‘বুদ্ধিজীবী’দের ইসলাম গবেষণায় প্রাচ্যবাদী প্রভাব: উৎসের সন্ধানে

বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে কথা বলেন এমন বুদ্ধিজীবি, গবেষক, লেখক ও আলোচকদের মধ্যে মোটা দাগে দুটো ভাগ আছে। একদল ইসলামকে সরাসরি তার মূল উৎস তথা কুরআন হাদীস ফিকহ ও ইসলামের মূল ধারায় লিখিত ইতিহাস থেকে গ্রহণ করেন, নিজেরা এর চর্চা করেন এবং ইসলামের মূল উৎসের সাথে দীর্ঘ সাহচর্যের ভিতর দিয়ে এর রুচি, প্রবণতা, স্বভাব ও স্পন্দন হৃদয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। আরেকটি ধারা আছে, যারা ইসলামকে সরাসরি মূল থেকে গ্রহণ করেন না, কিংবা যারা মূল ধারায় ইসলাম নিয়ে কাজ করেন তাদের থেকেও নেন না; বরং ইসলাম সম্পর্কে অবগতি লাভ করেন কোনো দূরবর্তী উৎস থেকে।

এই দূরবর্তী উৎসসমূহের অন্যতম একটি উৎস হলো ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবিদদের বইপত্র, লেখাজোকা ও আলোচনা। ইসলাম নিয়ে তাদের গবেষণা, আলোচনা, মতামত ও মন্তব্য সকল কিছু মৌলিকভাবে প্রাচ্যবীদদের বক্তব্যের উপরই দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা একটি জরুরী বিষয়।

ওরিয়েন্টালিজম কী?
Orient: এর অর্থ হলো পূর্ব বা প্রাচ্য। ইজম মানে ভাব বা মতবাদ। ওরিয়েন্টালিজম অর্থ দাঁড়ায় প্রাচ্য নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ একটি বিশেষ মতবাদ। বাংলায় একে বলা হয় প্রাচ্যসংক্রান্ত বিদ্যা বা প্রাচ্যবাদ। এখানে প্রাচ্য দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এশিয়া অঞ্চল। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ইউরোপের তুলনায় এশিয়া অঞ্চলটি পূর্বদিকে অবস্থিত হওয়ায় মতবাদটি এই নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

সে হিসেবে প্রাচ্যবাদ মানে হলো, এশিয়ার যে কোনো অঞ্চল, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনাচার নিয়ে পশ্চিমা গবেষণা। তবে, আমরা যদি এ সংক্রান্ত প্রাচ্যবাদী পশ্চিমা গবেষণাগুলো দেখি, তাহলে স্পষ্টতই টের পাব তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো ইসলাম ও ইসলামের সুতিকাগার মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব অঞ্চল।

ইসলাম ও আরব নিয়ে বিশেষ আগ্রহের কারণ

ইসলাম ও আরব অঞ্চল নিয়ে তাদের আগ্রহের বিশেষ কিছু কারণ আছে। যেমন, জ্ঞানগত সমৃদ্ধি ও নতুন জ্ঞানের তালাশ, ভূরাজনীতি, উপনিবেশায়ন, প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, প্রধান বিপক্ষ শক্তি হিসেবে ইসলামকে জ্ঞানগতভাবে ঘায়েল করা ইত্যাদি। অনেকে গবেষণা করেছেন নিছক জ্ঞানগত কৌতুহল থেকে। কেউ কেউ এ কাজে যুক্ত হয়েছেন একনিষ্ঠতার সাথে সত্য অনুসন্ধানের অভিলাষ থেকে। শেষ দুই শ্রেণির অনেকে পরবর্তী সময়ে ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণও করেছেন। এমন বিখ্যাত দুজন ব্যক্তি হলেন দ্যা রোড টু মক্কা’র লেখক লিওপোল্ড উইস, যিনি মুহাম্মদ আসাদ নামে বিখ্যাত। আরেকজন হলেন দি অল্টারনেটিভ বইয়ের লেখক মুরাদ হফম্যান। তার পূর্বনাম ছিল ড. উইলফ্রেড হফম্যান।

প্রাচ্যবাদী রচনার অসঙ্গতি

প্রাচ্যবাদের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। ব্যক্তিগত উদ্যোগে, প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রিয় অর্থায়নে ছোট ও বড় নানান পরিসরে এই গবেষণা পরিচালিত হয়ে আসছে শত শত বছর যাবত। প্রচুর পরিমাণ অর্থ, শ্রম, মেধা ও সময় তারা এ কাজে ব্যয় করেছেন। এবং সন্দেহ নেই তাদের হাত ধরে অনেক ভালো গবেষণাকর্মও প্রস্তুত হয়েছে। তবে, ইসলাম সম্পর্কে প্রাচ্যবাদী রচনায় প্রায়শই বেশ কিছু দুর্বলতা ও অসঙ্গতি লক্ষ করা যায়। যেমন, তথ্যের ঘাটতি ও বিকৃতি, বক্তব্যের বিকৃতি ও ভুল ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত অসঙ্গতি, অর্ধসত্য বর্ণনা, আদর্শিক চিন্তা ও দর্শনকে উপেক্ষা করে ঘটনা ও বক্তব্যের অক্ষরবাদি বিশ্লেষণ ইত্যাদি।

তিনটি বিশেষ প্রবণতা

এসবের মধ্যে বিশেষ তিনটি বিষয় গুরুত্বের সাথে আলোচনার দাবি রাখে।
১.
চেরিপিকিং বা ধর্ম ও ইতিহাসের বিবরণ থেকে নিজেদের পছন্দমতো অংশটুকু ব্যবহার করে নিজেদের পূর্বপরিকল্পিত দাবি ও বিশ্লেষণকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা করা। এটা প্রাচ্যবাদি রচনার সাধারণ বৈশিষ্ট।

২.
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ধর্ম বিষয়ক ও ধর্মীয় ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত তথ্য যাচাইয়ের জন্য ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রে সাধারণ মানদণ্ডের চেয়েও সূক্ষ্ম ও শক্তিশালি মানদণ্ড গড়ে তোলা হয়েছে। হাজার বছরের সাধনায় সৃষ্টি হয়েছে রিজাল শাস্ত্র ও সূত্র যাচাই প্রক্রিয়া। প্রাচ্যবিদগণ এই মানদণ্ড উপেক্ষা করে নিজেদের সুবিধামতো সবল দুর্বল ও বানোয়াট সব ধরণের তথ্য তারা গ্রহণ করে নিজেদের বয়ান প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন। উদাহরণত ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর বিষয়টি আমরা সামনে আনতে পারি। ঔড়ংবঢ়য ঝপযধপযঃ, ঈধৎষ ইৎড়পশবষসধহহ, কধৎবহ অৎসংঃৎড়হম সহ অনেক প্রাচ্যবিদ একে সত্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অথচ সূত্র যাচাই করে এর কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না।

৩.
তৃতীয় বিষয়টি আরেকটু খুলে বর্ণনা করা দরকার। ইসলাম নিয়ে আলোচনার সময় শুরুতেই স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, এটা কি ইসলামের বিবরণ ও ব্যখ্যা? নাকি ইসলাম নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন? যদি বিবরণ ও ব্যাখ্যা হয়, তাহলে ইসলামের দার্শনিক মূল ভিত্তি তাওহিদ, রিসালাত ও ওহীকে মান্য করেই তা দাঁড় করাতে হবে। ইসলামের নাম দিয়ে নিজের মনগড়া বক্তব্য হাজির করা সঠিক নয়। সেই সাথে তা হতে হবে ইসলামী জ্ঞানশাস্ত্রে গড়ে তোলা তথ্য যাচাইয়ের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ দলীলপ্রমাণের মাধ্যমে, ইসলামের চার মৌল কুরআন হাদীস ইজমা ও কিয়াস কোনো একটির সমর্থনে।

বক্তব্য বা ঘটনার পেছন থেকে আদর্শিক এই ভিত্তি সরিয়ে ফেললে বক্তব্য ও ঘটনাগুলোর চরিত্র পাল্টে ফেলা যাবে অনায়াসে। তখন জিহাদকে বলা যাবে সন্ত্রাস, গনীমতকে অভিহিত করা যাবে সম্পদ লুন্ঠন বলে, খেলাফতকে আখ্যায়িত করা যাবে একনায়কতন্ত্রের প্রসার ও সাম্রাজ্যবাদিতা হিসেবে, দাসী বাদি সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে ঘোষণা করা যাবে জোরপূর্বক অবাধ যৌনাচার বলে, ওহীকে ব্যাখ্যা করা যাবে আধ্যাত্মিকতার বিশেষ রূপ বলে।

আমরা দেখি প্রাচ্যবিদরা এই দার্শনিক ভিত্তিকে স্বীকার না করার ফলে তাদের তৈরী ইসলামের যে ব্যাখ্যা, বা নিজেদের পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনায় ইসলামের নামে যা হাজির করেন, সেখানে এই বিকৃতির বিষয়টি খুব সহজেই ধরা পড়ে। কখনো সুস্পষ্টভাবে, কখনো সূক্ষ্মভাবে। যদিও তারা মুখে বলেন যে, তারা কোনো পক্ষপাতিত্ব না করে নির্মোহভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করছেন, কিন্তু বাস্তবে যা ঘটে তা হলো ইসলামের ব্যখ্যার নামে তারা মূলত এর আদর্শিক অবস্থানকে নাই করে দিয়ে নিজেদের পূর্বধারণাগুলোকেই হাজির করেন।

বুদ্ধিজীবীগণের উপর প্রাচ্যবাদী প্রভাবের কারণ ও ফলাফল

আমাদের দেশের বিশেষত বুদ্ধিজীবি ও জেনারেল ঘরানার লেখক গবেষকগণ আরবি না জানার কারণে, ইসলামি জ্ঞানে দখল না থাকায়, ইসলামের মূল ধারার গবেষক উলামায়ে কেরামের সাথে দূরত্বের কারণে তারা মূল উৎস থেকে ইসলামকে জানার সুযোগ পান না। অপরদিকে তাদের নিকট ইংরেজির সহজলভ্যতা, ইতিহাস দর্শন নৃতত্ত্ব চিন্তাগত উদ্ভাবন-কল্পনা ও ভূ-রাজনীতিসহ নানান কিছু মিশিয়ে তৈরী করা পশ্চিমা বয়ানকে আকর্ষণীয় মনে করার কারণে তারা প্রাচ্যবিদদের চোখে ইসলামকে বিচার করতে আগ্রহী হন। যার অনিবার্য ফলাফল হলো বুঝ ও ভাষায় বিচিত্র ভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়া। লেখক ও বুদ্ধিজীবি পর্যায়ে ইসলাম নিয়ে এই বুঝ ও ভাষার সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি দুঃখজনক অধ্যায়।

শেয়ার করুন

image_print
Picture of সাবের চৌধুরী
সাবের চৌধুরী
সাবের চৌধুরীর জন্ম হবিগঞ্জ সদরে। হিফজ সম্পন্ন করেছেন হরষপুর মাদ্রাসায়। বিবাড়িয়ার দারুল আরকাম, ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ও দারুল ফিকরে কেটেছে তার শিক্ষাজীবন। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। লেখালেখি ও সম্পাদনাও করছেন নিয়মিত। মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে জীবনে রোদ্দুরে, অটুট পাথর, কোথাও নিঝুম হয়েছে কেউ~ বেশ পাঠক প্রিয় বই।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া