কুরআনের আলো পেতে যে বিষয়গুলো লাগবেই!

কুরআনে কারীম- ইহজগত ও পরকালের সার্বিক কল্যাণ লাভের একমাত্র অবলম্বন। এটি মানবজাতিকে সত্য সঠিক পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সর্বশেষ গ্রন্থ। এই মহাগ্রন্থ মানুষকে যাবতীয় অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে আসে। মানুষকে শিক্ষা দেয় বিশ্বাস, কর্ম, আদর্শ, চেতনা্র বিশুদ্ধ পাঠ। কুরআন কারীম নিজের সম্পর্কে আলোচনা করেছে, মানবজাতির কাছে স্বপরিচয় তুলে ধরেছে। সাথে সাথে এটাও স্পষ্ট করেছে যে, এই মহাগ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য, কুরআনের আলোয় নিজেকে আলোকিত করার জন্য কী কী বিষয় ধারণ করতে হবে। এই লেখায় কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য জরুরি কয়েকটি বিষয় তুলে ধরব।

  • কুরআনের বড়ত্ব ও সম্মান দ্বারা অন্তরকে আবাদ করুন

 যিনি এই মহাগ্রন্থটি থেকে নিজের জীবনে সত্যই আলো গ্রহণ করতে চান, তার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে—এ গ্রন্থের বড়ত্ব ও মর্য়াদা দিয়ে তার অন্তরটি পরিপূর্ণ থাকতে হবে। বিশ্বাসের জায়গা থেকে স্বাভাবিকভাবে সকল মুসলমানই মান্য করেন যে, কুরআন আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালাম বা কথামালা; তবে এই পবিত্র কথামালা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য অসচেতন ও অমনোযোগী বিশ্বাস যথেষ্ট নয়, বরং সে বিশ্বাসটিকে সবসময় হৃদয় ও মস্তিষ্কে জাগিয়ে রাখা একান্ত দরকার।

কুরআনে কারীমে বারবার বলা হয়েছে : “মহাগ্রন্থ এই কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।“ (সূরা ওয়াকিয়াঃ৮০, আল হাক্কাহঃ ৪৩) অর্থাৎ এটি সাধারণ কোন গ্রন্থ নয়; গুরুত্ব ও মর্য়াদায়, পবিত্রতা ও সৌন্দর্যে অনন্য ও অসাধারণ। পৃথিবীর কোন গ্রন্থের সাথে এর তূলনা হতে পারে না। একে পাঠ ও গ্রহণ করতে হবে বোধ ও উপলব্ধির সুউচ্চ জায়গা থেকে। এই গ্রন্থ ও এতে বর্ণিত সকল বিষয়ের প্রতি হৃদয়ে পূর্ণ ভক্তি, বিশ্বাস ও আস্থা লালন করলেই কেবল প্রকৃত অর্থে এ থেকে ঈমানী নুর লাভ করা যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন : আমি যদি পর্বতের উপর এই কুরআনকে অবতীর্ণ করতাম, তাহলে তুমি দেখতে আল্লাহর ভয়ে সে পর্বত নত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে (হাশর : ১২) অর্থাৎ কুরআনুল কারীম যার গুন, সে আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্য়াদা এত বিপুল যে, কোন পাহাড়ের উপর একে অবতীর্ণ করলে, সেই কথকের শক্তি ও মর্য়াদার প্রভাবে পাহাড়টি নত হয়ে দেবে যেত এবং ভয় পেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হত। কুরআনের প্রতি গভীর এই শ্রদ্ধাবোধের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, কুরআনে কারিমের আদব রক্ষা করা।

  • থাকতে হবে তীব্র আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা

কুর আনে কারিম থেকে উপকৃত হওয়ার অন্যতম শর্ত হল, এ মহাগ্রন্থ থেকে আলো গ্রহণ করার তীব্র বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। সঠিক পথ পাওয়ার আগ্রহ নিয়ে এর প্রতি ধাবিত হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে তাঁর দিকে অভিমুখি হয় তিনি তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। (শুরাঃ১৩) তাহলে সঠিক পথ পাওয়ার জন্য আল্লাহর প্রতি ধাবিত হওয়া জরুরি। কুরআন আল্লাহ তায়ালার কালাম, বলার অপেক্ষা রাখেনা, কুরআনের প্রতি ধাবিত হওয়া মানে আল্লাহর প্রতিই ধাবিত হওয়া।  অপরদিকে কেউ যদি এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, অথবা কারো মধ্যে যদি কুর আনের শিক্ষা দ্বারা নিজেকে আলোকিত করার আগ্রহ ও ব্যাকুলতা না থাকে, তাহলে কুর আন ঘোষণা করছে, আপনি তো মৃতদের শ্রবণ করাতে পারবেন না, বধিরকেও আপনার আহবান শোনাতে পারবে না, যখন তারা পৃষ্ট প্রদর্শণ করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সূরা নামলঃ ৮০)

  • মনোযোগসহ শ্রবণ করতে হবে কুরআনের বাণি

কুরআনে কারিম একটি মহাগ্রন্থ। তাই এ থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য এর বাণি ও নির্দেশনাগুলো মনযোগসহ শ্রবণ করার বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সুতরাং আপনি আমার সে সকল বান্দাদের সুসংবাদ দিন, যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শ্রবণ করে, তারপর এর উত্তম বিষয়ের অনুসরণ করে। এরাই সে সকল ব্যাক্তি আল্লাহ যাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। আর তারাই বুদ্ধিমান। (সূরা যুমারঃ ১৭-১৮) মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা ও উত্তম বিষয়ের অনুসরণ করা, এদুটি কাজ যারা করবে, আল্লাহ তাদের ব্যাপারে বলেছেন, এরা হেদায়েত প্রাপ্ত। তাই হেদায়েত বা সঠিক পথ পাওয়ার জন্য, কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য, শুধু কুর আনের বাণি শ্রবণ ও কুর আনের জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়। চাই কুরআনের নির্দেশণা মাফিক আমল।

  • ভয় শংকা ও উতকন্ঠাও থাকা চাই

নিজের বর্তমান অবস্থার উপর ভীত থাকা, শংকিত হওয়া—আমার কী হবে? আমি মুক্তি পাবো তো? আমি যে পথে চলেছি, এটি আমার প্রভূর পছন্দনীয় তো? এই উতকন্ঠা ও আত্মজিজ্ঞাসা কুর আন থেকে উপকৃত হওয়ার পথে সহায়ক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ভয় করে সে শীঘ্রই উপদেশ গ্রহণ করবে। (সূরা আলাঃ ১০) অতএব আপনি কুর আন দ্বারা সেই ব্যক্তিকে উপদেশ দিন, যে আমার ধমকিকে ভয় করে। (সূরা ক্বাফঃ ৪৫) তার মানে যার ভেতরে আল্লাহ তায়ালার ভয় নেই, তাঁর সামনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে যে নিশ্চিন্ত, যে নিজ জীবন ধারা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আছে, তার জন্য কোরআনের উপদেশমালা কাজ করবে না। সে কুরআনের আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারবে না।

  • অদৃশ্য জগতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন জরুরী

কিছু মানুষ আছে যারা বস্তুবাদি। পঞ্চঈন্দ্রীয় দ্বারা উপলদ্ধি করা যায় না এমন কোন বিষয়কে তারা মানে না। আবার কিছু মানুষ আছে যারা যুক্তিবাদি, আকল বুদ্ধি যে জিনিষকে ধারণ করতে পারে না, তারা এমন সবকিছুকে অস্বিকার করে থাকে। ইসলাম এই দুই শ্রেণির নিন্দা করেছে, তাদের অবস্থানকে ভুল আখ্যায়িত করেছে। ইসলাম বলে, মানুষের পঞ্চঈন্দ্রীয় ও বুদ্ধির বাইরেও অনেক বিষয় বিদ্যমান আছে। যেমন ফেরেশতা, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম, কবরের আজাব প্রভৃতি। মানুষ মহান আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত সত্য নবী রাসূলের মাধ্যমে জানতে পেরেছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করে বলেছেন, মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সূরা নিসাঃ২৮) ফলে মানুষের এই দুর্বল ইন্দ্রীয়শক্তি ও বুদ্ধির উপর নির্ভর করে সত্য সংবাদকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই।

ফল কথা, কেউ যদি বস্তুবাদ ও নিজ বুদ্ধির দাসত্ব থেকে বের না হতে পারে, বরং এদুটির নির্ভর করে অদৃশ্য জগতকে অস্বিকার করে বসে, তাহলে তার পক্ষে কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়া অসম্ভব। কেননা কুর আন মানব জাতির কাছে প্রধানত অদৃশ্য জগতের গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয় পরিবেশন করে থাকে। ফলে কুরআনের আলো পেতে হলে অদৃশ্য জগতের প্রতি বিশ্বাস জরুরি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এই গ্রন্থে কোন সন্দেহ নেই। এটি খোদাভীরুদের জন্য পথ নির্দেশক, যারা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখে। (সূরা বাকারাঃ ২-৩)

  • সাধনা ও অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই

কুরআনে কারীম উপলদ্ধি করা, সে অনুযায়ি আমল করার জন্য নিয়মমতো সাধনা করা জরুরি। এ উদ্দেশ্যে কেউ যখন পরিশ্রম করবে, কষ্ট সহ্য করবে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে কুর আনের জ্ঞান ও আলো দান করবেন। তিনি বলেন, যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে উপনীত করব। (সূরা আনকাবুতঃ ৬৯) আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবনকে আলোকিত করুন কুরআনের পবিত্র আলোয়!

সূত্র,

মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহ রচিত ‘আল মাদখাল ইলাদ দিরাসাতিল কুরআনিয়া’ (কুরআন অধ্যয়নের মূলনীতি’ অনুবাদ, মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন)

শেয়ার করুন

image_print
Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া