সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (দ্বীনি) জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ। (সুনান ইবনে মাজাহঃ ২২৪)
হাদীসে ব্যবহৃত একটি শব্দ হচ্ছে, মুসলিম। মুসলিম মানে, যিনি নিজেকে, নিজের পুরো সত্ত্বাকে জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার কাছে সঁপে দিয়েছেন। তার ইচ্ছা ও আকাংখাকে পরম করুণাময় মহাজ্ঞানী প্রজ্ঞাময় সত্ত্বার কাছে সমর্পণ করেছেন পূর্ণাঙ্গভাবে। যার ফলাফল দাঁড়ায় এই- তিনি আল্লাহ তায়ালা যে বিধান ও নির্দেশনা দিবেন, সর্বান্তকরণে তা মেনে নিবেন এবং পালন করবেন।
আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির ইহকালীন ও পরকালীন সার্বিক কল্যাণ সাফল্য ও মুক্তির জন্য নবীজির মাধ্যমে বিভিন্ন বিধান ও নির্দেশনা দিয়েছেন। এই বিধানগুলো কুরআন ও হাদীস আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। একজন মুসলিম, তিনি যে-ই হোন, পুরুষ বা নারী, যুবক বা বৃদ্ধ, ধনী বা গরীব, শিক্ষাপ্রাপ্ত বা নিরক্ষর, শাসক বা শাসিত, যেহেতু তিনি মুসলিম, তাই তার জন্য এই বিধানগুলো মানা ও পালন করা আবশ্যক। তবে এই মানা ও পালন করার পূর্ব শর্ত হচ্ছে, বিধান ও নির্দেশনাগুলো জানা। এজন্য হাদীসে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ বা আবশ্যক। ফলে মুসলিম মাত্রই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে হবে। মুসলিম জীবনে অজ্ঞতার কোন স্থান নেই।
এই যে হাদীসে ফরজ বা আবশ্যক শব্দটি বলা হয়েছে, এটাও কিছুটা স্পষ্ট করা আবশ্যক। রমজান মাস এলে সবাই রোজা রাখে। কেন? কারণ রোজা রাখা আল্লাহ তায়ালার বিধান। এটি ফরজ বা আবশ্যিক বিধান। কেউ রোজা ভাঙ্গে না। কারণ ইচ্ছাকৃত রোজা ভাঙ্গলে আল্লাহ তায়ালা শাস্তি দিবেন। তাছাড়া সমাজের মানুষও নিন্দা করবে। দ্বীনের জ্ঞান অর্জন ফরজ হওয়ার মর্মও এটি। এই বিধানটি পালন না করলে আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তি। কিন্তু আফসোসের কথা হচ্ছে, নামাজ রোজা বা জুমার নামাজের ক্ষেত্রে ফরজের যে গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করে থাকি, এবং এগুলো পালন না করাকে ব্যাপকভাবে নিন্দনীয় মনে করি, আবশ্যিক পরিমাণ ইসলামি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা তা করি না! অথচ নামাজ রোজা যাকাত হজ যে বিধানের কথাই বলি, এ বিষয়ক জ্ঞান অর্জন ছাড়া সঠিকভাবে ইবাদতগুলো পালনের কথা ভাবাই যায় না!
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, কী পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ? কারণ নারী পুরুষ যুবক বৃদ্ধ সবার পক্ষে কুরআন হাদীসের বিস্তৃত ও বিশাল জ্ঞান ভান্ডার আয়াত্ব করা এবং গভীর পান্ডিত্য অর্জন করে আমল করা প্রায় অসম্ভব কাজ। এজন্য ইসলাম জ্ঞান অর্জনের দুটি স্তর নির্ধারণ করে দিয়েছে। এক—ফরজে আইন পরিমান জ্ঞান। দুই—ফরজে কেফায়া পরিমান জ্ঞান।
ফরজে আইন কথাটির অর্থ হচ্ছে, সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নারী পুরুষ সকলের জন্য যে বিধান পালন করা জরুরি। যেমন প্রতিদিনি নামাজ আদায় করা। রমজান মাসে রোজা রাখা।
আর ফরজে কিফায়া কথাটির মানে হল, এমন বিধান যা প্রয়োজন পরিমান মুসলিম আদায় করলে অন্যান্যরা দায়িত্ব থেকে মুক্তি পায়। যেমন জানাজার নামাজ, কাফন দাফন। কোন মুসলিম মারা গেলে মুসলিমদের দায়িত্ব হচ্ছে, জানাজার নামাজ আদায় করে তার দাফন করা। সমাজের কিছু মানুষ যদি একাজটি করে তাহলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই যদি জানাজা ও দাফনকাফনে এগিয়ে না আসে, তাহলে প্রত্যেকেই ফরজ বিধান লঙ্ঘন করার কারণে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে। কিন্তু ফরজে আইন বিধান এর বিপরিত। সবাইকে এটি পালন করতে হয় স্বতন্ত্রভাবে।
এই বিশ্লেষণের পর প্রসঙ্গ আসে, কতটুকু পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করা ফরযে আইন? এ বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য হচ্ছে, একজন মুসলিমকে দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের যেসকল বিধান পালন করতে হয়, সেই বিধানগুলো সহীহ শুদ্ধভাবে পালন করতে পারে, এই পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করা ফরজে আইন। যেমন—১। আকীদা বিশ্বাসের মৌলিক বিষয় তথা ঈমান, তাওহিদ, রিসালাত, আখেরাত প্রভৃতি ২। অজু-গোসল, পাক-নাপাক, ও অপবিত্র জিনিষ পবিত্র করার বিধান ৩। নামাজ আদায়ের পূর্ণাংগ নিয়ম, প্রয়োজনীয় মাসায়েল, সহি শুদ্ধ করে অন্তত কয়েকটি সুরা মুখস্থ করা ৪। রমজানের রোজা রাখার পদ্ধতি ও অন্যান্য আবশ্যিক বিধান ৫। যদি সম্পদ থাকে তাহলে যাকাত, সাদকাতুল ফিতর, হজ ও কুরবানির বিধান, কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে এগুলো আবশ্যক হয়, কাদেরকে দেয়া যাবে ইত্যাদি বিষয় ৬। হজ ফরজ হলে হজ আদায় করার পূর্ণাংগ বিবরণ ও বিধানাবলি ৭। কেনা বেচা ও লেনদের প্রাথমিক জ্ঞান আর ব্যবসা বানিজ্যের সাথে জড়িত হলে এ সংশ্লিষ্ট বিস্তারিত বিধানাবলি ৮। বাবা মা ও নিকটাত্মীয়ের অধিকার ৯। বিয়ে করার সময় বিয়ে, স্ত্রীর অধিকার ও ভরণপোষণ ও তালাকের বিধানাবলি ১০। পানাহার ও পোষাকের ক্ষেত্রে বৈধ অবৈধ ১১। অন্তরের উত্তমগুণাবলি যেমন বিনয়, সহনশীলতা, এবং মন্দগুণাবলি যেমন হিংসা, অহংকার প্রভৃতির পরিচয় জানা।
এ স্তরের জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ ও আবশ্যক। আর কুরআন হাদীসের বিষদ বিস্তারিত ও গভীর জ্ঞান অর্জন করা ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ মুসলিমদের মধ্য থেকে যথেষ্ট পরিমান ব্যক্তিগণ যদি এস্তরের জ্ঞান অর্জন করেন, তাহলে অন্যান্যরা দায়িত্বমুক্ত হবেন। এদের কাজ হচ্ছে ইসলামি জ্ঞানের হেফাজত করা, সাধারণ মুসলিম যারা নিজেরা গভীর জ্ঞান অর্জন করেনি, তাদের ধর্মীয় সমস্যার সমাধান দেয়া। যুগে যুগে ইসলামের মহান ফকীহ, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও আলেমগণ মূলত এ দায়িত্বটি পালন করে আসছেন। জ্ঞান অর্জনের এই দুই স্তরের বর্ণনা কুরআন হাদীসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরা তাওবার একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাদের প্রতিটি বড় দল থেকে কেন ক্ষুদ্র একটি দল বের হয় না! যাতে ক্ষুদ্র দলটি দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং যখন তারা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরবে তখন তাদেরকে (ধর্মীয় বিষয়ে) সতর্ক করবে, যাতে তারা সচেতন হয়! (সুরা তাওবাঃ ১২২)
আয়াত থেকে অনেকগুলো বিষয় প্রমাণিত হয়। একটি বিষয় হচ্ছে, যারা দীনের গভীর ও বিস্তারিত জ্ঞান জ্ঞান অর্জনের জন্য বের হবে না, বরং নিজেদের বিভিন্ন কাজ কর্ম বানিজ্য ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকাকে বেছে নিবে, তারা ফরজে আইন পরিমাণ জ্ঞান গ্রহণ করবে সরাসরি আলেম ও ধর্মীয় জ্ঞানে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। সরাসরি আলেমদের থেকে দীনি জ্ঞান অর্জন করা অনেক কারণে জরুরি। এর অন্যতম কারণ এটিও যে, নবীজির যুগ থেকে শত শত বছর ধরে এই ধারাটিই স্বীকৃত ছিল এবং এখনো আছে।
যদি কারো পক্ষে কোন কারণে সরাসরি আলেমদের থেকে দীনি জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব না হয়ে উঠে, তাহলে বিশ্বস্ত আস্থাভাজন আলেমদের থেকে নির্ভরযোগ্য দীনি বই পুস্তকের নাম জেনে নিবে। তারপর নিয়ম মাফিক অধ্যয়ন করতে থাকবে। যদি কোথাও স্পষ্টতা তৈরি হয় তাহলে চিহ্নিত করে আলেমদের থেকে সমাধান করে নিতে হবে।
একটা ধারণা তৈরির জন্য খুব সংক্ষেপে কয়েকটি বইয়ের নাম লিখছি। ১। কুরআনের অনুবাদ ও ব্যখ্যার জন্য—তাওজিহুল কুরআন (মুফতি তকি উসমানি) কিংবা তাফসিরে উসমানি (রাহনুমা প্রকাশনি) ২। হাদীস ও ব্যখ্যার জন্য—মাআরিফুল হাদীস (এমদাদিয়া লাইব্রেরি) অথবা রিয়াযুস সালেহিন (মাকতাবাতুল আশরাফ) ৩। আকীদার জন্য – আকীদার মর্মকথা মাওঃ সামিরুদ্দিন ৪। মাসআলার জন্য—বেহেশতি জেওর ১-৪ খন্ড (মাওঃ শামসুল হক ফরিদপুরি বা আহমদ মায়মুন অনূদিত), অথবা আহকামে যিন্দেগি মাওঃ হেমায়েত উদ্দিন, হালাল হারাম মাওঃ খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানি ৫। নবীজির সীরাত জানার জন্য—সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া, নবীয়ে রহমত, আর রাহিকুল মাখতুম কিংবা আসাহহুস সিয়ার (এমদাদিয়া লাইব্রেরি) ৬। আত্মশুদ্ধি ও উত্তম আখলাকের জন্য—কসদুস সাবিল থানভী রহঃ বা উত্তম চরিত্র মুফতি তকি উসমানি।
আর ইসলাম সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণার জন্য নিচের একটি বা একাধিক বই পাঠ করতে পারি। ইসলাম ও মুসলমানদের পরিচয়, বা ইসলাম একমাত্র জীবন বিধান—মঞ্জুর নোমানি। দস্তুরে হায়াত বা ইসলামি জীবন পদ্ধতি—আবুল হাসান আলী নদভী। হায়াতুল মুসলিমীন বা তালিমুদ্দিন – আশ্রাফ আলী থানভী। ইসলাম পরিচয়—ডঃ হামিদুল্লাহ। ইসলামকে জানতে হলে—আবু তাহের মিছবাহ।
