মাতম মর্সিয়া বিলাপ: ইসলামে শোক পালনের পদ্ধতি কী?

মাতম একটি আরবি শব্দ। যার মূল অর্থ হলো, কোন দুঃখ বা আনন্দ উপলক্ষে কিছু মানুষ একত্রিত হওয়া। অবশ্য পরবর্তীতে দুঃখের উপলক্ষে শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কখনো শুধু দুঃখ বোঝানোর জন্যও মাতম শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এ নিবন্ধে আমরা শোক প্রকাশ, শোক পালন, মর্সিয়া ও মৃত্যু শোকে বিলাপ করা সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা ও বক্তব্য তুলে ধরবো।

  • কারো মৃত্যুতে ব্যথিত হওয়া ও কান্না করা

মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা হচ্ছে, যখন তার প্রিয়জন বা নিকটআত্মীয় মারা যায়, তখন সে ব্যথিত হয়, কষ্ট অনুভব করে। এই কষ্টের তীব্রতা যখন বেশি হয়, তখন অশ্রু ঝরে, সে কান্না করে। যেহেতু বিপদের সময় মন ব্যথিত হওয়া এবং কান্না করা স্বভাবজাত বিষয়, তাই ইসলাম এগুলোকে নিষিদ্ধ করেনি। দোজাহানের বাদশা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয়জনদের বিচ্ছেদে ব্যথিত হতেন। কখনো তার মোবারক চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হত। হজরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, নবীজির ছেলে শিশু ইব্রাহিম রা. যখন ইন্তেকাল করলেন, নবীজির দু চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিও কান্না করছেন? নবীজি বলেছিলেন, আব্দুর রহমান, এটা রহমত ও দয়া মায়ার কারণে হয়ে থাকে। এরপর বললেন, আমার অন্তর ব্যথিত হয়, চোখে অশ্রু আসে, তবে আমরা তাই বলবো যাতে আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হন, ইব্রাহিম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা সবাই ব্যথিত! (বুখারী)

প্রিয়জনদের মৃত্যু বা অন্য যে কোনো বিপদের সময় ইসলাম মানুষকে একটি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। তা হল ধৈর্য ধারণ করা। (সূরা বাকারা:১৫৫-১৫৬)

বিপদের সময় ধৈর্য ধারণ করার অর্থ হল, আল্লাহপাকের এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে কোন প্রকার অভিযোগ ও আপত্তি না করা। দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে হায় হুতাশ বা অস্থিরতা প্রকাশ না করা। উচ্চস্বরে কাঁদা, চেহারা বা শরীরের অন্য কোথাও আঘাত করা থেকে বিরত থাকা। এবং আল্লাহ তা’আলার নিকট এই বিপদের বিনিময় ও প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা।  (তাফসীরে কুরতুবী ও ইবনে কাসির)

  • বিলাপ করার বিধান কী?

প্রিয় জনের মৃত্যুর পর যে কান্না করা হয় এর তিনটি অবস্থা হতে পারে।
১. শব্দ না করে কান্না করা। অর্থাৎ শুধু অশ্রু ঝরানো।
২. উঁচু আওয়াজে কান্না করা।
৩. কান্নার সাথে সাথে মৃতব্যক্তির গুণগান করা। হায় মহাদানশীল! হায় মহাবীর! বা এজাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে চিতকার করা।

প্রথম প্রকারের কান্না সকল ফকীহ ও ইমামদের নিকট বৈধ। এর পক্ষে পূর্বে উল্লেখিত হাদীস ছাড়াও একাধিক হাদিস রয়েছে। এই কান্না ধৈর্য ধারণের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকারের কান্নার বিধান হল, শোকের সময় এ দুই প্রকার কান্না ইসলামে নিষিদ্ধ। (বাদায়েউ সসানায়ে:১/৩১০)  হাদিসের ভাষায় এ ধরনের কান্নাকে ”নিয়াহা” বলা হয়েছে। এসম্পর্কে নবীজী বলেন, মৃত ব্যক্তির জন্য নিয়াহা তথা বিলাপ করা, চিৎকার করে কান্না করা জাহেলীযুগের কাজ। বিলাপকারী নারী (পুরুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য)  মৃত্যুর পূর্বে যদি তওবা না করে তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তাকে আলকাতরা ও অগ্নিলাভার পোশাক পরিধান করাবেন। (ইবনে মাজাহ :১৫৮১)

তবে কান্নার সময় কেউ যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, অনিচ্ছায় উঁচু আওয়াজ বের হয়ে যায়, তাহলে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। তারপরও অপারগ হলে তার গুনাহ হবে না। (ফিকহি ইনসাইক্লোপিডিয়া, কুয়েত:৮/১৭২)

  • বিলাপের সময় শরীরে আঘাত করা ও কাপড় ছিড়ে ফেলা:

অনেক সময় দেখা যায় মৃত্যুশোকে বিলাপকারী সীমালঙ্ঘন করে নিজের শরীর— চেহারায়, মাথায় বা বুকে আঘাত করতে শুরু করে। আবার কখনো নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ ছিড়ে ফেলে। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো জঘন্য অপরাধ। কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনার স্পষ্ট বিরুদ্ধাচারণ।নবীজির স্পষ্ট ঘোষণা— যে ব্যক্তি মৃতের শোকে গালে চপেটাঘাত করে, জামা কাপড় ছিড়ে ফেলে অথবা জাহিলি যুগের ন্যায় হৈচৈ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (সহি বুখারী:৩১৭২)

উচ্চস্বরে বিলাপ করা, শরীরে আঘাত করা— এসব নিষিদ্ধ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হল, এই আচরণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তের ওপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়। যা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ— তাকদিরে বিশ্বাসের সাথে চরম ভাবে সাংঘর্ষিক।

  • ইসলামে অনুমোদিত শোক পালন: কে করবে, কিভাবে করবে?

ইসলামের দৃষ্টিতে শুধু দুই শ্রেণীর নারী শোক পালন করতে পারে। পুরুষদের জন্য শোক পালন করার বৈধতা ইসলামে নেই। যে দুই শ্রেণীর নারী শোক পালন করতে পারে তারা হচ্ছে—

১. এমন স্ত্রী যার স্বামী মৃত্যুবরণ করেছে। সে চার মাস দশ দিন ইদ্দতের ভেতর থেকে শোক পালন করবে। এটা তার জন্য আবশ্যকীয় বিধান।

২. এমন নারী যার নিকট আত্মীয় মারা গেছে। সে সর্বোচ্চ তিন দিন শোক পালন করতে পারবে। এটি তার জন্য জরুরি বিধান নয়। শুধু অনুমতি আছে।

নবীজির স্ত্রী হযরত উম্মে হাবিবা রা. বলেন, আমি নবীজিকে একথা বলতে শুনেছি, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এমন নারীর  পক্ষে বৈধ নয় কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশি শোক পালন করা। তবে যে স্ত্রীর স্বামী মারা গেছে সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে।  (বুখারী:৫৩৩৪)

মনে রাখতে হবে, এই শোক পালন করতে গিয়ে পূর্বে উল্লেখিত নিষিদ্ধ কোন কাজ করা যাবে না। বরং শোক পালনের পদ্ধতি হচ্ছে, তারা সুরমা সুগন্ধি মেহেদি সাজসজ্জা ও অলংকার পরিধান করা থেকে বিরত থাকবে। এর বিস্তারিত বিধান ফিকহের যেকোন কিতাবে পাওয়া যাবে। (হিদায়া:২/২৭৮)

শোক প্রকাশ করার জন্য কালো পোষাক পরিধান করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। দুররে মুখতার ও ফতোয়া তাতারখানিয়ায় বলা হয়েছে— “শোক প্রকাশের জন্য কালো কাপড় পরিধান করা শরীয়ত সম্মত নয়। তবে যে স্ত্রীর স্বামী মারা গেছে শুধু তার জন্য তিন দিন পর্যন্ত শোক প্রকাশের উদ্দেশে কালো কাপড় পরিধান করার অনুমতি আছে।” (ইবতালে আযারাদারি, হাবিবুর রহমান আজমী:৪৪)

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, স্বামী মারা গেছে এমন স্ত্রী ব্যতিত অন্য কোন নারী এবং পুরুষের জন্য শোক উপলক্ষে কালো কাপড় পরিধান করার বৈধতা ইসলামে নেই।

  • মর্সিয়ার পরিচয় ও বিধান:

মর্সিয়া শব্দটিও আরবী। একে রিসা—ও বলা হয়। ইসলামী পরিভাষা অনুযায়ী, মর্সিয়া হচ্ছে, কোন মৃত ব্যক্তির উত্তম গুণাবলী বর্ণনা করে তার প্রশংসা করা। (ইবনে হাজার আসকালানী কৃত ফতহুল বারী)

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকিহ আল্লামা হাসকাফি রহ. লিখেছেন, কবিতা বা গদ্যে “মর্সিয়া” করা যাবে। এতে গোনাহ নেই। তবে মৃতব্যক্তির প্রসংশার ক্ষেত্রে, বিশেষত জানাজার সময় সীমালঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ। (দুররে মুখতার:২/২৩৯)

বস্তুত মৃতের জন্য যে মর্সিয়া পাঠ করা হয়, একে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—

১. এমন মর্সিয়া যা মানুষের দুঃখ বেদনা বাড়িয়ে দেয়, মানুষকে বিলাপ করতে, বুকে মুখে চাপড়াতে উত্তেজিত করে, অলীক ও অবাস্তব কথা সম্বলিত হয়, যাতে আল্লাহ তায়ালার ফায়সালা ও তাকদীরের প্রতি অভিযোগ করা হয়।

এপ্রকারের মর্সিয়া ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ। সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত একটি হাদীসে সাহাবী ইবনে আবি আউফা রা. বলেন, নবীজি মর্সিয়া থেকে বারণ করেছেন। (হাদীস:১৫৯২) এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে মর্সিয়ার মধ্যে যখন উল্লেখিত কোন বিষয় পাওয়া যাবে।

২. মর্সিয়ার দ্বিতীয় প্রকারটি হল, এমন মর্সিয়া যাতে মৃতের শোকসন্তপ্ত পরিবার ও নিকটজনকে ধৈর্য ধারণ করার প্রতি উৎসাহ ও সান্ত্বনা দেয়া হয়। মৃতব্যক্তির উত্তমগুণ— বদান্যতা, দীনদারী প্রভৃতি উল্লেখ করে মানুষকে এসব কাজের অনুসরণের প্রতি উদ্ধদ্দ করা হয়। ইসলামে এ প্রকারের মর্সিয়া করা বৈধ। নবীজির সাহাবা ও পরবর্তি বহু ইমাম ফকিহ ও মুহাদ্দিস থেকে মর্সিয়া মূলক কবিতা পাওয়া যায়। এগুলো এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। (বিস্তারিত দেখুন, ইমাম কারাফী লিখিত আল ফুরুক: ২/১৭৪, ফতোয়ায়ে আজিজিয়া, শাহ আব্দুল আজীজ দেহলভী:৭২)

এ ছিল শোক পালন (মাতম) ও মর্সিয়ার বিধান সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা।  কিন্তু আমাদের দেশ ও আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ‘মাতম ও মর্সিয়া’ শব্দদুটি অনেকটাই মহররম, বিশেষত ১০ই মহররমের সাথে সম্পৃক্ত মনে করা হয়। সেদিন বিশেষ আয়োজনের ভেতর দিয়ে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র সায়্যিদুনা হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতকে স্মরণ করা হয়। সেখানে মাতম বিলাপ করা হয়, মানুষ মর্সিয়া ও জারী গান গেয়ে থাকে। গুরুত্বের বিবেচনায় এ সম্পর্কে আমরা স্বীকৃত ইমাম ও ফকিহদের বক্তব্যের আলোকে ইসলামের মূল্যায়ন তুলে ধরব। ইনশা আল্লাহ।

শেয়ার করুন

image_print
Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া