিদের” ক্ষেত্রে আমরা আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করে থাকি। তারা নিজেদের মাকাসিদগুলোকে সব সময় নিরেট ইহলৌকিক কল্যাণের সাথে সীমাবদ্ধ করে থাকেন। অথচ কোরআন ও হাদিস থেকে প্রাপ্ত মাকাসিদে শরীয়ার বৈশিষ্ট্য এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইমাম শাতেবী বলেন, আল্লাহপাক কোন বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইহকালীন ও পরকালীন উভয় ধরনের কল্যাণ বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা করে থাকেন। (৬) অথচ, সত্য হলো—ইহকালীন কল্যাণ পরকালীন কল্যাণের অনুগামী হবে। ইমাম শাতেবী লিখেছেন—‘শরীয়তের দৃষ্টিতে যে কল্যাণ অর্জন করা কাম্য (المصالح المجتلبة) এবং যে অকল্যাণ থেকে বাঁচা কর্তব্য (المفاسد المستدفعة ) এটা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হল, পার্থিব জীবন পরকালীন জীবনের স্বার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। কল্যাণ অর্জন করা এবং অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে মানুষের প্রবৃত্তি কিছুতেই মানদণ্ড নয়। (৭)

কোন এক সময় গোঁড়ামি অজ্ঞতা ও মানুষের উপর অনর্থক কঠোরতা ব্যাপক হয়ে পড়েছিল। তখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাকাসিদে শরীয়া শাস্ত্রটির ব্যাপক চর্চা ও প্রচারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিবর্তিত এই সময়ে এ শাস্ত্রটির প্রচার-প্রসারে বাড়াবাড়ি করা, সাধারণ মানুষের কাছে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অতি বড় করে দেখানো ক্ষতিকর। কেননা, এর মাধ্যমে পরিণামে কোরআন হাদিসের স্পষ্ট বক্তব্যের প্রতি মানুষের আনুগত্য ও ভক্তি-শ্রদ্ধা হ্রাস পাবে। অপরদিকে মাকাসিদে শরীয়ার নামে প্রবৃত্তির অনেক নতুন মাকাসিদ আবিষ্কৃত হবে এবং শরীয়তে হস্তক্ষেপ ও বিকৃতি ঘটাবে। বর্তমানে তা যে হচ্ছেও, এটি আমাদের চোখের সামনেই।
 

সূত্র:
১. আল মুওয়াফাকাত, ইমাম শাতেবী ২/৫৫৬
২. প্রাগুক্ত ৩/৮
৩. প্রাগুক্ত ৩/৯
৪. প্রাগুক্ত ১/৭৮
৫. মিনহাজুস সুন্নাহ ৫/১৩০
৬. আল মুওয়াফাকাত ২/৩৫০
৭. প্রাগুক্ত ২/৩৫১

Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া