অল্পেতুষ্টি একজন মুমিনের জীবনে অত্যন্ত জরুরি একটি গুণ। এটি একদিকে যেমন বহু কল্যান বয়ে নিয়ে আসে, অপরদিকে এটি অনেক অকল্যাণ থেকে রক্ষা করে। সর্বোপরি এই অল্পেতুষ্টি মানুষের জীবনে নিশ্চিত করে প্রশান্তি ও স্থীরতাকে।
অল্পেতুষ্টি বলতে কী বুঝায়?
আল্লাহ তায়ালা এ দুনিয়াতে আমার তাকদীরে-ভাগ্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, আমাকে তিনি যাকিছু দিয়েছেন, যথাযথ পদ্ধতিতে চেষ্টা সাধনা করার পর আমি যা পেয়েছি, তা নিয়ে সন্তুষ্ট খুশি ও তৃপ্ত থাকা। তিনি যা দেন নি তা নিয়ে আক্ষেপ আফসোস না করা, এবং সেটা লাভ করার জন্য লালায়িতও না হওয়া।
অর্থাৎ যে স্ত্রী সন্তান, সৌন্দর্য্য দৈহিক গঠন আকৃতি পেয়েছি, যে পরিবারে, দেশে জন্মেছি, চেষ্টা সাধনার পর যে চাকরি সম্পদ ঘর বাড়ি লাভ করেছি এসব নিয়ে তুষ্ট থাকা। দুনিয়ার জীবনে বৈষয়িক যা কিছু পেয়েছি এগুলো নিয়ে খুশি ও সন্তুষ্ট থাকা, এটাই অল্পেতুষ্টির মর্ম কথা।
অল্পেতুষ্টির কেন জরুরী?
এ প্রসংগে সংক্ষেপে দুটি দিক বর্ণনা করছি। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুটি জীবন দিয়েছেন। এক দুনিয়ার জীবন। যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি, জীবন যাপন করছি। দুই, পরকালীন জীবন, যা এই পার্থিব জীবনের পর শুরু হবে। আল্লাহ তায়ালা এই দুই জীবন দিয়েছেন, সাথে সাথে উভয় জীবনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করেছেন। দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে বলছেন,
وما الحياة الحياة الدنيا في الآخرة إلا متاع
পরকালের তুলনায় ইহজীবন সামান্যভোগের বস্তু ব্যতীত আর কিছুই নয় (সুরা রায়াদঃ ২৬)
فما متاع الحياة الدنيا في الآخرة إلا قليل
পরকালের তুলনায় দুনিয়ার ভোগ্যবস্তু সামান্যই! তাওবাহঃ ৩৮
অপরদিকে পরকালের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলছেন,
والآخرة خير وأبقى
আর পরকাল হচ্ছে শ্রেষ্ঠ এবং অধিক স্থায়ী। সুরা আ’লাঃ ১৭
আয়াত কয়েকটি সামনে রাখলে দুই জীবনের স্বরূপ আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠে।
- দুনিয়ার কোন নেয়ামত ও উত্তম বস্তু শতভাগ ভালো ও কল্যাণপূর্ণ নয়। প্রত্যেকটি বস্তুর একটি সীমারেখা আছে। এর বাইরে গেলে সেটা আর ভালো ও উত্তম হিসেবে বিবেচিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ ঘুম ও খাবারের কথা ভেবে দেখুন। ঘুম ও খাবার আমাদের সুস্থ্য থাকা ও বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এই ঘুম ও খাবারের ক্ষেত্রে কেউ যদি সীমালংঘন করে, আট ঘন্টার জায়গায় ষোল ঘন্টা ঘুমায়, তাহলে সে অসুস্থ হয়ে যাবে। কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। খাবারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
কিন্তু পরকালে মানুষ যে সকল নেয়ামত ও কল্যাণ লাভ করবে, সেটা শতভাগ কল্যান পূর্ণ হবে। এতে অকল্যাণ ও ক্ষতির কোন মিশ্রণ থাকবে না। এজন্য কুরআনে পরকালকে “খাইর” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
- আরেকটি হাকীকত হচ্ছে, দুনিয়াতে আমরা যত কিছুই অর্জন করি এর একটি মেয়াদ থাকে। যেমন কারো সৌন্দর্য্য আছে, কারো সম্পদ আছে, কারো ক্ষমতা আছে, এ সবকিছুরই সমাপ্তি আছে। একটা সময় এগুলো আর থাকবে না। অপরদিকে পরকালীন নেয়ামত ও কল্যাণ চিরকালীন। যার কোন সমাপ্তি ও ক্ষয় লয় নেই। এজন্য পরকালকে “আবক্বা” বা অধিক স্থায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ইহকাল ও পরকালের এই বাস্তবতা ও স্বরূপ জানার পর কোন বুদ্ধিমানই দুনিয়াতে অল্পেতুষ্টি অবলম্বন করা ছাড়া থাকতে পারেন না। এজন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إنما يكفي أحدكم ما كان في الدنيا مثل زاد الراكب
দুনিয়াতে থাকাকালীন সময়ে তোমাদের জন্য একজন মুসাফিরের সমপরিমাণ পাথেয় থাকাই যথেষ্ট। (আল জামে আস সাগীরঃ ২৬০১)
এই ছিল অল্পেতুষ্টি প্রয়োজনীয় হওয়ার প্রথম তাৎপর্য।
এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, তাকদীরের বিশ্বাস। ভালো মন্দ যা কিছুই ঘটেছে, ঘটবে, এর সব কিছুই আল্লাহ তায়ালা পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। এই বিশ্বাসকে ধারণ করেই একজন মুমিন মুমিন হয়ে থাকেন। তাকদীরের বিশ্বাসের দাবীও এটাই যে একজন মুমিন অল্পেতুষ্ট হবে। কারণ নবীজির শিক্ষা হল,
ما أصابَكَ لم يكن ليُخْطِئَكَ، وما أخطأكَ لم يكن ليُصِيبَكَ
তুমি যা পেয়েছ, তা তোমার হাতছাড়া হওয়ার সুযোগ নেই। আবার যা তোমার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তা তুমি পেতে পারতে না। (সাহিহুল জামে আস সাগীরঃ ৫২৪৪)
একজন মানুষ চেষ্টা সাধনা করার পর যা পেয়েছে, তা নিয়ে যদি তুষ্ট না হয়, বরং যা পায় নি, তাও পেতে চায়, তাহলে কী হবে? যা তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তার ভাগ্যে নেই, সে আমৃত্যু আক্ষেপ করলেও, আফসোস করলেও লাভ করতে পারবে না। এতে পেরেশানি আর হাহাকার ছাড়া আর কিছুই অর্জন হবে না। ফল কথা, তাকদীরের বিশ্বাসকে ধারণ করার অর্থই হল, সে অল্পেতুষ্ট হবে।
কোন ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টি জরুরী?
আগের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে, ইসলাম অল্পেতুষ্টির যে শিক্ষা দেয় তার ক্ষেত্র হচ্ছে দুনিয়ার বৈষয়িক বিষয়। অপরদিকে পরকালীন ও দ্বীনি বিষয়ে, ইবাদত ও আমলে সালেহ বা ভালো কাজের ক্ষেত্রে ইসলামী নির্দেশনা হল, বেশির চেয়ে বেশি আমল করা কাংখিত। এক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির সুযোগ নেই। কিছু আমল ইবাদত করে তুষ্ট হয়ে যাওয়া বা ক্ষ্যান্ত হওয়া কখনোই কাম্য নয়। কেন? কারণ পরকাল ও আমল ইবাদত শুধুই কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে। এজন্য ইসলাম এসকল ক্ষেত্রে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগীতা করার নির্দেশ দিয়েছে।
وَسَارِعُوۤا۟ إِلَىٰ مَغۡفِرَةࣲ مِّن رَّبِّكُمۡ وَجَنَّةٍ عَرۡضُهَا ٱلسَّمَـٰوَ ٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ أُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِینَ ١٣٣ آل عمران
আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও এমন উদ্যানের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার ব্যাপ্তি আকাশমন্ডলি ও জমিনের ব্যাপ্তির সমান। যা পরহেযগারদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩৩)
وَفِی ذَ ٰلِكَ فَلۡیَتَنَافَسِ ٱلۡمُتَنَـٰفِسُونَ ٢٦ المطففين
আর এক্ষেত্রে যেন প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করে। (আল মুতাফফিফিনঃ ২৬)
ফলকথা, অল্পেতুষ্টির ক্ষেত্র এই দুনিয়ার জীবন ও জাগতিক বিষয় আশয়। পরকাল ও আমল ইবাদত নয়।
ধন সম্পদ উপার্জন করা কি অল্পেতুষ্টির পরিপন্থি?
ধন সম্পদ উপার্জন করা বা ব্যবসা বানিজ্য প্রসারিত করা, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্ল্যান পরিকল্পনা করা এগুলো অল্পেতুষ্টির সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কেন সাংঘর্ষিক নয়, এটি একটু ব্যাখ্যা করে বলা দরকার।
কুর আনে কারীমে আল্লাহ তায়ালা সম্পদকে মানুষের জীবন ধারণের উপকরণ বা অবলম্বন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সূরা নিসায় বলেছেন,
وَلَا تُؤۡتُوا۟ ٱلسُّفَهَاۤءَ أَمۡوَ ٰلَكُمُ ٱلَّتِی جَعَلَ ٱللَّهُ لَكُمۡ قِیَـٰمࣰا
তোমাদের যে সম্পদকে আল্লাহ জীবন ধারণের অবলম্বন বানিয়েছেন তা তোমরা নির্বোধদেরকে দিবে না। (আয়াতঃ ৫) অপর স্থানে সম্পদকে ফাদলুল্লাহ বা আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমনিভাবে নবীজি সম্পদের ব্যাপারে যেসকল হাকীকত তুলে ধরেছেন তার মধ্যে একটি হল,
فمَن أخَذَهُ بحَقِّهِ، ووَضَعَهُ في حَقِّهِ، فَنِعْمَ المَعُونَةُ هُوَ،
যে ব্যক্তি এ সম্পদকে যথাযথ পন্থায় (হালাল্ভাবে) গ্রহণ করবে, যথাযথ খাতে ব্যয় করবে, (হালাল খাতে ব্যয় করবে, অপচয় থেকে বেচে থাকবে), সম্পদ তার জন্য কত উত্তম সহায়ক! (মুসলিমঃ ১০৫২)
মূলত সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে তাতে মন্দ ও অকল্যাণের কিছু নেই। এক, হালাল পন্থা অবলম্বন করা। দুই, সম্পদ উপার্জনে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষা করা। অর্থাৎ সম্পদ উপার্জনে এত বেশি মগ্ন হবে না যে অন্যের হক ক্ষুণ্ণ করে ফেলে। স্ত্রী ও সন্তানদের অধিকার দিতে ব্যররথ হয়ে যায়। বা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করার সময় পায় না। কিংবা দ্বীনি বিধান পালনে, যাকাত হজ ইত্যাদি আদায়ে উদাসীনতা চলে আসে। এমন ভারসাম্যহীনতা থেকে বাঁচতে হবে।
এভাবে কেউ যখন সম্পদ অর্জন করবে, তখন সেটা নিন্দনীয় হবে না। আমরা শুরুতে বলে এসেছি, অল্পেতুষ্টি মানে আল্লাহ তায়ালা কারো ভাগ্যে যা নির্ধারণ করে রেখছেন, চেষ্টা সাধনা করার পর যা সে লাভ করল তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। আর সম্পদ উপার্জন ও তার জন্য প্ল্যান পরিকল্পনা তো সে চেষ্টারই অংশ। ফলে প্ল্যান পরিকল্পনা করার পর যে সম্পদ তার হাতে আসল সে তাই নিয়ে তুষ্ট থাকবে। এটাই তার জন্য অল্পেতুষ্টি হবে।
অল্পেতুষ্টির ফলাফল বা প্রাপ্তি
একজন মুসলিম যখন এই অল্পেতুষ্টির গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করেন, তখন এর মধ্য দিয়ে তিনি বহু কল্যাণ ও উত্তম বিষয় লাভ করেন। হাদীস শরীফে এর বিষদ বিবরণ এসেছে।
- অল্পেতুষ্টির অন্যতম ফলাফল হচ্ছে, এর দ্বারা একজন মানুষ মানসিক প্রশান্তি ও শান্তিপূর্ণ জীবন লাভ করে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ارْضَ بما قسم اللهُ لك تَكُنْ أغْنى الناسِ.
হে আদম সন্তান, আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তুমি তা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। এতে তুমি সবচে ধনী মানুষে পরিণত হবে। (তিরমিযিঃ ২৩০৫)
হাদীসে যে ধনাঢ্যতার কথা বলা হল, এর ব্যখ্যা আরেকটি হাদীসে পাওয়া যায়। আমরা ধনাঢ্যতা বলতে সাধারণত বুঝি কারো কাছে প্রচুর টাকা পয়সা ও ধন সম্পদ থাকা। কিন্তু হাদীসে নবীজি প্রচলিত ধনাঢ্যতার বাইরে আরেকটি স্বরূপ ও পরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন,
ليسَ الغِنى عن كَثْرَةِ العَرَضِ، ولَكِنَّ الغِنى غِنى النَّفْسِ
বেশি আসবাব উপকরণ থাকা প্রকৃত ধনাঢ্যতা নয়, আসল ধনাঢ্যতা হচ্ছে, অন্তরের ধনাঢ্যতা। সহি বুখারিঃ ৬৪৪৬
এর মানে হল, একজন ব্যক্তির কাছে অনেক টাকা পয়সা আছে, কিন্তু তিনি এতে তুষ্ট নন। তার আরো টাকা পয়সার চাহিদা আছে। তাহলে তার মধ্যে অভাব ও অনটন আছে।
অপরদিকে কারো কাছে সামান্য ধন সম্পদ আছে। তিনি তাতেই সন্তুষ্ট, এরচেয়ে বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার নেই। তার মানে তার মধ্যে কোন অভাব নেই।
ফলে যার মধ্যে সম্পদ থাকার পরও অভাব আছে, তিনি ধনী নন। অপর দিকে যার কাছে সামান্য সম্পদ থাকলেও তিনি অভাব থেকে মুক্ত, তিনিই প্রকৃত ধনী। এই হল হাদীসের মর্মকথা।
সারকথা হচ্ছে, যে ব্যক্তি অল্পেতুষ্টির গুণ অর্জন করবে, সে আত্মিক ধনাঢ্যতা অর্জন করবে। অভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্থীর ও শান্ত জীবন লাভ করতে সক্ষম হবে।
- মুসলিম হিসেবে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করা। তার অগণন নেয়ামত অনুগ্রহের কারণে কৃতজ্ঞতায় নত নম্র হওয়া। “আর তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তোমরা তা গুনতে পারবে না। সুরা আন নাহলঃ ১৮
আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার অন্যতম উপায় হল, অল্পেতুষ্টির গুণে নিজেকে গুণান্বিত করা। নবীজি আবু হুরায়রা রাঃ কে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন,
وكن قنعا تكن أشكر الناس
তুমি অল্পেতুষ্ট হও, এতে সবচে কৃতজ্ঞ মানুষে পরিণত হতে পারবে। (তাবারানিকৃত মুসনাদ আশ শামিয়্যিয়ীনঃ ৩৮৫)
আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতার সাথেসাথে মানুষে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশও জরুরি। পরিবারে সমাজে বসবাস করতে গিয়ে আমরা একে অন্যের সাথে নানান সূত্রে যুক্ত হই। একে অন্যের প্রতি অনেক অনুগ্রহ করে থাকি। এক্ষেত্রে পারষ্পরিক কৃতজ্ঞতাবোধ অত্যন্ত জরুরি। নবীজি বলেন, যে মানুষের কৃতজ্ঞতা করল না, সে যেন আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা করল না। (তিরমিযিঃ ১৯৫৫)
মানুষের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও এই অল্পেতুষ্টির গুণ বড় ভূমিকা পালন করে।
- অল্পেতুষ্টি একজন মানুষের সফলতার অন্যতম মাধ্যম। নবীজি বলেছেন,
قد أفلح من أسلم ورزق كفافا وقنعه الله بما آتاه.
যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করল, প্রয়োজন পরিমাণ রিজিক প্রাপ্ত হল, এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন এর প্রতি তাকে সন্তুষ্ট করে দিয়েছেন, এমন ব্যক্তি সফল হয়ে গেছে। (সহি মুসলিমঃ ১০৫৪)
হাদীসের ভাষ্য পরিষ্কার। নবীজির শিক্ষা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি সফল হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় লাগে। এর মধ্যে অল্পেতুষ্টি অন্যতম বিষয়।
- অল্পেতুষ্টি আল্লাহ তায়ালা ও মানুষের ভালোবাসা এনে দেয়। নবীজি বলেন,
ازهد في الدنيا يحبك الله وازهد فيما في أيدي الناس يحبك الناس.
দুনিয়ার ব্যাপারে নির্লিপ্ত হও আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের হাতে (যে ধন সম্পদ আছে) এসব ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত হও, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে। তাবারানির সূত্রে জামে সাগীরঃ ৯৫৪
- অল্পেতুষ্টি মানুষকে সম্মানিত করে। লাঞ্চনা ও অপমান থেকে রক্ষা করে। মুসতাদরাকে হাকেমে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে,
واعلمْ أنْ شرفَ المؤمنِ قيامُهُ بالليلِ، وعزَّهُ استغناؤهُ عنِ الناسِ
জিবরীল আঃ বলেছেন, হে মুহাম্মাদ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্বিয়ামুল লাইল বা রাত জেগে ইবাদত হচ্ছে মুমিনের মর্যাদা আর মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতা হচ্ছে তার সম্মান। জামে সাগীরঃ ৮৯
অল্পেতুষ্টি না থাকার ক্ষতি ও অকল্যাণ
আমরা লক্ষ্য করলে দেখব কারো মধ্যে অল্পেতুষ্টি না থাকা অনেক ক্ষতি ও অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। এর কয়েকটি দিক এখানে সংক্ষেপে পত্রস্থ করছি।
- কারো মধ্যে অল্পেতুষ্টির পরিবর্তে যদি লোভ ও আক্ষেপ থাকে তাহলে সে জীবনে শান্তি লাভ করতে পারবে না। সব সময় একটা অস্থীরতার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকবে। কোন ব্যক্তি যখন তার প্রাপ্ত বস্তু নিয়ে তুষ্ট হবে না, বরং যা পায় নি, তাও পেতে লালায়িত হয়ে উঠবে, তখন অশান্তির সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকবে। কেন? কারণ অপ্রাপ্তির তো শেষ নেই, কত কিছুই তো সে পায় নি। বরং যা পায় নি এমন বস্তুর সংখ্যা অগণিত। ফলে এই আক্ষেপ ও লালসারও শেষ বা সমাপ্তি নেই। এই যে বিরামহীন আক্ষেপ, এর বিবরণ নবীজি হাদীসে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
لَوْ كانَ لِابْنِ آدَمَ وادِيانِ مِن مالٍ لابْتَغى ثالِثًا، ولا يَمْلَأُ جَوْفَ ابْنِ آدَمَ إلّا التُّرابُ
আদম সন্তানের কাছে দুই উপত্যকা সম্পদ থাকলেও (সে তুষ্ট হবে না।) অবশ্যই তৃতীয় উপত্যকা সম্পদ লাভ করতে চাইবে। (এভাবে তার লালসা শেষ হবে না) যতক্ষণ না (কবরের) মাটি তার পেট ভরে দেয়। (সহি বুখারি; ৬৪৩৬ ও মুসলিম)
- অল্পেতুষ্টি না থাকলে মানুষ কৃতজ্ঞ হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করতে ব্যররথ হয়। সে যখন দেখে, তার চাওয়া ও আকাঙ্ক্ষা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু সে খুব কমই পাচ্ছে। তখন কৃতজ্ঞতার বদলে সে অভিযোগ পরায়ণ হয়ে উঠে। অপ্রাপ্তির ক্ষোভ তার মধ্যে দানা বাধতে থাকে। যা তার ঈমানের জন্য অত্যন্ত ভয়ানক।
এমন ব্যক্তি মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞ হতে পারে না। শুধু বঞ্চনার অভিযোগ করে বেড়ায়। যা কিছুতেই কোন মুমিনের জন্য শোভা পায় না।
- অল্পেতুষ্টি না থাকলে মানুষ হারামের দিকে ধাবিত হয়। কোন ব্যক্তি যখন দেখবে হালাল পথে তার চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে, তখন সে হারাম পথে পা বাড়াবে। আর ইসলামের শিক্ষা হল, কোন মানুষের জীবনে হারামের প্রবেশ তাকে, দুনিয়া ও পরকালে বরবাদ করার জন্য যথেষ্ট। সে ইবাদত বন্দেগী করলেও এগুলো বিশেষ উপকার করবে না।
- অল্পেতুষ্টি না থাকার কারণে মানুষ দুনিয়া অর্জনে প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হয়। আর এই প্রতিযোগীতা তাদের ধ্বংসের কারণ। নবীজি বলেন, আল্লাহর শপথ! তোমাদের ব্যাপারে আমি দারিদ্রের ভয় করি না। আমি ভয় করি পূর্ববর্তিদের মতো তোমাদের জাগতিক প্রাচুর্্য্য দেয়া হবে। তারপর তোমরা দুনিয়া অর্জনে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে। যেমন আগের যমানার লোকজন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। ফলে তাদের মত দুনিয়া তোমাদেরকেও ধ্বংস করে ফেলবে। সহি বোখারিঃ ৩১৫৮
কিভাবে অর্জন করবো অল্পেতুষ্টির গুণ?
এই অল্পেতুষ্টি অর্জন করা বিশেষ তিনটি মাধ্যমের কথা বলেই এই প্রসংগের ইতি টানছি।
- বৈষয়িক ক্ষেত্রে যারা আমার চেয়ে নিচের স্তরে আছে, তাদের প্রতি তাকাবো। যারা ভালো অবস্থানে বা উপরের স্তরে আছে তাদের দিকে তাকাবো না। এর মাধ্যমে অল্পেতুষ্টির গুণ অর্জন করা সম্ভব। নবীজি বলেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ – رضي الله عنه – قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم: «انْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ, وَلَا تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ, فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لَا تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ».
(পার্থিব ব্যাপারে) তুমি তোমার চেয়ে দুর্বলের উপর দৃষ্টি রাখবে, কিন্তু যে ব্যক্তি তোমার চেয়ে উঁচু তার উপর দৃষ্টি রাখবে না। এরূপ করলে তুমি আল্লাহ প্রদত্ত তোমার নি’আমাতের প্রতি অবহেলা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করার অপরাধ হতে বেঁচে যাবে। সহি মুসলিমঃ ২৯৬৩
- আল্লাহ তায়ালার নিকট অল্পেতুষ্টির গুণ অর্জনের জন্য দোয়া করা। দেখুন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তম আখলাকের সর্বোচ্চ আসনে অধীষ্ট ছিলেন। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এ ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও নবীজি আল্লাহ তায়ালার নিকট অল্পেতুষ্টি লাভ করার জন্য দোয়া করতেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি এই দোয়া করতেন,
كان ابنُ عباسٍ يقولُ اللهم قنِّعْني بما رزقْتني، و بارِكْ لي فيه، و اخلُفْ عليَّ كلَّ غائبةٍ بخيرٍ.
হে আল্লাহ আমাকে যে রিযিক দিয়েছেন এর প্রতি আমাকে তুষ্ট করুন। এতে আমার জন্য বরকত দিন। এবং আমার অনুপস্থিতে সকল ক্ষেত্রে উত্তম অভিভাবক হোন। আল আদাবুল মুফরাদঃ
- অল্পেতুষ্টির পরিচয়, গুরুত্ব, এর কল্যাণ ও ফলাফল সম্পর্কে অধিক চিন্তা ভাবনা করা। এমনিভাবে অল্পেতুষ্টি না থাকার ক্ষতি ও অকল্যাণ নিয়ে ভাবা। এটিও অল্পেতুষ্টির গুণ ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে অল্পেতুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দিন। আমীন।
(সৌজন্যে, মাসিক নেয়ামত)