- শুরুর কথা
ফিকহ শাস্ত্র বা ইসলামি ফিকহ সম্পর্কে; ফিকহের পরিচয় ও স্বরূপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে লামাজহাবি-আহলে হাদীস ঘরাণার এক শ্রেণির আলোচক ও লেখক বেশ কিছু অমূলক দাবি করছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, ফিকহ হল মানুষের কথা ও সিদ্ধান্ত। আমরা কুরআন হাদীস মানব, ফিকহ কেন মানব? আরো বলা হচ্ছে, আগে হাদীস, পরে ফিকহ। অর্থাৎ তাদের বিবেচনায়, কুরআন হাদীস ও ফিকহ- একটি অপরটির বিপরিত, এগুলো পরষ্পর সাংঘর্ষিক। ফিকহ কুরআন হাদীসের বাইরে তৃতীয় কোন বিষয়, ফিকহ মানলে কুরয়ান হাদীস মানা হবে না। এই একই দাবি তারা আরো বিভিন্ন শব্দে প্রকাশ ও প্রচার করে থাকেন।
ফলে পুরো মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেণির মানুষ যে ফিকহ শত শত বছর যাবত অনুসরণ করে আসছেন, এ ব্যপারে নতুন করে বিভ্রান্তি ও সংশয় তৈরি হচ্ছে। এজন্য ফিকহ সম্পর্কে আরোপিত প্রশ্নগুলোর বিশ্লেষণ, ফিকহের স্বরুপ ও বাস্তব পরিচয় তুলে ধরা অতীব জরুরি হয়ে উঠেছে।
মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে দুটি বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া জরুরি। প্রথম বিষয়টি হল, দীনি বিষয়ে কোন ভুল অসত্য বা বিদাতের বিরোধিতা করা জরুরি, এটি ইসলামের নির্দেশনা। কিন্তু দীনের সঠিক ও প্রতিষ্ঠিত সত্য বিষয়কে ভুল আখ্যায়িত করা, বিরোধিতা করা ভয়াবহ অন্যায়। এটি দীনি বিষয়ে ভুল ও বিদাতের চর্চা ও প্রচারের চে কোন অংশেই কম নয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ফিকহ সম্পর্কে সমাজে যে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এর সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই, এটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও অবান্তর কথা। বলতে দ্বিধা নেই, যারা ফিকহ সম্পর্কে এমন সব কথা প্রচার করছেন তারা ফিকহের পরিচয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এই না জানা সত্ত্বেও ফিকহ বিষয়ে তারা এমন বড় রকমের সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, তারপর সেটা প্রচারও করে চলেছেন! অথচ তারা একটু কষ্ট স্বীকার করে নির্ভরযোগ্য কোন কিতাব থেকে ফিকহের স্বরূপ সংজ্ঞা ও পরিচয়টি যদি মনোযোগের সাথে পাঠ করে নিতেন, তাহলে নতুন এই বিভ্রান্তিটি মাথাচারা দিত না, এতে সাধারন মুসলিম ও আলেম- উভয় শ্রেণির সময় বেঁচে যেত।
- ফিকহের শাব্দিক পরিচয়
এবারে আমরা মূল আলোচনায় ফিরে যাচ্ছি। ফিকহের পরিচয় জানার জন্য আরবি ভাষার যেকোন অভিধান খুললে আমরা দেখতে পাব, ফিকহের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- কোন বিষয়কে গভীরভাবে বুঝা, উপলব্ধি করা। (লিসানুল আরব, আল মু’জামুল ওয়াসিত) ফলে অর্থগত দিক থেকে ফিকহ শব্দে নিন্দনীয় কিছু নেই, বরং এটি কাংখিত ও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কুরআন হাদীসেও ফিকহ শব্দটি একই অর্থে এবং প্রশংসার স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। (দেখুন, সূরা তাওবাঃ ১২২, সূরা আনয়ামঃ ৯৮, সহি বুখারিঃ ৩৪৯৩)
তাহলে আমরা যখন ফিকহ শব্দটি ব্যবহার করছি তখন কোন বিষয়ের গভীর উপলব্ধিকে বুঝাবে? মূলত তখন ফিকহ শব্দটি কুরয়ান হাদীসের বক্তব্য ও বিধি বিধানকে ভালোভাবে উপলব্ধি করা ও গভীরভাবে অনুধাবন করাকে বুঝাবে। ফিকহের শাস্ত্রিয় সংজ্ঞার দিকে তাকালে এ বিষয়টি আমরা সহজেই ধরতে পারব।
- ফিকহের পারিভাষিক পরিচয়
শাস্ত্রীয় ভাষায় ফিকহ হচ্ছে,
هو العلم بالأحكام الشرعية من أدلتها التفصيلية
শরীয়তের বিষদ দলীল প্রমাণ থেকে আহরিত শরীয়তের বিধিবিধান সম্পর্কে উত্তমরূপে জানা। (কামুসুল ফিকহ:১/৩৩৯)
শরীয়তের চারটি সর্বস্বীকৃত দলীল রয়েছে- কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস। ইজমা ও কিয়াস যে শরীয়তের দলীল, এটাও কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই চার দলীলের উপর ভিত্তি করে যেসকল বিধি বিধান সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হবে, এ সম্পর্কে জানার নামই ফিকহ। তাহলে ফিকহের প্রধাণ উৎস ও ভিত্তি হচ্ছে, কুরআন ও হাদীস। আর ফিকহ হল, কুরয়ান হাদীসের সার নির্যাস, ফলাফল। অন্যভাবে বললে, ফিকহ হল, কুরয়ান হাদীসের সুবিন্যস্ত উপস্থাপন।
ফিকহের এই পরিচয়টি ইসলামের বরেণ্য ফকীহ মুজতাহিদ ইমামদের বক্তব্য থেকেও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। ইমামে আযম আবু হানিফা রহঃ ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ফকীহ। তার সম্পর্কে ইমাম শাফেঈ রহ: বলেছেন, ফিকহের ক্ষেত্রে অন্যান্যরা আবু হানিফার মুখাপেক্ষি। এই ইমামে আযম তার কর্মপন্থা বর্ণনা করে বলেছেন,
أني آخذ بكتاب الله إذا وجدته ، فما لم أجده فيه آخذ بسنة رسول الله والآثار الصحاح عنه التي فشت في أيدي الثقات عن الثقات فإذا لم أجد في كتاب الله ولا سنة رسول الله أخذت بقول أصحابه من شئت وأدع قول من شئت ثم لا أخرج عن قولهم إلى قول غيرهم فإذا انتهى الأمر إلى إبراهيم والشعبي والحسن وعطاء وابن سيرين وسعيد بن المسيب وعدّد رجالا فقوم قد احتجوا فلي أن أجتهد كما اجتهدوا. (الانتقاء لابن عبد البر)
আমি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) অনুসারে আমল করি, যদি সেখানে পাই। অন্যথায় রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ ও তাঁর থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করি, যা বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের সূত্র্রে বিশ্বস্তদের হাতে হাতে ছড়িয়ে আছে। যদি কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও না পাই তবে সাহাবীগণের যার মত পছন্দ হয় গ্রহণ করি, যার মত পছন্দ হয় না গ্রহণ করি না। তবে তাঁদের মতের বাইরেও আমি যাই না। আর যখন ইবরাহীম নাখায়ী, শা’বী, হাসান, আতা, ইবনে সীরীন ও সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব- আরো অনেকের নাম বলেছেন- প্রমুখ পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়ায়, তো তাঁরাও ইজতেহাদ করেছেন, আমিও তাদের মতো ইজতেহাদ করেছি। (হাফেজ ইবনে আব্দুল বার রচিত আল ইনতিকা, পৃ. ২৬৪, ২৬৫)
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে, ফিকহ কুরআন হাদিস বহির্ভূত কোন বিষয় নয়। বিপরিত বা সাংঘর্ষিক হওয়া তো দূরের বিষয়, ফিকহ কুরআন হাদীসের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত বিষয়। এবং কুরআন হাদীস অনুসরণের প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
বরং ইসলামি জ্ঞানে গভীর পান্ডিত্ব্যের অধিকারি নয়, এমন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফিকহ অনুসরণ করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। কেন নেই? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের জানতে হবে ফিকহ আসলে কী কাজ করে? কিভাবে কাজ করে? তাই সামনে আমরা ফিকহের মৈলিক কয়েকটি কাজ তুলে ধরব। আমাদের বিশ্বাস এতে ফিকহের পরিচয়টি যেমন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে, তেমনি আমাদের জন্য ফিকহ কেন জরুরি, এবং কতটা জরুরি, এবিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
- ফিকহ কিভাবে কাজ করে?
ইসলামি জ্ঞানে গভীর পান্ডিত্ব্যের অধিকারি নয় এমন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফিকহ অনুসরণ করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। কেন নেই? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের জানতে হবে ফিকহ আসলে কী কাজ করে? কিভাবে কাজ করে? তাই সামনে আমরা ফিকহের মৌলিক কয়েকটি কাজ তুলে ধরছি। আমাদের বিশ্বাস এতে ফিকহের পরিচয়টি যেমন স্পষ্ট হয়ে উঠবে, তেমনি আমাদের জন্য ফিকহ কেন জরুরি, এবং কতটা জরুরি, এবিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
১। কুরয়ান হাদীসের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত বিধানকে এক স্থানে বিন্যস্ত আকারে উপস্থাপন করা
আমরা জানি, মহান আল্লাহ তায়ালা ইসলামের বিধানাবলি একসাথে একত্রিতভাবে আবতীর্ণ করেন নি। বরং প্রয়োজন মাফিক ধাপে ধাপে অবতীর্ণ করেছেন। ফলে একটি বিষয়ের আলোচনা কুরআনে কারীমের বিভিন্ন অংশে বর্ণানা করা হয়েছে। এর পেছনে বহু হিকমত ও রহস্য রয়েছে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদীসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নবীজির হাদীস অসংখ্য কিতাবে সংকলিত হয়েছে। ফলে এখানেও একটি বিষয় হাদীসের কিতাব সমূহের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন স্থানে এসেছে।
ফিকহ এখানে যে কাজটি করবে তা হল, ওই বিষয়ক আয়াত ও হাদীস যত জায়গায় এসেছে সবগুলোকে একত্রিত করবে, তারপর সামগ্রিকভাবে এ বিষয়ে যে বিধানগুলো দেয়া হয়েছে সবগুলোকে একটি ক্রম বিন্যাসে সাজিয়ে একটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদে উপাস্থাপন করবে। ফলে উক্ত বিধানগুলো যে জানতে চায় তাকে এজন্য নতুন করে পুরো কোরআন শরীফে অনুসন্ধান করতে হবে না, হাদীসের শত শত কিতাবও ঘাটতে হবে না। বরং ফিকহের নির্ভরযোগ্য কোন কিতাবের সংশ্লিষ্ট অধ্যায় পড়লেই পুরো বিষয়টি জানতে পারবেন। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট সকল আয়াত হাদীস শুধু একত্রিত করলেই কাজ সমাধা হয়ে যায় না, বরং আয়াত ও হাদীস সঠিকভাবে বুঝার জন্য বহু শাস্ত্রের গভীর পান্ডিত্ব্য থাকা আবশ্যক। যা জ্ঞানের প্রতি নিবেদিত জ্ঞান সাধক মহান ইমাম ও বরেণ্য আলেমদের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব হয়ে থাকে। ফলে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিমদের কথা বহু দূরবর্তি, যারা আরবি পড়েছেন, আরবি বুঝেন, তাদের পক্ষেও এটা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে একটি উদাহরণ খেয়াল করুন। কুরয়ানে কারীমে আল্লাহ তায়ালা হজের বিধান দিয়েছেন। মোট তিনটি সূরায় প্রধাণত হজের আলোচনা এসেছে। সর্বপ্রথম সূরা বাকারার ১৫৮ নং আয়াতে, তারপর একই সূরার ১৮৯ আয়াত, অতঃপর ১৯৬ থেকে ধারাবাহিকভাবে ২০৩ নং আয়াত পর্যন্ত হজের আলোচনা করা হয়েছে। একইভাবে সূরা মায়েদার ২ নং আয়াত ও ৯৩ থেকে ৯৭ আয়াত পর্যন্ত এ বিষয়ে বর্ণনা এসেছে। সবশেষে সূরা হজের ২৬ থেকে ৩৭ নং আয়াতগুলোতে হজের বিধান বর্ণিত হয়েছে।
অপরদিকে হাদীসের বিভিন্ন কিতাব, যেমন প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবঃ বুখারি মুসলিম আবু দাউদ তিরমিযি নাসাঈ ও ইবনে মাজা, এর বাইরেও হাদীসের বহু কিতাব রয়েছে, যেমন মুসনাদে আহমদ (৫০ খন্ড), মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা (২৬খন্ড), মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক (১২খন্ড), সুনানে দারাকুতনি, মুসনাদে দারেমি, তবারানির তিন মু’জাম প্রভৃতি, এ সমস্ত কিতাবে হজ সম্পর্কিত অধ্যায়ে এবং এর বাইরেও হজের হাদিস রয়েছে।
ফিকহ হজ বিষয়ক কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ নানা জায়াগা থেকে সংগ্রহ করবে, এগুলোকে বিন্যস্ত করে একটি অধ্যায় যেমন “কিতাবুল হজ বা হজের অধ্যায়ে” লিপিবদ্ধ করবে। এখন, হজ কী? হজ কার উপর ফরজ হয়? কখন ফরজ হয়? হজ কিভাবে করতে হয়? হজ কত প্রকার? হজে কোন কোন কাজ করা নিষিদ্ধ? কোন কাজ করলে হজ নষ্ট হয়ে যায়? এরকম হাজারো প্রশ্ন, যেগুলোর উত্তর কুরয়ান হাদীসে বিভিন্ন স্থানে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সরাসরি কুরয়ান হাদীস থেকে বের করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি যদি ফিকহ শাস্ত্রের ৮-৯ পৃষ্ঠার কিতাবুল হজ পাঠ করেন, তাহলে প্রয়োজনীয় উত্তর পেয়ে যাবেন।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র। শরীয়তের যে কোন বিধানের ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য। নামাজ রোজা যাকাত কোরবানি বিবাহ ব্যবসা বানিজ্য মিরাস দন্ড বিধি প্রভৃতি কত হাজারো বিধানকে এমন সহজভাষায় বিন্যস্ত আকারে ফিকহ তুলে ধরেছে। ফলে এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কেউ যদি দাবি করে হাদীস মানব, ফিকহ কেন? তাহলে তার এই কথার কোন অর্থ থাকবে না। কেননা ফিকহ তো হাদীসের বর্ণিত বিধানকেই বিন্যস্ত করে পেশ করছে। অনুসরণের বিচারে কুরান হাদীস ও ফিকহকে আলাদা করার সুযোগ নেই। কেননা হাদীসকে মানা ও অনুসরণ করার মাধ্যম ও পদ্ধতিটিই হল ফিকহ।
২। কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত বিধানের স্তর ও মান নির্ণয় করা
কোরআন ও হাদীসে যে সকল বিধি বিধান বর্ণনা করা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে এগুলোর স্তর ও মান নির্ণয় করে দেয়া হয় নি। সাধারণভাবে নির্দেশনাগুলো পালন করার কথা বলা হয়েছে। তবে এটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে, শরীয়তের সব বিধানের মান ও স্তর সমান নয়, এগুলোর মধ্যে স্তরভেদ ও তারতম্য রয়েছে।
এজন্য আমরা দেখি, কোন কোন বিধান পালন করা আবশ্যক, যেমন- ফরজ ও ওয়াজিব বিধান। আবার কোন বিধান পালন করা আবশ্যক না হলেও পালন করা উচিত, সওয়াবের কাজ, যেমন- সুন্নত ও মুস্তাহাব আমল। অপর দিকে কিছু বিষয় আছে যেগুলো করা বা না করা উভয়টি সমান, যেমন- মুবাহ কাজ।
দেখুন,
- কুরআনে কারিমে নামাজ ও যাকাতের ব্যাপারে বলা হয়েছে,
وأقيموا الصلاة وآتوا الزكوة.
তোমরা যথাযথভাবে নামাজ আদায় কর, আর যাকাত দাও। সূরা বাকারা:৪৩
- আবার হজ্জ ও উমরার উদ্দেশ্যে যে ইহরাম পরিধান করেছে, তার জন্য শিকারের বিধান বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
وإذا حللتم فاصطادوا
যখন তোমরা ইহরাম থেকে হালাল হবে তখন শিকার করো। মায়েদা:০২
এই দুই আয়াতেই আদেশ সূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, নামাজ আদায় করো, যাকাত দাও, শিকার করো। কিন্তু সবগুলো আদেশের স্তর কি একই? এখানেই ফিকহের কাজ! ফিকহ নির্ধারণ করে দিবে, নামাজ ও যাকাতের আদেশ আবশ্যকতাকে বুঝাচ্ছে, ফলে এটি ফরজ। সবাইকে পালন করতে হবে। কিন্তু শিকার করার আদেশ এটি আবশ্যকতাকে বুঝাচ্ছে না, বরং বৈধতাকে বুঝাবে। অর্থাত ইহরাম খুলার পর যার ইচ্ছা সে শিকার করতে পারে, কিন্তু শিকার করা তাদের জন্য জরুরি নয়।
- অপরদিকে সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا تَدَايَنْتُمْ بِدَيْنٍ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَاكْتُبُوهُ
হে মু’মিনগন! তোমরা যখন একে অন্যের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋনের কারবার কর তখন তা লিখে রাখবে। (২৮২)
কারো থেকে ঋণ নেয়ার সময় লিখে রাখাটা কি আবশ্যক? না লিখলে গোনাহ হবে? এখানেই ফকীহদের কাজ। তারা কুরআন হাদীসের অন্যান্য বক্তব্যকে সামনে রেখে এই আদেশের স্তর নির্ধারণ করেছেন। তারা দলীলের আলোকে দেখিয়েছেন, এই লিখে রাখাটা মুস্তাহাব তথা উত্তম। এতে ঝগড়া ফাসাদের দরজা বন্ধ হয়। তবে না লিখলে গোনাহ হবে, বিষয়টি এমন নয়। (তাফসীরে আবু সাউদ ও ইবেন কাসির)
উদাহরণগুলোতে আমরা দেখলাম, কুরআন হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন বিধানের স্তর নির্ণয় করা, এর মধ্যে কোনটি ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব বা মুবাহ তা চিহ্নিত করা ফিকহের বিশেষ কাজ। স্তর নির্ণয়ের কাজটি বর্জণীয় বিধানাবলির ক্ষেত্রেও ফিকহ করে করে থাকে। এভাবে আমরা হারাম, মাকরুহ তাহরেমি তানজেহি অনুত্তম ইত্যাদি শ্রেণি সম্পর্কে জানতে পারি।
বিধানাবলির এই স্তর ও অবস্থান সম্পর্কে জানা একজন মুসলিমের জন্য খুবি জরুরি একটি বিষয়। এতে করে সঠিক ও সচেতনভাবে ইসলাম চর্চা করা সম্ভব হবে। না হয় দেখা যাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিধানে জোর দেয়া হচ্ছে, কিংবা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে একেবারে বাদই দেয়া হচ্ছে!
৩। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত বিধানের ব্যখ্যা প্রদান ও স্পষ্ট করণ
কুরআন হাদীসে এমন অনেক বিধান রয়েছে যেগুলোর সীমারেখা স্পষ্ট শব্দে বলে দেয়া হয়নি। ফলে এগুলোর ব্যখ্যা ও স্পষ্ট করার প্রয়োজন পড়ে। এসকল ক্ষেত্রে শরীয়তের অন্যান্য বক্তব্য, আরবি ভাষা ও সাহাবিদের বক্তব্য ও কর্মপন্থাকে সামনে রেখে সেই বিধানগুলোর সীমারেখা ও সঠিক কাঠামো বের করতে হয়। এই সীমারেখা নির্ধারণ করা ছাড়া যথাযথভাবে ইসলামের বিধান পালন করা সম্ভব নয়। বস্তুত এটিও ফিকহের অন্যতম কাজ।
দুটি উদাহরণ খেয়াল করুন-
- সূরা মায়েদায় অজুর পদ্ধতি বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا قُمۡتُمۡ اِلَی الصَّلٰوۃِ فَاغۡسِلُوۡا وُجُوۡهَکُمۡ وَ اَیۡدِیَکُمۡ اِلَی الۡمَرَافِقِ وَ امۡسَحُوۡا بِرُءُوۡسِکُمۡ وَ اَرۡجُلَکُمۡ اِلَی الۡکَعۡبَیۡنِ
হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাজে দাঁড়াবে , তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর আর টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)। (আয়াত:৬)
আয়াতে চেহারা ধোয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চেহারা সীমারেখা কী? কোথা থেকে শুরু কোথায় শেষ? ফিকহ বলে দিবে, মাথার চুল উঠার স্থান থেকে থুতনি পর্যন্ত, এবং এক কানের লতি থেকে অপর কানের লতি পর্যন্ত পুরোটাই চেহারার অন্তর্ভূক্ত। আয়াতে চেহারা ধোয়ার নির্দেশনা তখনই পালন করা হবে যখন পূর্ণাংগভাবে এই সবটুকু ধুবে।
তারপর কনুই পর্যন্ত হাত ধোয়ার আদেশ করা হয়েছে। কনুই কি ধুতে হবে? একই কথা মাথা মাসেহের ক্ষেত্রে। পুরো মাথা মাসেহ করা কি জরুরি? নাকি কিছু অংশ মাসেহ করা যথেষ্ট? এ জায়গাগুলোতে ফিকহ সমাধান দিবে।
- কেউ যদি চুরি করে এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তার চুরি প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে তার শাস্তি হচ্ছে হাত কেটে দেয়া। সূরা মায়েদায় বলা হয়েছে,
- وَ السَّارِقُ وَ السَّارِقَۃُ فَاقۡطَعُوۡۤا اَیۡدِیَهُمَا جَزَآءًۢ بِمَا کَسَبَا نَکَالًا مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ
আর পুরুষ চোর ও নারী চোর তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও তাদের অর্জনের প্রতিদান ও আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষণীয় আযাবস্বরূপ এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (আয়াত: ৩৮)
প্রশ্ন হল, কোন হাত কাটা হবে? তারপর হাতের কোন অংশ থেকে কাটা হবে? ফিকহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এর সমাধান দিবে।
৪। রহিতকারি বিধান (নাসেখ) ও রহিত বিধান (মানসুখ) নির্ধারণ করা
কুরআন হাদীস কিছুটা গভীরভাবে যারা পাঠ করেছেন, রহিতকারি ও রহিত বিধান তাদের কাছে অতি পরিচিত একটি বিষয়। এর মূল কথাটি হল, আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপযোগিতা বিবেচনা করে প্রথমে একটি বিধান দেন, তারপর সেই বিধানটি রহিত করে নতুন বিধান অবতীর্ণ করেন। তখন যে বিধানটি রহিত হয়ে গেছে সে অনুযায়ি আর আমল করার সুযোগ থাকে না, যদিও কুরয়ান ও হাদিসে রহিত বিধানটি বিদ্যমান থাকে। এ প্রসংগে সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন,
مَا نَنسَخۡ مِنۡ ءَایَةٍ أَوۡ نُنسِهَا نَأۡتِ بِخَیۡرࣲ مِّنۡهَاۤ أَوۡ مِثۡلِهَاۤۗ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَیۡءࣲ قَدِیرٌ (١٠٦)
আমি যে আয়াত রহিত করি বা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম আয়াত অথবা এর অনুরূপ আয়াত নিয়ে আসি। তুমি কি জান না, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। (সূরা বাকারা:১০৬)
যেমন, ইসলামের শুরুর যুগে উত্তরাধিকারের বিষদ বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে বিধান ছিল, প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুর আগে তার পিতা মাতা ও নিকটাত্বীয়দের জন্য অসিয়ত করে যাবে। এটা তার জন্য ফরজ ছিল। সূরা বাকারায় এই বিধানের বিবরণ এভাবে এসেছে,
كُتِبَ عَلَیۡكُمۡ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلۡمَوۡتُ إِن تَرَكَ خَیۡرًا ٱلۡوَصِیَّةُ لِلۡوَ ٰلِدَیۡنِ وَٱلۡأَقۡرَبِینَ بِٱلۡمَعۡرُوفِۖ حَقًّا عَلَى ٱلۡمُتَّقِینَ﴾
তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোন সম্পদ রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ন্যায়ভিত্তিক অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকীদের দায়িত্ব। (সূরা বাকারা:১৮০)
কিন্তু অসিয়তের এই বিধান সূরা নিসার উত্তরাধিকার বিষয়ক আয়াতের (১১-১২) দ্বারা রহিত হয়ে যায়। সেখানে বলা হয়েছে,
یُوۡصِیۡکُمُ اللّٰہُ فِیۡۤ اَوۡلَادِکُمۡ ٭ لِلذَّکَرِ مِثۡلُ حَظِّ الۡاُنۡثَیَیۡنِ ۚ فَاِنۡ کُنَّ نِسَآءً فَوۡقَ اثۡنَتَیۡنِ فَلَہُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَکَ ۚ وَ اِنۡ کَانَتۡ وَاحِدَۃً فَلَہَا النِّصۡفُ ؕ وَ لِاَبَوَیۡہِ لِکُلِّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَکَ اِنۡ کَانَ لَہٗ وَلَدٌ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یَکُنۡ لَّہٗ وَلَدٌ وَّ وَرِثَہٗۤ اَبَوٰہُ فَلِاُمِّہِ الثُّلُثُ…
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য হবে, যা সে রেখে গেছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ; আর যদি একজন মেয়ে হয় তখন তার জন্য অর্ধেক। আর তার মাতা পিতা উভয়ের প্রত্যেকের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ সে যা রেখে গেছে তা থেকে, যদি তার সন্তান থাকে। আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং তার ওয়ারিছ হয় তার মাতা পিতা তখন তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ।… এভাবে অন্যান্যদের অংশও উল্লেখ করা হয়েছে।
ফলে এখন পিতা মাতা ও নিকটাত্বীয়দের জন্য অসিয়ত করা আবশ্যক থাকেনি, বরং তাদের জন্য অসিয়ত করা নিষিদ্ধ। (তাফসিরে জালালাইন)
ফিকহের সাহায্যে একজন মুসলিম ইসলামে কাংখিত বিধানটি পালন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন। ফিকহকে বর্জন করে যেকেউ যদি সরাসরি কুরয়ান হাদীস থেকে বিধান গ্রহণ করা শুরু করে তাহলে রহিত হয়ে গেছে এমন বিধানকে অনুসরণ করার আশংকা রয়েছে, যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর এটা শুধু আশংকার কথা নয়, যারা ফিকহ বাদ দিয়ে কেবল হাদিসের অনুবাদের উপর নির্ভর করে ইসলাম চর্চা করে চলেছেন তাদের ক্ষেত্রে এটা অহরহ ঘটছে। অধম লেখকও এমন কান্ড দেখেছি।
৫। বাহ্যত বিরোধপূর্ণ বক্তব্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা
যেহেতু কুরআন হাদীস আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, আর তিনি সীমাহীন ও পরিব্যপ্ত জ্ঞানের অধিকারি, তাই তার কোন বক্তব্যে প্রকৃতপক্ষে কোন বৈপরিত্ব থাকা অসম্ভব। কুরআনে কারীমের ঘোষনা হল,
أَفَلَا یَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَیۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُوا۟ فِیهِ ٱخۡتِلَـٰفࣰا كَثِیرࣰا
তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না? আর এটি যদি আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো পক্ষ থেকে হত তাহলে তারা এতে অনেক মতপার্থক্য দেখতে পেত। (সুরা নিসাঃ ৮২)
তবে কোন কোন ক্ষেত্রে কুরয়ান হাদিসের বক্তব্যের মধ্যে বাহ্যত বৈপরিত্ব দেখা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো কোন বৈপরিত্ব নয়। মানুষের ক্ষুদ্র দৃষ্টি, অনুসন্ধান ও দুর্বল উপলব্ধির কারণে কোন বিধানের ক্ষেত্রে আপাতঃ বিপরিতমূখি মনে হয়ে থাকে।
এসকল ক্ষেত্রে কুরয়ান হাদিসের সামগ্রিক বক্তব্যকে সামনে রাখতে হয়। তারপর বিরোধপূর্ণ বক্তব্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার যে সকল মাধ্যম রয়েছে (ইমাম হাযেমি ৫০টি মাধ্যম উল্লেখ করেছেন) তার কোন একটি প্রয়োগ করে সমন্বয় করতে হয়। এটি ফিকহের অন্যতম কাজ।
এ বিষয়ে একটি উদাহরণ খেয়াল করুন। হজ্জ বা উমরার জন্য ইহরাম পরিধানকারি ব্যক্তি বিবাহ করতে পারবে কি না- এ বিষয়ে দু ধরণের হাদীস পাওয়া যায়।
সহি মুসলিমের একটি হাদীসে এসেছে, المحرم لا ينكح ولا ينكح
অর্থাৎ ইহরামকারি ব্যক্তি নিজেও বিবাহ করতে পারে না, অন্য কারো বিবাহ করাতেও পারে না। সহি মুসলিমঃ
কিন্তু এই সহি মুসলিমের অন্য হাদিস থেকে জানা যায়, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় মায়মুনা রা. কে বিয়ে করেছেন। (সহি মুসলিম:১৪১০)
عن ابن عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَ مَيْمُونَةَ وَهُوَ مُحْرِمٌ ” رواه البخاري (1837) ومسلم (1410)
ফকীহগণ বাহ্যত এই বিরোধ ও বৈপরিত্ব দূর করে দুই হাদীসের মধ্যে সমন্বয় করেছেন। এবং এই সমন্বয় করতে গিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্যও হয়েছে। হানাফি ফকীহগণ নবীজির আমলকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, ইহরাম অবস্থায় বিয়ে করা বৈধ আছে। আর দলিলের আলোকে প্রথম হাদিসের বিভিন্ন ব্যখ্যা পেশ করেছেন। দ্রষ্টব্যঃ মিরকাত ৫/১৮৪৯
৬। কোরআন হাদীসের কোন বিধানটি নবিজির সাথে খাছ বা বিশেষিত, কোনটি উজরবশত বা সাময়িকভাবে করেছেন, এবং কোন বিধানটি সাধারণ ও সবার জন্য প্রযোজ্য, এটি নির্ণয় ও নির্ধারণ করাও ফিকহের বিশেষ কাজ।
ইসলামের অনুসারি সবার জন্য এ বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখা অতীব জরুরি। কেননা বহু বিধান এমন আছে যেগুলো শুধুমাত্র নবীজির জন্য প্রযোজ্য, যেমন তাহাজ্জুদ ফরজ হওয়া (সূরা ইসরাঃ ৭৯), মোহর ছাড়া বিবাহ করা (সূরা আহযাবঃ৫০) । নবিজির সাথে বিশেষিত এই বিধানগুলোকে কেউ যদি সবার জন্য প্রযোজ্য মনে করে তাহলে বিরাট রকমের জটিলতা তৈরি হবে। এবং সে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা পালন তো করবেই না, উল্টো বিরোধিতাকারিতে পরিণত হবে।
অপরদিকে কিছু বিষয় আছে যেগুলো নবীজি কোন উজর বা অসুবিধার কারণে করেছেন, যেমন সহি বুখারির একটি হাদিসে এসেছে, নবিজি এক গোত্রের ভাগাড়ের কাছে এলেন তারপর দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন। (হাদিস নংঃ ২২৪)
কিন্তু এটি নবিজির সব সময়ের আমল ছিল না, যেমন আয়েশা রাঃ বর্ণনা করেছেন, নবিজি সর্বদা বসেই পেশাব করতেন। (তিরমিযিঃ ১২) এখান থেকে ফকীহগণ বলেছেন, ইসলামের মূল নির্দেশনা হল বসে পেশাব করা। তবে কোন অসুবিধা থাকলে দাঁড়িয়েও পেশাব করতে পারে। যেমন, বসার মত জায়গা না থাকার কারণে নবিজি দাঁড়িয়ে পেশাব করেছিলেন।
৭। কুরান হাদিসে বর্ণিত বিধানকে সমজাতীয় ও একই শ্রেণির অন্যান্য বিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা
কুরআন ও হাদিসে প্রধাণত নীতিমালা ও বড় বড় বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু উদাহরণের সাহায্যে মূলনীতিটি ব্যখ্যা করা হয়েছে। যেমন নবিজি সুদ সম্পর্কিত একটি হাদীসে বলেছেন,
التمْرُ بالتمْرِ، والحِنطةُ بالحِنطةِ، والشَّعيرُ بالشَّعيرِ، والمِلْحُ بالمِلْحِ، مِثْلًا بِمِثلٍ، يَدًا بِيدٍ، فمَن زادَ واستزادَ فقدْ أرْبى
খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, লবনের বিনিময়ে লবন বিক্রি কর সমান সমান ও নগদে। অতএব কেউ যদি বাড়িয়ে দেয় অথবা বেশি চায়, তাহলে সে সুদের সাথে জড়িয়ে গেল। সহি মুসলিমঃ ১৫৮৮। বুখারি শরিফের বর্ণনায় এই চার জিনিসের সাথে স্বর্ণ ও রূপার কথাও বলা হয়েছে। হাদীসঃ ১৭২২।
হাদীসের সারকথা হল, কেউ যদি এই ছয় জিনিষের কোন একটির সাথে অনুরূপ জিনিষের লেনদেন করে, তাহলে তাকে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে- ১। উভয় বস্তুর পরিমাণ সমান হতে হবে। ২। নগদ বা হাতে হাতে লেনদেন সম্পন্ন হতে হবে।
ফলে এর কোন একটি যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে লেনদেন হাদীসের ভাষায় সুদ হিসেবে আখ্যায়িত হবে।
যেমন একজনের কাছে ১কেজি খেজুর আছে, তিনি কারো কাছ থেকে এর বিনিময়ে দুই কেজি খেজুর কিনতে চাচ্ছেন। তার এই লেনদেন বৈধ হবে না। কেননা দুই বস্তুর পরিমাণে সমতা নেই। কমবেশি রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, হাদিসে বর্ণিত এই বিধানটি কি শুধু উক্ত ছয় বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি এজাতীয় অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? যদি প্রযোজ্য হয় তাহলে কোন কোন বস্তুর ক্ষেত্রে হবে? এবং কোন পদ্ধতিতে হবে? যেমন, ধান চাল তুলা লোহা আম কাঠাল কলা প্রভৃতি জিনিষের বিধান হাদীসে উল্লেখ নেই, এগুলোর বিনিময়ের বিধান কী? এজায়গাতে ফিকহ কাজ করবে। উক্ত ছয় জিনিষের বিনিময়ের যে বিধান হাদীসে দেয়া হয়েছে, এর “ইল্লত” বা অন্তরনিহীত কারণ কী? এই কারণটি কোন কোন জিনিষের মধ্যে পাওয়া যায়? ফিকহ এই জটিল ও সূক্ষ্ম কাজটি করে থাকে।
একথা সকলের জানা আছে, ইসলামের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের একটি হল, এই ধর্ম সামগ্রিক, পূর্ণাংগ। মানুষের জীবনের যত দিক ও বিষয় হতে পারে, এর সমাধান ও বর্ণনা ইসলামে বিদ্যমান রয়েছে। সূরা মায়েদা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাংগ করে দিলাম। (আয়াতঃ৩) কিন্তু জানা কথা, মানুষের সমস্যা ও জিজ্ঞাসা অন্তহীন। এজন্য কুরয়ান হাদীস মোলিক নীতিমালা বর্ণনা করে দিয়েছে, পাশাপাশি এগুলো থেকে বিধান আহরণ করার পদ্ধতি বলে দিয়েছে। ফিকহ সেই মূলনীতিগুলোর আলোকে কুরআন হাদিসের নির্দেশিত পদ্ধতিতে মানুষের জীবনের সমস্ত সমস্যা ও জিজ্ঞাসার সমাধান দিয়ে থাকে। ফলে ফিকহ ও ফকীহদের এই ভূমিকার মধ্য দিয়ে ইসলামের সামগ্রিকতা ও পূর্ণাংগতা উত্তমরূপে প্রকাশিত হয়।
৮। নবিজির যুগে ছিল না, পরে আবিষ্কৃত হয়েছে , এমন বিষয়ের শরয়ি বিধান নির্ণয়ন করা
যুগ যত সামনে যাচ্ছে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের আবিষ্কার তত বিস্তৃত হচ্ছে। এমন হাজারো জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে যা নবিজির যুগে ছিল না। যেমন, রক্তদান, অংগপ্রতিস্থাপন, প্লেনে নামাজ আদায়, জিলাটিন প্রভৃতি। নতুন আবিষ্কৃত এসব প্রযুক্তি ও বিষয়ের সাথে মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবের বিধান সুস্পষ্টভাবে কুরয়ান হাদিসে বর্ণিত হয় নি। ইসলামি ফিকহ এখানে যে কাজটি করে তাহল, ইসলামের মূলনীতিসমূহকে সামনে রেখে কিয়াস ও ইজতেহাদের মাধ্যমে এসকল নব আবিষ্কৃত বিষয়ের বিধান নির্ণয় করে দেয়।
সমস্ত বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান কুরআন হাদীসে নেই, এবং এসকল ক্ষেত্রে কী করণীয়, একটি হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি বর্ণনা করেছেন। সুনানে আবু বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’আয (রাঃ)-কে যখন ইয়ামনের শাসনকর্তা নিয়োগ করে প্রেরণের ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেনঃ তোমার কাছে যখন কোন মোকদ্দমা পেশ করা হবে, তখন তুমি কিরূপে তার ফয়সালা করবে? তিনি বলেনঃ আমি আল্লাহ্র কিতাব অনুসারে ফয়সালা করবো। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করেনঃ যদি আল্লাহ্র কিতাবে এর কোন সমাধান না পাও? তখন মু’আয (রাঃ) বলেনঃ তবে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত অনুযায়ী ফয়সালা করবো। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করেনঃ যদি তুমি রাসূলের সুন্নাতে এবং আল্লাহ্র কিতাবে এর কোন ফয়সালা না পাও? তখন তিনি বলেনঃ এমতাবস্থায় আমি চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে ইজতিহাদ করবো এবং এ ব্যাপারে কোনরূপ শৈথিল্য করবো না। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’আযের বুকে হাত মেরে বলেনঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র, যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতকে এরূপ তাওফীক দিয়েছেন, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তুষ্ট হয়েছেন। (হাদিস:৩৯৫)
ফিকহের পরিচয় কাজ ও কর্মপদ্ধতির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র আমরা তুলে ধরেছি। এতে স্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, ফিকহ কুরআন হাদীসের বিপরিত বা সাংঘর্ষিক কিছু নয়। ফিকহ মানে আলেমদের কথা মতামত বা সিদ্ধান্ত- এটিও ফিকহের ভুল পরিচয়। বরং ফিকহ হচ্ছে, কুরআন হাদিস অনুসরণ করার পথে সহায়ক জরুরি একটি মাধ্যম। যা কুরআন হাদিসের বিধানগুলোকে সুবিন্যস্তরূপে উপস্থাপন করে। অন্যভাবে বললে, ফিকহ হচ্ছে- কুরআন হাদীসের সার নির্যাস, ফলাফল। এজন্য ফিকহকে কোন অবস্থাতেই কুরান হাদীসের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে মানুষকে ফিকহ থেকে দূরে রাখার বৈধতা নেই। মানুষ ফিকহকে অবলম্বন করেই কুরআন হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলেছে, এখন বিভিন্ন বিভ্রান্তি তৈরি করে তাদেরকে ফিকহ থেকে যদি সরিয়ে রাখা হয় পরিণামে তাদেরকে ধর্ম থেকেই সরিয়ে রাখা হবে। পরবর্তিতে এই বিষয়টি আমরা আরো বিষদভাবে ব্যখ্যা করব, ইনশা আল্লাহ।