পৃথিবীতে মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়তই হবে একমাত্র সিদ্ধান্তদাতা এবং সকল কিছুই পরিচালিত হবে এর তত্তাবধান ও দিকনির্দেশনায়—একে বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে বলতে গেলে সাধারণ একজন মুসলমানও বিরক্তি বোধ করবেন। কারণ, এটি নিতান্ত স্থিরকৃত ও অকাট্য বিষয়। মুসলমান মাত্রই এ ব্যাপারে অবগত আছেন। আরো মুশকিল হলো সুস্পষ্ট কোন বিষয়কে যখন ব্যাখ্যা করে বুঝাইতে যাওয়া হয়, তখন তা মাথার উপর জ্বলজ্যান্ত সূর্যকে রেখে বিবরণ দিয়ে সূর্য চিনানোর মত জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমানে আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যখন আমাদের চিন্তারা বিবর্তিত হচ্ছে এবং সুস্পষ্ট বিষয়গুলোও নানা রকমের হিনমন্য চিন্তার অভিঘাত ও বিচিত্র ব্যাখ্যায় এইসব সূর্যসম স্পষ্ট বিষয়গুলোও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে। এ জন্য শুরুতে এ বিষয়টিতে সামান্য আলোকপাত করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
একজন মুমিনের ঈমানদার হওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা ও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণকে মেনে নেওয়া, শরীয়তের পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করা; সকল বিষয়ে শরীয়তকে বিচারক মানা এবং শরীয়ত বিরোধী সকল কিছুকে পরিত্যাগ করা একান্ত আবশ্যক। এর সূত্রে কুরআনুল কারীমে অনেকগুলো আয়াত রয়েছে। দীর্ঘ হওয়ার ভয়ে তা উল্লেখ করছি না। এ বিষয়টিতে কোন কালে একজন ইসলামিক স্কলারেরও দ্বিমত ছিল না।
মানুষের জীবনে স্বচ্ছন্দ ও সক্ষমতা যেমন থাকে, তেমনি সংকট ও অক্ষমতাও থাকে। ফলে ইসলামি শরীয়ত উভয় অবস্থার জন্যই বিস্তৃত স্পেস তৈরী করে দিয়েছে, যেন আমাদের জীবন কোথাও গিয়ে থমকে না দাঁড়ায়। সেই সংকট ও দুর্যোগে কোন সিদ্ধান্ত নিলে শরীয়তের নির্দেশনা নিয়েই নিতে হবে, যেখানে শরীয়ত সমুজ্জ্বল থাকবে। পরিস্থিতি ও বাস্তবতার দোহাই দিয়ে শরীয়ত অসমর্থিত কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না এবং এমন কোন কর্মপন্থা অবলম্বন করা যাবে না, যেখানে শরীয়ত গোন হয় বা বিলকুল অস্তিত্বহীন হয়ে মূল লক্ষ্য থেকে সরে যায়। সংক্ষেপে বললে, স্বাচ্ছন্দে বা সংকটে একজন মুসলমানের সামগ্রিক কর্মচাঞ্চল্যের মূল লক্ষ্য থাকবে শরীয়তকে বাস্তবায়ন করা।
দুই.
ইসলামের ইতিহাসে পরিপূর্ণ ইনসাফের শাসনের কাল শেষ হওয়ার পর প্রলম্বিত একটা সময় এমন গেছে যখন শাসনকার্যে শরীয়তকে ফলো করতে গিয়ে শাসকগণ দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছেন। তবুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানা হয়েছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির অনুসরণও করা হয়েছে। কিন্তু শাসনের কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে শরীয়ত সবসময় উপস্থিত ছিল। এরপর মুসলিম কান্ট্রিগুলোর দিকে ধেয়ে এলো সাম্রাজ্যবাদ। মুসলিম জাতি তখন নানা দিক দিয়ে অচেতন ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। ফলে, সাম্রাজ্যবাদের শক্তি বারুদ দিয়ে, জাগতিক উন্নতি ও চিন্তার চাকচিক্য দিয়ে নিজেদের সভ্যতা ও দর্শনকে মুসলিম মানসে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। এর অন্যতম হলো লিবারালিজম, সেক্যুলারিজম ও এ উভয়ের কোলে প্রতিপালিত ডেমোক্রেসি। একসময় সাম্রাজ্যবাদ অন্তর্হিত হয়েছে ঠিক, কিন্তু এই লেজটি তারা ফেলে রেখে গেছে। ফলে মুসলিম সমাজে ধর্মবোধটি দুর্বল হতে হতে বিশ্বব্যাপী মুসলিম মানস অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয় এক দীনহীনতার ব্যধিতে প্রবেশ করলো। এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করার জন্য ইসলামি দেশগুলোতে বিভিন্ন ইসলামিক মুভমেন্ট গড়ে উঠলো, যাদের লক্ষ্য হলো পশ্চিমা প্রজেক্টগুলোকে খারিজ করে দিয়ে পূর্ণরূপে শরীয়তকে বাস্তবায়ন করা। এ কাজ করতে গিয়ে তারা একটি উভয়সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। একদিকে বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচার শাসকদের দ্বারা প্রবলভাবে প্রতিহত হয়েছেন, অপরদিকে সেক্যুলারিজম ও লিবারালিজম দ্বারা প্রভাবিত বুদ্ধিজীবি, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষিতশ্রেণী ও জনগণের দ্বারা কোনঠাসা হয়েছেন। ফলে, কোন পক্ষের সামনেই নিজেদের চিন্তাকেন্দ্র ও মূল লক্ষ্যটি প্রকাশিত করে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন দলগুলো নানা রকম কোশলের আশ্রয় নিয়েছেন, যার অন্যতম দুটি কোশল হলো অবমুক্তি ও স্বাধীনতা-চেতনা, অপরটি হলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থায় প্রবেশ করা। সেক্যুলারিজম ও লিবারালিজম প্রতিষ্ঠায় এ দুটোর অবদান সবচেয়ে বেশি। সামনে আমরা দেখব এ দুই জাদুর লাঠি কীভাবে ইসলামি আন্দোলনগুলোকে বিবর্তিত করে পুরোপুরি খোলনলচে পাল্টে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক চেহারা দিয়ে বসেছে। এ নিবন্ধে শুধু ‘স্বাধীনতা’র বিষয়টি আলোচিত হবে। ডেমোক্রেসির বিষয়টি আলোচনায় আসবে পরবর্তী লেখায়।
তিন.
স্বাধীনতা : এই শব্দের উচ্চারণে একদিকে যেমন আমাদের বিবেক ও মস্তিষ্ক উৎফুল্ল হয়ে উঠে, অপরদিকে মানুষের ভেতরকার সুপ্ত কুপ্রবৃত্তি বিদ্যুতায়িত হয়ে আকুল হয়ে পড়ে। ফলে, মানুষ মাত্রই স্বাধীনতার প্রত্যাশী ও পিয়াসী। কিন্তু পশ্চিমা চিন্তায় এর সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নাই, কোন আকার ও সুনির্দিষ্টতা নাই। বহুমাত্রিক বিচিত্র মর্মের আধার অনুপম ও কুটিল একটি শব্দ এই স্বাধীনতা। প্রত্যেকে নিজের মত করে একে ব্যাখ্যা করেছে এবং নিজেদের স্বার্থে একে ব্যবহার করেছে। ফলে, দেখা যায় ফ্রান্স বিপ্লবের সময়ে, মুসিলিনি ও হিটলারের সময়ে, কমিউনিস্ট শাসনের কালে, এবং আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে নিপীড়ন চালিয়েছে এই ‘স্বাধীনতা’ গড়ে তোলার নাম দিয়েই। ফলে, স্বাধীনতাকে এমন বন্ধনী ও ব্যাখ্যাহীন স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া যুক্তি ও বিবেক বিরোধী। এই স্বাধীনতা মানবতার পক্ষে যায় না। এ জন্য শরীয়ত একদিকে যেমন স্বাধীনতাকে মানুষের জন্য কল্যানকর ও স্বভাবজাত বিষয় বলে স্বীকৃতি দিয়ে একে নিশ্চিত করার জন্য রোডম্যাপ দিয়েছে, অপরদিকে একে ব্যাখ্যা করে সুনির্দিষ্ট বন্ধনীও দিয়েছে, সেই আদমের সময় থেকেই, যখন তাকে বলা হলো জান্নাতে তুমি স্বাধীন, কিন্তু এই গাছের কাছে যেতে পারবে না।
ইসলামি দলগুলো যখন কাজ করতে এসে স্বৈরশাসকদের দ্বারা প্রতিহত হলো, তখন মূল লক্ষ্যে পোঁছার জন্য আওয়াজ উঠালো—শরীয়ত বাস্তবায়ন নয়, আমরা স্বাধীনতা চাই। কারণ, শরীয়ত বাস্তবায়নের জন্য আগে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দরকার, ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকে প্রতিহত করে ইসলামি অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্য আগে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাই। বাকস্বাধীনতা চাই; কারণ, বাকপরাধীনতার মাধ্যমেই ইসলামপন্থিদের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বিশ্বাসের স্বাধীনতা চাই, কারণ, সেক্যু-প্রভাবিত সমাজে নিজেদের বিশ্বাস প্রচার করতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই। খুব স্বাভাবিক যে, এমন পরিস্থিতিতে ইসলামি ব্যাখ্যাযুক্ত স্বাধীনতার কথা বললে এর জন্য বিস্তর সংগ্রাম ও কুরবানি করতে হবে, তাই পরিস্থিতি ও বাস্তবতার কথা বলে এখানে পশ্চিমা বন্ধনীহীন উন্মুক্ত স্বাধীনতাকেই চর্চা করা হয়েছে। এবং শুরুর দিকে তা স্বৈরশাসন ও পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিজেদের জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরীর মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হলেও একসময় গিয়ে একে মাকাসিদে শরীয়াহ এর অন্তর্ভুক্ত বলা শুরু হলো এবং এক পর্যায়ে গিয়ে এটি মূল উদ্দেশ্যে পরিণত হয়ে এর সামনে নানা দিক থেকে শরীয়াহ উপেক্ষিত হতে লাগলো। এর কারণও ছিল। খুবই ছোট্ট ও সীমিত পরিসরে একটা বিষয়ে দ্বৈত অবস্থান গ্রহণ করা যায়। কিন্তু বিস্তৃত পরিসরে যখন ভেতরে একটা রেখে কোশলগত কারণে প্রকাশ্যে অন্যটার চর্চা হতে শুরু করে, তখন তা একসময় ভেতরে প্রবিষ্ট হয়ে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দুজন ইসলামিক স্কলারের বক্তব্য কোট করছি।
শায়খ ইউসুফ কারজাবি বলছেন : “স্বাধীনতা ছাড়া এই জাতির মুক্তি নেই। আমি এক অনুষ্ঠানে বলেছি—আমি শরীয়ত বাস্তবায়নের আগে স্বাধীনতা লাভের কথা বলি। কারণ, এটি ছাড়া শরীয়ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমি মানুষকে স্বাধীনতা দিতে চাই।”
ডক্টর তারিক সুওয়াইদান বলছেন : “আমার মতে স্বাধীনতা শরীয়তের আগে।”
আমি বলবো—মোলিকভাবে শরীয়াহ বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতা আবশ্যক নয়। স্বৈরাচারের অধীনেও শরীয়াহ বাস্তবায়ন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, সেক্যুলার ব্যাখ্যায়িত এই স্বাধীনতাকে এতো বড় করে দেখা হচ্ছে যে, এটি মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়ে স্বয়ং শরীয়াহ গোন ও দ্বিতীয় স্তরে নেমে যাচ্ছে। এবং কখনো এর সামনে শরীয়াহ পুরোপুরি উপেক্ষিতও হচ্ছে। অপরদিকে ইসলামি ব্যাখ্যার স্বাধীনতাকে গ্রহণ করলে দুটোকে আলাদা করে দেখা সম্ভব হতো না। এই স্বাধীনতা তো শরীয়াহ এর অংশ। ফলে, এখানে আগ-পরের কোন ব্যাপারই নেই। সেক্যুলার ব্যাখ্যায়িত স্বাধীনতার চর্চা করে একে যখন গড়ে তোলা হবে, তখন ইসলামি দলগুলো নিরংকুশ ক্ষমতা পাওয়ার পরও জনগণকে ইসলামি শাসন নিবে কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য স্বাধীনতা দিতে হবে। এটা তো স্পষ্টতই কুফুরি। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন : এবং আপনি তাদের মধ্যে আল্লাহর অবতীর্ণ ওহী মোতাবেক শাসন পরিচালনা করুন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। অন্য আয়াতে বলেছেন : মুমিন নর-নারীর জন্য এ সুযোগ নেই যে, আল্লাহ ও তার রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা করার পর সে বিষয়ে তাদের কোন ইচ্ছাধিকার ও স্বাধীনতা থাকবে। আর, যে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হবে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত হবে। আফসোসের বিষয় হলো—স্বয়ং পশ্চিম যেখানে বাকস্বাধীনতাসহ নানাবিধ স্বাধীনতার উপর নিজেদের সুবিধামতো বিভিন্ন বন্ধনী আরোপ করেছে, সেখানে ইসলামপন্থিগণ ইসলামি শরীয়াহ এর আলোকে বন্ধনীগুলো নিয়ে স্বাধীনতার আওয়াজ উঠাতে সমস্যা কোথায়? হিনমন্যতা ছাড়া এখানে আর কোন যুক্তি নেই।
আমার পর্যবেক্ষণমতে বাংলাদেশে ইসলামমনস্ক লোকদের মধ্যে দুই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ কেউ কোনরূপ ব্যাখ্যায় না গিয়ে নিঃশর্তভাবে ‘স্বাধীনতা’র নিন্দা করেন। অবশ্য, তাদের লক্ষ্য থাকে বর্তমান সমাজে পচলিত ও প্রায় প্রতিষ্ঠিত লাগামহীন পশ্চিমা স্বাধীনতা। এই বিরোধিতা খুবই ভালো ব্যাপার। কিন্তু, এর বিপরীতে ইসলামি ব্যাখ্যার আলোকে ‘স্বাধীনতা’ বিশ্লেষণ করে না দেখানোর কারণে এটা ভুল ম্যাসেজ তৈরী করে। অপরদিকে অনেকে সরাসরি স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তারাও শরীয়াহ এর ব্যাখ্যা হাজির করেন না। ফলে, তা পশ্চিমা স্বাধীনতার পক্ষে যায়। এবং শরীয়াহ ব্যাখ্যাযুক্ত স্বাধীনতার থিম তাদের সামনে স্পষ্ট বলেও মনে হয় না। আমাদের জন্য উচিত হবে শব্দটিকে উপযুক্ত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে চর্চা করা, এর পক্ষে আওয়াজ উঠানো এবং প্রচলিত লাগামহীন স্বাধীনতার শ্লোগানে ভেসে না গিয়ে জনপরিসরে এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী গ্রাউন্ড তৈরী করা।
(বশির ইসাম রচিত ‘আল-আলমানাতু মিনাদ্দাখিল’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে লেখাটির মূল ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে)