ঈমান বা বিশ্বাস হচ্ছে একজন মানুষের মূল পূঁজি। ঈমানকে যথাযথভাবে গ্রহণ ও ধারণ করা, এর সঠিক পরিচর্যা করা প্রত্যেক মুমিনের সর্বপ্রধাণ কর্তব্য। একজন মানুষ যখন তার এই কর্তব্যটি পালন করেন, ঈমানকে সঠিকভাবে নিজের মধ্যে ধারণ করেন, তখন এর ফলাফল কী হয়? তিনি কী অর্জন করেন? এই নিবন্ধে কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঈমানের ফলাফল, অর্জন ও প্রাপ্তির কয়েকটি দিক বর্ণনা করব।
- মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন
একজন মানুষ যখন ঈমান বা বিশ্বাসকে নিজের মধ্যে ধারণ করে, সে আল্লাহ তায়ালার নিকট শ্রেষ্ঠ ও উত্তম হিসেবে গণ্য হয়, ঐ মানুষের তুলনায় যে ঈমানকে নিজের মধ্যে ধারণ করেনি। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চই বিশ্বাসি ক্রিতদাস মুশরিক বা অংশিবাদি ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ, যদিও এই মুশরিক তোমাদের মুগ্ধ করে থাকে। (আয়াতঃ২২১) অর্থাত একজন মানুষ সামাজিকভাবে, বংশ গৈরবে, অর্থ বিত্ত্বে, ক্ষমতায়, জাগতিক শিক্ষায় যত পিছিয়েই থাকুক, এমনকি যদি গোলাম বা ক্রিতদাসও হয়, যখন ঈমানকে নিজের মধ্যে ধারণ করে নিবে, আল্লাহ তায়ালার নিকট শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়ে যাবে। এমনকি যে মানুষের শিক্ষা আছে, ক্ষমতা, অর্থ, সামাজিক মর্যাদা সবই আছে, কিন্তু ঈমান নেই, তার তুলনায়ও এই ঈমানদার ব্যক্তিটি শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত হবে। এটা হল ঈমানের ফলাফল। ঈমানের এই মহান প্রাপ্তির কথা সূরা বায়্যিনাতেও বর্ণিত হয়েছে। “যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্মসমূহ করেছে, তারা সৃষ্টিকূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।“ আয়াতঃ ৭) এর আগের আয়াতে যারা ঈমানকে গ্রহণ করবে না, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে “সৃষ্টিকূলের অধম” আখ্যা দিয়েছেন।
- ঈমান উত্তম কাজকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করে
দুই ব্যক্তি, একজন মুমিন, অপরজন কাফের বা অবিশ্বাসি। মুমিন ব্যক্তি বিশ টাকা দান করল, আল্লাহ তায়ালা তার দান কবুল করবেন। অপরদিকে যে কাফের, সে যদি বিশ হাজার টাকাও দান করে, আল্লাহ তায়ালার নিকট সেটা প্রত্যাখ্যাত হবে। শুধু গরিব মিসকিনকে দান করা নয়, এটি সব রকম ইবাদত বন্দেগি, জনকল্যাণমূলক কাজ সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রথম ব্যক্তির অল্প আমল গ্রহণ করা এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির বড় আমলও গ্রহণ না করার কারণ হল, ঈমান থাকা ও না থাকা। প্রথম ব্যক্তির ঈমান আছে, তাই সে যে কোন আমল করুক, আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে ঈমান নেই, তাই তার বড় বড় আমলও ফিরিয়ে দেয়া হবে। পরকালে সে এর কোন বিনিময় লাভ করবেনা।
সূরা আম্বিয়ায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি মুমিন হয়ে সতকর্ম করবে, তার কাজকে আগ্রাহ্য করা হবে না। এবং আমি তা লিখে রাখি। (আয়াতঃ৯৪) আয়াতে সতকাজ গ্রহণযোগ্য হও্য়ার জন্য ঈমানের শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। তার মানে দাঁড়াল ঈমান না থাকলে সতকাজ গ্রহণযোগ্য হবে না। একথা স্পষ্ট শব্দে আল্লাহ তায়ালা একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেছেন। সূরা কাহফে তিনি বলেন, “বলে দাও, আমি কি তোমাদের বলে দিব, কর্মে কারা সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সে সকল লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সমস্ত কাজ নিষ্ফল হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করছে, তারা খুবই ভালো কাজ করছে! এরাই সে সমস্ত লোক যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত সমূহ ও তাঁর সামনে উপস্থিতিকে অস্বিকার করেছে। ফলে তাদের সমস্ত কাজ নিষ্ফল হয়েছে। আমি কিয়ামতের দিন তাদের কোন ওজন গণ্য করব না। (আয়াতঃ১০৩-১০৫) অবশ্য অন্যান্য আয়াত ও হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত যে কোন কাফের যদি দুনিয়াতে কল্যাণ ও ভালো কাজ করে, তাহলে এর প্রতিদান কোন না কোনভাবে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। (সহি মুসলিমঃ২৮১৮) কিন্তু প্রকৃত প্রতিদান লাভের জায়গা, পরকালে সে এর কিছুই পাবে না।
- আল্লাহ তায়ালার অবিভাবকত্ব ও সাহায্য অর্জন করা যায়
এটিও ঈমানের অনেক বড় একটি ফলাফল ও প্রাপ্তি। যে ব্যক্তি যথাযথভাবে ঈমানকে ধারণ করে নিবে, মহান আল্লাহ তার অবিভাবক হয়ে যাবেন। তাকে সাহায্য করবেন। সব রকমের বিপদ আপদ থেকে তাকে উদ্ধার করবেন। এসম্পর্কে কয়েকটি আয়াত পাঠ করুন।
১। আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে যাবতীয় অন্ধকার (শিরক, কুফর, বিদাত, পাপের অন্ধকার) থেকে বের করে আলোতে নিয়ে আসেন। (সূরা বাকারাঃ ২৫৭)
২। যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের প্রতিরক্ষা করেন। সূরা হজ্জঃ ৩৮ অর্থাৎ সব রকমের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন।
৩। তখন আমি তাঁর (নূহ আঃ) ডাকে সাড়া দিলাম, এবং বিপদ থেকে উদ্ধার করলাম। এবং এভাবেই আমি মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি। (সূরা আম্বিয়াঃ ৮৮)
- আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব লাভ
একজন ঈমান মানুষ যখন ঈমানকে বরণ করেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি যে সকল মহান বিষয় লাভ করেন তার মধ্যে অন্যতম একটি হল, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা, তাঁর বন্ধুত্ব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, স্মরণ রেখ, যারা আল্লাহর বন্ধু তাদের কোন ভয়ও থাকবে না, তারা দুঃখিতও হবে না। তারা সেই সব লোক যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। (সূরা ইউনুসঃ ৬২-৬৩) এখানে আল্লাহ তায়ালার বন্ধু হওয়ার জন্য দুটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। তার একটি হল, ঈমান। সূরা মারিয়ামেও আল্লাহ তায়ালা বিষয়টি বর্ণনা করেছেন, যারা ঈমান এনেছে ও সতকর্মসমূহ করেছে নিশ্চয়ই দয়াময় আল্লাহ তাদের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করবেন। (আয়াতঃ৯৬) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা নিজেও তাদের ভালোবাসবেন। অন্যান্য মানুষও তাদের ভালোবাসবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির) শুধু ভালোবাসাই নয়, তাদের প্রশংসা করবে। জীবিত ও মৃত সর্বাবস্থায় তাদের জন্য দোয়াও করবে।
- দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক নিরাপত্তা
কুরআনে কারীমে বর্ণিত ঈমানের বিশেষ একটি ফলাফল হচ্ছে, এর দ্বারা একজন মানুষ দুনিয়া ও মৃত্যু পরবর্তি জীবনের সমূহ ভয় ভীতি ও অনিষ্টতা থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। ঈমান গ্রহণের কারণে সে আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টি থেকে নিরাপদ হয়ে যায়। সূরা আনয়ামে বলা হয়েছে, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলুমের সাথে মিশ্রিত করে নি, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত। (আয়াতঃ৮২) এই সূরার অপর আয়াতে বলা হয়েছে, অতএব যে ঈমান আনল ও সতকর্ম করল, তাদের কোন ভয়ও নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। (আয়াতঃ৪৮)
- ঈমান প্রশান্তিপূর্ণ জীবনকে নিশ্চিত করে
একজন ব্যক্তির কাছে জাগতিক উপায় উপকরণ সব আছে, কিন্তু মানসিক প্রশান্তি নেই, তাহলে তাকে সুখি মানুষ বলা যায় না। তিনি বরং অস্থিতিশীল একটি জীবন যাপন করছেন। মানব জীবনে এই মানসিক অস্থিরতা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল ঈমান ও সতকর্ম। যে ব্যক্তি সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর প্রতি দৃড় বিশ্বাস পোষন করবে সেই কেবল স্থীর ও প্রশান্তিময় জীবন লাভ করতে সক্ষম হবে। সূরা নাহলে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি মুমিন অবস্থায় সতকর্ম করে, চাই সে পুরুষ হোক বা নারি, আমি তাকে উত্তম জীবন যাপন করাব। (আয়াতঃ ৯৭) অর্থাৎ দুনিয়াতে ঈমানের সাথে যেকেউ ভালো কাজ করলে, দুনিয়ার জীবন তার জন্য সুখ ও শান্তিপূর্ণ হবে। মুমিন যদি ধনি হয় তাহলে তো হলই। কিন্তু দরিদ্র হলে কথা হল, সে অল্পেতুষ্ট হবে, তার কিসমত ও বন্টন নিয়ে খুশি থাকবে। এবং সওয়াবের আশায় ধৈর্্য্য ধারণ করবে। এভাবে মুমিনের জীবন অনাবিল ও সুখময় হবে।
- জীবনের সর্বোচ্চ সাফল্য আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ ঈমানের মাধ্যমেই সম্ভব
ইসলামি নির্দেশনা অনুযায়ি মানুষের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করে পরকালিন মুক্তি লাভ করা। এবং জান্নাতে প্রবেশ করা। (দ্রষ্টব্য সূরা আলে ইমরানঃ ১৮৫) আর এই জান্নাত ও সন্তুষ্টি কেবল ঈমানের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। এটি কুরআন ও হাদীসে বার বার ঘোষিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি আয়াত হল, আল্লাহ তায়ালা মুমিন পুরুষ ও নারিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এমন উদ্যানসমূহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্থায়ী উদ্যানের উত্তম আবাসস্থলের। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি সবচে মহান। এবং এটাই মহা সাফল্য। (সূরা তাওবাঃ ৭২)
ঈমানের আরো অনেক প্রাপ্তি অর্জন ও মহান ফলাফলের কথা কুরআন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এগুলো জানা আমাদের জন্য জরুরি। এতে করে আমরা যে ঈমানকে ধারণ করছি, এর মূল্য বুঝতে পারব। কিভাবে ঈমানকে সঠিকভাবে ধারণ করা যায়, এই প্রেরণা জাগ্রত হবে। সাথে সাথে ঈমানের ক্ষতি করে বা ঈমানকে হরণ করে এমন সকল বিষয়ে সজাগ ও সচেতন হতে পারব। আমরা আমৃত্যু যেন মহামূল্যবান ঈমানকে যত্নের সাথে ধারণ করতে পারি, আল্লাহ তায়ালার কাছে সেই তাওফিক প্রার্থণা করি।