পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা

মাশওয়ারা ও আমাদের জীবন

মাশওয়ারা বা পরামর্শের অর্থ হলো কোন বিষয়ে কারো কাছে মতামত জানতে চাওয়া, যাতে সে বিষয়ে সবচে ভালো সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা যায়। মশওয়ারার বিষয়টি কেন উপকারী, কীভাবে উপকারী তা আর বিশ্লেষণ করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। আমরা প্রত্যেকে আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় একে উপলব্ধি করেছি গভীরভাবে। এ কারণে ইসলাম বিষয়টিতে খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছে।

ইসলাম হলো কল্যাণের দীন। সত্যিকার অর্থে যত যা কল্যাণ সকল কিছু সে নিজের ভিতরে ধারণ ও লালন করে। হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে নিজ সঙ্গীদের সাথে অধিক পরামর্শকারি আর কাউকে দেখিনি।[1]

নবীজির এই কর্মপন্থাটি ছিল কুরআনুল কারীমের সে নির্দেশনার অনুসরণ ও বাস্তবায়ন, যেখানে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশন দিয়ে বলেছেন, আর আপনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।[2] জীবনভর সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি এর উপর আমল করে গেছেন। বদরের যুদ্ধ কিভাবে হবে, যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী নেওয়া উচিত, উহুদ যুদ্ধ মদীনার ভেতরে থেকে হবে নাকি বাইরে গিয়ে কাফেরদের প্রতিহত করা হবে, খন্দকের যুদ্ধে খন্দক বা পরীখা খনন ইত্যাদি বহু বিষয় আমরা হাদীসের কিতাবগুলোতে পাই।

সীরাত থেকে শিক্ষা

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরামর্শ আমলে দুটো বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

১. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি, মেধা ও বুদ্ধি, জ্ঞন ও বিচক্ষণতা—সর্ব বিচারে সবার চেয়ে সেরা ছিলেন। আশরাফুল মাখলুকতা। আমাদের সাধারণ বিবেচনামতে তাঁর জন্য এভাবে পরামর্শ করার আবশ্যকতা ছিল না।

তবু তিনি তা করেছেন, এটি তাঁর সমুন্নত আখলাক ও উঁচু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। মানুষকে মূল্যায়ন করা, সঙ্গীদের কথা ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, ক্ষেত্র বিশেষে নিজের মতামত বাদ দিয়ে তাদের মতাতমকে প্রাধান্য দেওয়া—এসব তার গভীর বিনয়কে ফুটিয়ে তোলে, ফুটিয়ে তোলে অসাধারণ নেতৃত্বের গুণটিকে। ফলে, পরামর্শ করা বিনয়ী মানুষের গুণ, সফল নেতৃত্বের পূর্ব শর্ত—এ কথাটি আমরা নির্দ্বিধাই বলতে পারি।

২. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সবসময় ওহি আসছে। ফলে, সকল কাজে সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্তটি আল্লাহ তাআলা চাইলে সরাসরি ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু অনেক সময় এমনটি ঘটেছে, আবার অনেক সময় আল্লাহ তাআলা নবীজিকে দিয়ে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়েছেন। যেন মুসলমানগণ সুন্দর এই আখলাক ও কর্মপন্থটি নিজেদের মধ্যে গুরুত্বের সাথে ধারণ করে এবং কীভাবে পরামর্শ করতে হয় সে বিষয়টি নবীজি থেকে হাতে কলমে শিখে নিতে পারে।

পরামর্শ মুমিনের জীবনে বিশেষ একটি গুণ। “আর যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়েছে, যথাযথভাবে নামাজ আদায় করেছে, এবং যাদের কাজকর্ম পারষ্পরিক পরামর্শক্রমে সম্পন্ন হয়।[3] এই সূরার নামও রাখা হয়েছে সূরা শুরা বা পরামর্শ।

পরামর্শের বিষয় ও বিধান

মাশওয়ার কীসব বিষয়ে করতে হয়, এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, মানুষের জীবনে যে সকল কাজ কর্ম রয়েছে, এগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:

১. যেসব বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নামাজ রোজা হজ যাকাত পর্দা, মা বাবার প্রয়োজনীয় সেবা ইত্যাদি। এসব কাজে পরামর্শের কোন সুযোগ নেই। কারন, পরামর্শ মানেই হলো সিদ্ধান্তহীন কোন বিষয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি তৈরী করা। ফলে শরীয়ত যেখানে সিদ্ধান্ত দিয়ে রেখেছে, সেখানে এ প্রক্রিয়া কার্যকর হওয়ার প্রশ্ন আসে না। অবশ্য এগুলো পালন করতে গিয়ে ব্যবস্থাপনা বা সংশ্লিষ্ট দরকারী বিষয়ে পরামর্শ হতে পারে। যেমন জাকাত দিতে গিয়ে কাকে দেওয়া যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করা বা মা বাবার সেবাটা কী উপায়ে ও কতটুকু পরিমাণে হওয়াটা এখন দরকার—এইসব।

২. রাষ্ট্রীয় পরিসরে বা সমাজ ও পরিবারের সামষ্টিক বিষয়, যা ব্যক্তি বিশেষে সম্পৃক্ত নয়; বরং অনেক মানুষের জীবন ও জীবনপ্রণালীর সাথে জড়িত, প্রধাণত পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত ব্যাপারসমূহ এবং এমন যে, এগুলোতে কোরআন ও হাদীসে স্পষ্ট কোন নির্দশনা নেই—এ কাজগুলো যেহেতু সামষ্টিক, তাই উপযুক্ত লোকদের সাথে মাশওয়ারা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া একান্ত জরুরী। একক সিদ্ধান্তের সুযোগমাত্র নেই।

যেমন, এ মূহুর্তে খলীফাতুল মুসলিমীন কে হতে পারেন, দেশে অমুক আইনটি চালু করা যায় কি না, শত্রুর উপর আগ বেড়ে আক্রমণ করা হবে নাকি অপেক্ষা করা হবে, মসজিদে ইমাম হিসেবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে ইত্যাদি।  

৩. উপরের প্রকার দুটোর বাইরে মানুষের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন বিয়ে, বিদেশ সফর, ব্যবসা, চিকিৎসা ইত্যাদি। ব্যক্তিগত বিষয়াশয়। এসকল ক্ষেত্রে পরামর্শ করা ওয়াজিব বা জরুরি নয়; তবে  সুন্নত বা অন্তত মুস্তাহাব তো বটেই। যেহেতু বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। ভুল সিদ্ধান্ত নিলে বিরাট ক্ষতির শিকার হতে হবে। তাই পরামর্শ করলে এর দ্বারা অনেক উপকৃত হবার আশা থাকে। এ জন্য শরীয়তের কামনা হলো আমরা যেন এসব বিষয়ে পরামর্শ করেই সামনে পা বাড়াই। মুমিন তার জীবনযাপনে কোনভাবে ক্ষতির শিকার হোক, তা কখনোই কাম্য নয়।

৪. এসবের বাইরে নিতান্ত সাধারণ ও ব্যক্তিগত অনেক বিষয় থাকে, যা মানুষ সচরাচর লাইফস্টাইল হিসেবে পালন করে, জীবনযাপনগত সুবিধা ও অভ্যাস, প্রাত্যহিক জীবনের ছোটখাট বিষয়াবলী। একজন মানুষ কী খাবে,  কখন ঘুমাবে, পড়ার জন্য কোথায় বসবে, কার সাথে সফরে যাবে ইত্যাদি।

এ জাতীয় বিষয়গুলো পরামর্শের আওতাভুক্ত নয়। কারণ, এমন টুকটাক বিষয়গুলোতেও যদি পরামর্শ করতে হয়, এর দ্বারা মানুষের জীবনে একধরণের অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। অবশ্য, ব্যক্তি, পরিস্থিতি, স্থান ও সময় ইত্যাদি নানা বিবেচনায় কখনো কখনো কারো কারো ক্ষেত্রে এ ধরণের কোন কোন বিষয়েও পরামর্শ করাটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্রয়োজন দেখা দিলে তো করতে হবেই; তবে এটা বিশেষ বিবেচনা। সাধারণ নিয়ম নয়।[4]

পরামর্শ দেওয়ার নিয়ম ও আদব

কেউ কারো কাছে পরামর্শ চাইলে তাকে উপযুক্ত ও কল্যাণপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— তোমাদের কেউ যখন কারো কাছে পরামর্শ চাইবে, সে যেন তাকে পরামর্শ দেয়।[5]  অপর এক হাদীসে বলেন, কল্যাণকামিতাই দীন।[6] তাই দীনি বিষয়ে হোক বা পার্থিব বিষয়ে, সামর্থ থাকলে পরামর্শ দিতে কার্পন্য করা উচিত নয়। তবে এর জন্য শরীয়ত নির্দেশিত সাধারণ কিছু নিয়ম ও আদব রয়েছে।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে পরামর্শ একটি আমানত। আমি যদি ভুল পরামর্শ দিই তাহলে খেয়ানতের অপরাধে অপরাধী হব। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় সে হয় আমানতের ধারক।[7] এর বিপরীত চিত্রটি দেখিয়ে তিনি বলেছেন—যার কাছে তার কোন মুসলিম ভাই পরামর্শ চাইল, তারপর সে অকল্যাণকর পরামর্শ দিল, তখন সে মূলত তার সাথে খেয়ানত করল।[8]

পরামর্শ চাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে আমাদের জানাশোনা না থাকলে অনেক সময় সে কথা জানাতে সংকোচ বোধ করি এবং নিজের মুখ রক্ষার্থে অনুমানের উপর একটা পরামর্শ দিয়ে দিই। এটা কোনভাবেই উচিত নয়। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে এ বিষয়ে আমি ভালো জানি না আসলে। এতে মোটেও লজ্জার কিছু নেই। এর বিপরীতটা করলে মানুষটা ক্ষতির শিকার হবে। পাশাপাশি আমিও খেয়ানতের কারণে গুনাহগার হব।

পরামর্শ দেওয়ার বিষয়ে হাদীসে খুব সুন্দর একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন— কেউ কারো কাছে পরামর্শ চাইলে সে যেন সে পরামর্শটিই দেয় তার জায়গায় থাকলে যা সে নিজে করত।[9]

মানুষ নিজের ক্ষেত্রে যেমন পূর্ণ নিশ্চিত বা আশ্বস্ত না হয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না, অন্যকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রেও এই পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সহজ কথায়, নিজের কল্যাণ ও পরামর্শগ্রহণকারির কল্যাণ- এ দুয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করা যাবে না।

অনেক সময় এমন হয়, কেউ একজন এসে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে ব্যবসায়িক পার্টনার বানাবে কি না, বা তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করবে কি না এ বিষয়ে জানতে চায়। সে সময় আমরা যদি ব্যক্তিটিকে ভালো জানি, তখন তো নির্দ্বধায় এগোনোর পরামর্শ দিই; কিন্তু যদি বিপরীত হয়, তখন দ্বিধায় পড়ে যাই। ভাবি, তার খারাপটা প্রকাশ করলে গীবত হয়ে যাবে। গীবত তার আপন জায়গায় খুবই কুৎসিত ও নিষিদ্ধ জিনিস, ভয়াবহ গুনাহের কাজ সন্দেহ নেই; কিন্তু শরীয়তে বিশেষ কিছু পরিস্থিতিকে বিশেষ বিবেচনায় গীবতের আওতা বহির্ভুত রেখেছে। এর মধ্যে একটি হলো এই। কারণ, পরামর্শ হলো কল্যাণকামিতা, পরামর্শ হলো একটি দীনি আমানত। ফলে, এখানে সেই ব্যক্তির অনিষ্টতা ও অকল্যান সম্পর্কে নিশ্চিত জানা থাকলে প্রয়োজনীয় খারাপটুকু পরামর্শের আঙ্গিকে প্রকাশ করা গীবত নয়।[10]

পরামর্শ চাইব কার কাছে

এ বিষয়ে প্রশিদ্ধ ফকীহ আবুল হাসান আল মাওয়ারদী রহ. এর আলোচনাটি সংক্ষেপে পত্রস্থ করছি। তিনি আদাবুদ্দুনিয়া ওয়াদ দীন কিতাবে লিখেছেন:

যার মধ্যে পাঁচটি বিষয় থাকবে, সে পরামর্শের উপযুক্ত ব্যক্তি।

১. বিষয়টিতে তার অতীত অভিজ্ঞতা আছে, সাথে পূর্ণ জ্ঞান বুদ্ধিও আছে।

২. ধার্মিকতা ও খোদাভীতি। কারণ, প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি কখনো খেয়ানত ও প্রতারণা করবে না।

৩. যার হৃদয়ে ভালোবাসা ও কল্যাণকামনা আছে।

৪. পরামর্শদাতা দুশ্চিন্তা ও বিশেষ কর্মব্যস্ততা মুক্ত হওয়া। কারণ কেউ যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে কিংবা কোন বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকে, সে তখন ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে না। (রাগের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রাগের অবস্থায় থাকলেও তার কাছে পরামর্শ চাওয়া উচিত নয়।)

৫. পরামর্শের বিষয়টিতে পরামর্শদাতার নিজস্ব কোন স্বার্থ ও লাভ লোকসান জড়িত না থাকা। কারণ এমন ক্ষেত্রে মানবিক দুর্বলতা কাটিয়ে পরামর্শদাতা যথাযথ পরামর্শ নাও দিতে পারেন।[11]

হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. সম্পর্কে সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল বারিতে বর্ণিত আছে— তাঁর সামনে কোন বিষয় এলে প্রথমে কুরআনুল কারীমে খুঁজে দেখতেন, না পেলে নবীজির হাদীসে সমাধানটি তালাশ করতেন, নিজে খুঁজে না পেলে অন্যদেরকে জিজ্ঞেস করতেন এ বিষয়ে তার কাছে কোন হাদীস আছে কি না, কারো জানা না থাকলে নেতৃস্থানীয় মুসলিম ও পণ্ডিত আলেমদের ডেকে পরামর্শ করতেন।[12]

ইমাম বুখারি লিখেছেন, হজরত উমর রা. এর পরামর্শ সভার সদস্য ছিলেন উলামায়ে কেরাম, সে দলে প্রবীণরা যেমন ছিলেন, তরুণরাও ছিলেন।[13] প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরি বলেন—খেয়াল রেখো, তোমার পরামর্শদাতা যেন পরহেজগার, আমানতদার ও খোদাভীরু মানুষ হয়।[14]

পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত : লক্ষ্যণীয় একটি দিক

পরামর্শ মানুষ করে কোন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করার জন্য। ফলে নানা জন থেকে বিভিন্ন পরামর্শ আসার পর এসবের আলোকে চিন্তা ভাবনা করে সবচেয়ে উপযোগি মতাটি তিনি বেছে নিবেন। এ ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে কোন একজনের মত না নিয়ে তিনি বরং নতুন একটি মিশ্র সিদ্ধান্ত তৈরী করবেন।

পরামর্শসভাটি যদি সামষ্টিক বিষয়ে হয়ে থাকে, সেখানে একজন সিদ্ধান্তদাতা থাকেন। শরয়ী নির্দেশনা সামনে রেখে সততার সাথে তাকে কাজটি করতে হবে। আর ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ হলে কাজটি করবেন পরামর্শকারী নিজে। এটা তার অধিকার।  ফলে একদিকে যেমন কারো মন রক্ষা করে তার মতট গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকে না, অপরদিকে পরামর্শদাতার সে বাসনা রাখা উচিত না। তার মতটি নেওয়া হয়নি বলে যদি মনক্ষুণ্ণ হন, দোষারোপ করেন বা চাপ সৃষ্টি করেন, তাহলে এর অর্থ হবে পরামর্শদানে তিনি সৎ নন, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাও তার উদ্দেশ্য নয়। কেবলই উৎকট আমিত্বের প্রকাশ, অহংকারী মনোভাবের প্রদর্শন।

নারীদের পরামর্শ : একটি ভুল ধারণার অপনোদন

নারীদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ বিষয়ে সম্ভবত সমাজে এক ধরণের নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে। তাদের থেকে পরামর্শ নেওয়া যাবে না। বিশেষত পুরুষেরা নারীদের সাথে পরামর্শ নেওয়াটা ভালো নয়। এমন ধারণা ইসলাম সম্মত নয়। হাদীসে বরং এর উল্টোটাই আমরা দেখি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাহাতুল মুমিনীনদের থেকে অনেক সময় পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। যেমন, হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. এর পরামর্শ অনুযায়ী নবীজি মাথার চুল মুণ্ডন করেছিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরামও ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার জন্য চুল মুণ্ডন করেছিলেন।[15]

এ হাদীসের আলোকে বরেণ্য ইমামগন, যেমন ইবনে বাত্তাল, খাত্তাবি, ইবনুল জাওযি, ইবনে হাজার প্রমূখ বলেছেন, হাদীস থেকে প্রমাণিত হল বুদ্ধিমান বিজ্ঞ নারীদের সাথে পরামর্শ করা যায় এবং তাদের মতামত অনুযায়ী আমলও করা যায়।

এখানে মূলত দেখতে হবে যা, তা হলো বিষয় ও উপযুক্ততা। পরামর্শদাতা ব্যক্তিটি যদি সে বিষয়ে বিজ্ঞ হন, পরামর্শ দেওয়ার মতো জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তার সাথে পরামর্শ করা যাবে, সে নারী হোক বা পুরুষ হোক।

এখানে সম্ভবত কেউ কেউ তিরমিজি শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেন। হাদীসটি হলো, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—যখন তোমাদের সর্বোত্তম লোকরা হবে তোমাদের আমীর, ধনীরা হবে দানশীল, তোমাদের বিষয়াদি হবে পরামর্শ ভিত্তিক, তখন ভূ-তলের চেয়ে ভূ-পৃষ্ঠ হবে তোমাদের জন্য উত্তম। এর বিপরীতে যখন তোমাদের মন্দ লোকেরা হবে তোমাদের আমীর, ধনীরা হবে কৃপন আর যাবতীয় বিষয় ন্যাস্ত হবে নারীদের হাতে, তখন যমীনের উদর হবে তোমাদের জন্য এর উপরিভাগের উৎকৃষ্ট।[16]

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে হাদীসে নারীগণের সাথে পরামর্শ নিষেধ করে কিছু বলা হয়নি। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়ের নিন্দা করা হয়েছে। তা হলো—বিষয় ও উপযুক্ততার বাছ বিচার না করে ‘সকল বিষয়ের ভার তাদের হাতে সঁপে দেওয়া’। তারা সে কাজের উপযুক্ত হোক বা না হোক, এতে মানুষের কল্যাণ হোক বা না হোক, শুধু তাদের মন রক্ষা করার জন্য কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাদেরকে পরিচালকে আসনে সমাসীন করা। এটা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও বর্জনীয় বিষয়।

কারণ, জগতে নারী ও পুরুষ প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কর্মক্ষেত্র ও কর্তৃত্ব। নানান কাজের জন্য আছে যোগ্যতা ও উপযুক্ততার শর্ত। সে মুতাবেক যে যার কাজ করবে। হরেদরে সকল কিছু নারীর হাতে সমর্পন করা সমর্থিত নয়। এটা সবার জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে, সন্দেহ নেই।

পরামর্শের মৌলিক দুটি উপকার

পরামর্শের অনেকগুলো উপকারের কথা ইতিমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। এর ভিতর থেকে প্রধান দুটো বিষয় আলাদা করে দেখানো দরকার।

১. এক হলো, এর মাধ্যমে আমরা কাজে কর্মে ভুল ত্রুটি থেকে বাঁচতে পারি। একজন মানুষ জগতের সকল বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে না। আবার অভিজ্ঞতা থাকলেও সবার জানাশোনা সমান নয়। ব্যক্তি জ্ঞানী ও বিচক্ষণ হলেও দরকারী অনেক কিছু নজর এড়িয়ে যেতে পারে। পরামর্শে বসে সবার অভিজ্ঞতা যখন সমবেত হয়, বিচার ও পর্যালোচনা হয়, তখন ছোট বড় ও ভালো মন্দ সকল দিক আমাদের সামনে আসে। এরপর যে সিদ্ধান্ত আসে সেটিই হয় তুলনামূলক সুন্দর ও সঙ্গত।

২. পরামর্শের দ্বারা পরষ্পরের মধ্যে একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। বন্ধুত্ব, পারষ্পরিক বিশ্বাস আস্থা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। কল্যাণকামনার আদান প্রদান ও অনুশীলন হয়। পাশাপাশি বিশেষত সামষ্টিক বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত ব্যর্থ হলে একে অপরকে দোষারোপ করে কলহ তৈরীর রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে যায়। সবাই কাজটিতে গুরুত্বের সাথে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, ব্যক্তি হিসেবে সে মূল্যায়িত হয়েছে—এই অনুভূতিটা সকলকে একটি মানসিক তৃপ্তি ও আশ্বস্তির ভিতরে রাখে, ফলে সম্মিলিত কাজগুলোতে সুন্দর, স্বতঃস্ফুর্ত ও সহযোগিতামূলক একটা পরিবেশ সর্বদা বজায় থাকে।


[1]  মুসনাদে আহমদ: ১৮৯২৮, সহি ইবনে হিব্বান: ৪৮৭২।

[2]  আলে ইমরানঃ ১৫৯.

[3] সুরা শুরা: ৩৮

[4] মাআরিফুল কুরআন-সুরা আলে ইমরানঃ১৫৯, হাকিমুল উম্মত থানভী কৃত হায়াতুল মুসলিমীন, তাফসীরে উসমানি, সুরা শুরা। কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনসহ।

[5] (সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩৭৪৭)

[6] সহি মুসলিমঃ

[7] আবু দাউদঃ ৫১২৮, তিরমিযিঃ ২৩৬৯।

[8] মুসনাদে আহমদ; ৮২৬৬।

[9] মুজামে তবারানি।

[10] দ্রষ্টব্য: রিয়াযুস সালেহীনঃ অধ্যায় নংঃ ২৫৬, আল মাউসুয়া আল ফিকহিয়া আল কুয়াইতিয়াঃ ২৬\২৮৩.

[11] দ্রষ্টব্য: ২৬০-২৬৩, হাসান ইতির রচিত আশশুরার সূত্রেঃ ১৭৭

[12] ফতহুল বারিঃ ১৩\৩৫৪

[13] সহি বুখারিঃ ৯\১১২

[14] তাফসিরে কুরতুবিঃ ৪\২৫১

[15] দ্রষ্টব্য সহি বুখারি, ২৭৩১।

[16] সুনানে তিরমিযিঃ ২২৬৬, মুসনাদে বাযযারঃ ৯৫২৯

সৌজন্যে, মাসিক নেয়ামত

Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া