যালেমকে সহযোগিতা ও কুরআন হাদীসের নির্দেশনা

পবিত্র কুরআনের আলোকে যুলুম ও যালেমকে সহযোগিতা

যালেম বা নিপীড়করা মানুষের উপর যুলুম করার সুযোগ কখন পায়? একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখলে আমাদের সামনে উত্তর আসবে, মূলত যালেম ও নিপীড়কদের সহযোগী সমর্থকদের কারণেই তারা নিপীড়ন করার সুযোগ পায়। তাদের চারপাশের মানুষ যদি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত গুটিয়ে নিত তাহলে মানুষের দ্বারা মানুষ নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা প্রায় ঘটতোই না। কারণ কোন যালিম একা একা যুলুম করার সাহস করতে পারে না। ফলে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, সমাজে প্রতিদিন অসংখ্য যে যুলুমের ঘটনা ঘটছে, দিনদিন নিপীড়িত মানুষের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে, এর পেছনে যুলুম ও যালিমকে সহযোগিতার বড় ভূমিকা রয়েছে।


আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, সমাজের বড় অংশটি যুলুম নিপীড়নকে খারাপ ও গর্হিত কাজ হিসেবে দেখে। এগুলোকে নিজেদের জন্য লজ্জা ও কলংকজনক মনে করে থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আমরা যুলুম ও নিপীড়নে সহযোগি হয়ে যাই। কখনো এমন হয় যুলুমে যে সহযোগিতা করছি, এটি আমরা বুঝতেও পারি না। আবার কখনো জেনে শুনেই এই কাজ করে ফেলি। হয়তো একে গুরুতর কোন গোনাহই মনে করি না। অথচ কুরআন ও হাদীসে যুলুমকে যেভাবে ভয়াবহ ও গর্হিত গোনাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, একইভাবে যুলুমকে সমর্থন বা সহযোগিতাকেও ভয়াবহ পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
যুলুমে সহযোগিতা বা সমর্থন বলতে কী বুঝায়? সহজ করে বললে, যুলুমে সহযোগিতা মানে হচ্ছে, যালেমের যুলুমকে সহজ করে, কিংবা একে অব্যাহত রাখে এমন যেকোন কাজ বা আচরণ করা।


বুঝাই যাচ্ছে এই সহযোগিতার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। যালেমকে সম্মান করা, তার সাথে সখ্যতা বন্ধুত্ব রাখা, তার দল্ভারি করা, যালিমের কাজকর্মে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা, যুলুম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এমন কোন ব্যবস্থা করে দেয়া, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয়া, যালিমের পক্ষে সাফাই গাওয়া, তার যুলুমকে ঢেকে রাখা— এসব কিছুই যুলুম ও যালেমকে সহযোগিতার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হবে।


কুরআন হাদীসে এই আচরণটিকে খুবই গর্হিত ও ভয়াবহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে যুলুম একটি মন্দ ও পাপ কাজ। আর মন্দ কাজের ব্যাপারে কুরআন হাদীসের জোরালো নির্দেশনা হল, মন্দ কাজ যেখানেই প্রকাশিত হবে একে প্রতিহত জরতে হবে। হাত দ্বারা শক্তি প্রয়োগ করে। এই সামর্থ্য না থাকলে মুখের ভাষা দিয়ে একে দমন করতে হবে। এটাও করতে না পারলে মনে মনে অন্তত কাজটিকে ঘৃণা করতে হবে। মন্দ কাজকে মন্দ ও ঘৃণ্য হিসেবে দেখাটা ঈমানের সর্বনিম্ন দাবি। সহি মুসলিমঃ
অর্থাৎ কেউ যদি এটা না করে তাহলে তার ঈমান যথাযথ নয় বলে প্রমাণিত হবে। সেই জায়গায়, মন্দ কাজটিকে গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য না করে, একে প্রতিহত না করে, তারা একে উদযাপন করতে বলছেন।


কুরআনে কারীমে বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যুলুমে সহযোগিতা ও সমর্থনের বিষয়টি আলোচনা করেছেন। নিচে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ কয়েকটি আয়াত ও তা থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা তুলে ধরছি।


এ প্রসংগে শুরুতেই সুরা হুদের একটি প্রসিদ্ধ আয়াত উল্লেখ করতে চাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন,


وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ أَوْلِيَاءَ ثُمَّ لَا تُنْصَرُونَ (113)


আর তোমরা যালেমদের দিকে ঝুঁকে পড়বে না। না হয় আগুন তোমাদেরও স্পর্শ করবে। এবং আল্লাহ ব্যতিত তোমাদের কোন অভিবাভক থাকবে না। তারপর তোমাদের সাহায্য করা হবে না। হুদঃ ১১৩


আয়াতে যালেম বলে মুশরিক কাফের পাপী ও নিপীড়ক সবাইকেই বুঝানো হয়েছে। আর তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হল তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা, তাদের কর্মকান্ডের প্রতি খুশি থাকা, এদের সম্মান ও প্রশংসা করা সবই উদ্দেশ্য। (দ্রষ্টব্য, তাফসিরে কুরতুবি, রাযি, রূহুল মায়ানি, উসমানিঃ সুরা হুদঃ ১১৩ এর ব্যাখ্যা)


আয়াতে যালেমদের সহযোগিদের সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলে হয়েছে, জাহান্নামের আগুন যালেমদের যেমন স্পর্শ করবে, তাদের সহযোগীদেরও স্পর্শ করবে। এও বলা হয়েছে, আল্লাহ তাদের সাহায্য তো করবেনই না। তিনি ছাড়া অন্য কেউও সাহায্য করে শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে না।


অপরএকটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন,

قَالَ رَبِّ بِمَا أَنْعَمْتَ عَلَيَّ فَلَنْ أَكُونَ ظَهِيرًا لِلْمُجْرِمِينَ (17)


(মুসা) বললেন, হে আমার প্রতিপালক, আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তাই আমি কিছুতেই অপরাধীদের সাহায্যকারি হব না। সুরা কাসাসঃ ১৭
ইমাম রাযি রহঃ লিখেছেন, এ আয়াতটি প্রমাণ বহন করছে যে যালেম ও ফাসিক লোকদের সাহায্য করা জায়েজ নেই। (তাফসিরে রাযিঃ সুরা কাসাসঃ ১৭)


ইমাম ইবনে আতিয়্যা বলেছেন, যালেমদের কাজে কর্মে কোনভাবেই সহযোগিতা করা বৈধ নয়, এবিষয়ে পূর্ববর্তি বরেণ্য অধিকাংশ ইমামগণ এ আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করেছেন। তিউনিসিয়ার প্রখ্যাত মুফাসসিরও একই কথা লিখেছেন তাঁর আত তাহরীর ওয়াত তানবীর তাফসীরে।


ইরাকের বরেণ্য মুফাসসির আল্লামা আলুসি বলেছেন, কারো মতে আয়াতটির অর্থ হল, হে আল্লাহ আপনি আমার উপর যে অনুগ্রহ করেছেন, সে জন্য কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই তওবা করছি, এবং ভবিষ্যতে কিছুতেই আমি কাফেরদের সহযোগি হব না, তথা তাদের সংগি হবো না এবং তাদের দলও ভারি করবো না। (দ্রষ্টব্য, রুহুল মায়ানিঃ সুরা কাসাসঃ১৭)


মুফতিয়ে আজম মুহাম্মদ শফি রহঃ লিখেছেন, আয়াত থেকে দুটি বিধান সাব্যস্ত হয়। এক। নির্যাতিত মানুষ, চাই সে ফাসিক বা কাফিরই হোক না কেন, তাকে সাহায্য করা চাই। দুই। কোন অপরাধি যালেমকে সাহায্য করা বৈধ নয়। উলামায়ে কেরাম এ আয়াত দ্বারা এটাও প্রমাণ করেছেন, যালেম শাসকের অধীনে চাকুরি করাও বৈধ নয়। কেননা এতে তাকেও যুলুমের সহযোগি হিসেবে গণ্য করা হবে। (মায়ারিফুল কুরআনঃ সুরা ক্বাসাসঃ ১৭)

আমাদের আলোচনায় কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতগুলোও খুবই প্রাসংগিক। সুরা নিসায় আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,


إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا (105) وَاسْتَغْفِرِ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا (106) وَلَا تُجَادِلْ عَنِ الَّذِينَ يَخْتَانُونَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ خَوَّانًا أَثِيمًا (107)


আমি আপনার প্রতি সত্য সম্বলিত কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আল্লাহ আপনাকে যে উপলব্ধি দান করেছেন, সে মাফিক আপনি ফায়সালা করতে পারেন। আর আপনি খেয়ানতকারিদের পক্ষাবলম্বনকারি হবেন না। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করুন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। যারা নিজেদের সাথে খেয়ানত করে, তাদের পক্ষে আপনি বিবাদ বিতর্ক করবেন না। (সুরা নিসা- ১০৫-১০৭)


সুরা নিসার উক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার দীর্ঘ একটি প্রেক্ষাপট হাদীস ও তাফসীরের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে আয়াতে মুমিনদের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এটি স্পষ্ট। খেয়ানত বা বিশ্বাস ঘাতকতা বলতে শুধু আমানতের খেয়ানতই উদ্দেশ্য নয়। বরং যে কোন পাপ ও যুলুম এর অন্তর্ভূক্ত। আয়াতে বলা হচ্ছে, এসব বিশ্বাসঘাতক, যালেমের পক্ষে সাফাই গাওয়া নিষিদ্ধ। তাদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা করা, তাদের দোষ ও যুলুমের পক্ষে যুক্তি হাজির করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। যা থেকে সবাইকে বিরত থাকা কাম্য।


আমরা অবচেতন মনে অনেক সময়ই যুলুম ও যালেমদের পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরি। তাদের যুলুমকে ছোট করে, বা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উপস্থাপন করতে চাই। এটি আয়াতের নির্দেশনার সাথে স্পষ্ট সাংঘর্ষিক।


অপরদিকে সুরা নিসায় ইহুদীদের এই স্বভাবের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,


وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ لَا تَسْفِكُونَ دِمَاءَكُمْ وَلَا تُخْرِجُونَ أَنْفُسَكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ ثُمَّ أَقْرَرْتُمْ وَأَنْتُمْ تَشْهَدُونَ (84) ثُمَّ أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ تَقْتُلُونَ أَنْفُسَكُمْ وَتُخْرِجُونَ فَرِيقًا مِنْكُمْ مِنْ دِيَارِهِمْ تَظَاهَرُونَ عَلَيْهِمْ بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَإِنْ يَأْتُوكُمْ أُسَارَى تُفَادُوهُمْ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيْكُمْ إِخْرَاجُهُمْ أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ


এবং (স্মরণ কর) যখন আমি তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা একে অন্যের রক্ত বহাবে না এবং আপন লোকদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করবে না। অতঃপর তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা নিজেরা তার সাক্ষী।


অতঃপর (আজ) তোমরাই সেই লোক, যারা আপন লোকদেরকে হত্যা করছ এবং নিজেদেরই মধ্য হতে কিছু লোককে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছ এবং পাপ ও সীমালংঘনে লিপ্ত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে (তাদের শত্রুদের) সাহায্য করছ। তারা যদি (শত্রুদের হাতে) কয়েদী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে তোমরা মুক্তিপণ দিয়ে তাদেরকে ছাড়িয়ে নাও। অথচ তাদেরকে (ঘর-বাড়ি হতে) বের করাই তোমাদের জন্য হারাম ছিল। (সুরা বাকারাঃ ৮৪-৮৫)


আয়াত দুটিতে মদীনার দুটি ইহুদী গোত্রের বিশেষ আচরণের বিবরণ দেয়া হয়েছে। তাফসীরে উসমানীতে বলা হয়েছে, “মদীনায় ইহুদীদের দুইটি গোত্র ছিল- বনী কুরায়জা ও বনী নযীর। এরা পরস্পরে যুদ্ধ-বিগ্রহ করত। অপর দিকে মুশরিকদেরও সেখানে দুটি দল ছিল- ‘আওস’ ও ‘খাযরাজ’। এরাও পরস্পর শত্রু ছিল। বনী কুরায়জা মিত্রতা করেছিল আওসের সাথে, আর বনী নযীর ভ্রাতৃত্ব করেছিল খাযরাজ এর সাথে। যুদ্ধ-বিগ্রহে প্রত্যেকেই স্ব স্ব মিত্রপক্ষকে সহায়তা করত, একের উপর অন্যের বিজয় হলে দুর্বলদের দেশান্তরিত করত এবং ওদের ঘর-বাড়ী ধসিয়ে দিত। আর কেউ কয়েদীরূপে ধৃত হয়ে আসলে সকলে মিলে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে মুক্তিপন দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে নিত।“ এই যে এক ইহুদী গোত্র আরেক ইহুদী গোত্রের বিরুদ্ধে শত্রু পক্ষকে সাহা্য্য করত, কুরআনে কারীম এই প্রবণতাকে মন্দ ও গর্হিত হিসেবে বিবেচনা করছে। একারণে তাদের নিন্দা করেছে।


প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম রাযি রহঃ লিখেছেন, এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যুলুম করা যেমন হারাম, ঠিক তেমনিভাবে যুলুমে সাহায্য করাও হারাম। যদিও সরাসরি যুলুম করা তুলনামূলক গুরুতর গুনাহ। (তাফসীরে রাযিঃ সুরা বাকারাঃ ৮৫)

একজন মুসলিম কোন কাজে সহযোগিতা করবে, কোন কাজে সহযোগিতা করবে না, এ বিষয়ে মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে সুরা মায়েদায়।


وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (2)

এবং তোমরা পূণ্য ও খোদাভীতির কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা কর। কিন্তু পাপ ও সীমালংঘণের ক্ষেত্রে একে অন্যকে সাহায্য করো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। (সুরা মায়েদাঃ ২)


আরবের প্রসিদ্ধ আলেম আল্লামা সা’দী তাঁর তাফসীরে লিখেছেন, সীমালংঘনের মানে হচ্ছে মানুষের জান মাল ইজ্জত আব্রুকে লুন্ঠিত করা। ফলে যেকোন পাপ ও যুলুম থেকে মুমিন নিজে যেমন বেঁচে থাকবেন, অন্য মুমিনকেও পাপ ও যুলুম থেকে বাঁচাতে হবে। (তাফসীরে সা’দীঃ সুরা মায়েদাঃ ২)


মুফতী শফী রহঃ এ আয়াতকে সামনে রেখে তাঁর কালজয়ী তাফসীর গ্রন্থ মায়ারিফুল কুরআনে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। উপসংহারে তিনি লিখেছেন, সত্যকে সত্য হিসেবে প্রমাণ করার জন্য, অপরাধ ও যুলুমের দরজা বন্ধ করার জন্য যে সাক্ষ্য দেয়া দরকার, কেউ যদি এমন সাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে এটি অপরাধে সহযোগিতা হিসেবে গণ্য হবে। আর অপরাধে সহযোগিতা কুরআনের দৃষ্টিতে হারাম ও ভয়াবহ গুনাহের কাজ। (মাআরিফুল কুরআনঃ সুরা মায়েদাঃ ২)

হাদীসের আলোকে “যুলুম ও যালেমকে সহযোগিতা”

ইসলামের একটি বুনিয়াদি শিক্ষা হচ্ছে পৃথীবিতে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। আর এই ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানব সমাযে শান্তি ও নিরাপত্ত্বা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলাম মৌলিক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি ন্যায় প্রতিষ্ঠাকে ব্যাহত করে এমন বিষয়কেও নিষিদ্ধ করেছে। যেমন যুলুমকে হারাম করার সাথে সাথে যুলুম ও যালেমকে যেকোন ধরণের সাহায্য করতে নিষেধ করে দিয়েছে। কুরআনেও এই নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে, যার বিবরণ আমরা গত লেখায় তুলে ধরেছি। কুরআনের মত নবীজির একাধিক হাদিসেও যুলুম ও যালেমকে সাহায্য সমর্থন করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই রচনায় আমরা হাদীসের আলোকে যুলুম ও যালিমকে সহযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা করব।


• এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আমরা কা’ব ইবনে উজরা রাঃ বর্ণিত প্রসিদ্ধ একটি হাদীস উদ্ধৃত করছি। যালিমকে সহযোগিতা করা কতটা ভয়াবহ, গুরুতর, এবিষয়ে নবীজি সাবধানবানি উচ্চারণ করে বলেছেন, আমার পর অনেক (যালেম) শাসক আসবে, যে ব্যক্তি তাদের কাছে যাবে, তারপর তাদের মিথ্যাকে সত্য বলবে, তাদের যুলুম ও অবিচারে তাদের সহযোগিতা করবে, তাদের সাথে আমার সম্পর্ক নেই, আমার সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা হাউযে কাউসারে আমার নিকট অবতর করবে না। অপরদিকে যে ব্যক্তি তাদের কাছে যাবে না, তাদের মিথ্যাকে সত্য আখ্যায়িত করবে না, যুলুমেও সাহায্য করবে না, সে আমার দলের, আমার সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক থাকবে। এবং সে হাউযে কাউসারে আমার কাছে অবতরণ করবে। (সুনানে নাসাঈ- ৪২১৮)
ইবনে আব্বাস রাঃ এর বর্ণনায় এসেছে, আর যে ব্যক্তি তাদের সাথে মিলিত হবে সে ধ্বংস হবে। (ইবনে আবি শাইবাঃ ৩৮৮৭৯৭)


হাদীসটির ব্যাখ্যায় আল্লামা মুনাবি রহঃ সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, সে ধ্বংস হবে কারণ সে একাজ করতে গিয়ে অনেকগুলো পাপের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। যালেম শাসকদের খেয়াল খুশির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে। তাদের সাথে নমনীয়তা প্রদর্শন করা লাগবে। তাদের কাজের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে হবে। তাদের মত চলতে হবে, বেশভূষা ধারণ করতে হবে তাদের মত। তাছাড়া তাদের চাকচিক্যের দিকেও নজর পড়বে। এতে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “যারা যুলুম করে তোমরা তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ো না। নাহয় জাহান্নামের আগুন তোমাদেরও স্পর্শ করবে। (ফয়যুল কাদীরঃ হাদীসে নং-৪৭৮১)

• অপর একটি হাদীসে নবিজি বলেছেন, তোমাদের উপর অনেক শাসক নিযুক্ত হবে, তাদের থেকে ভালো মন্দ দুরকমের কাজই তোমরা দেখতে পাবে। যে ব্যক্তি তার মন্দ কাজকে (কথায়) অপছন্দ করবে, সে (নেফাক ও শিথীলতা প্রদর্শন থেকে) মুক্ত হয়ে যাবে। আবার যে (অক্ষমতার কারণে) শুধু অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে, সে (শাস্তি থেকে) নিরাপদ হয়ে যাবে। কিন্তু যে শাসকের মন্দ কাজকে পছন্দ করবে ও সে মাফিক চলবে, (তাকে পাকড়াও করা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে।) (সহি মুসলিমঃ ১৮৫৪)


কেন শাস্তির মুখোমুখি হবে এর ব্যখ্যায় হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী লিখেছেন, কেননা গোনাহের কাজে সন্তুষ্ট হওয়া নিকৃষ্টতম হারাম কাজ। এতে অন্তর দ্বারা গোনাহের কাজকে ঘৃণা করতে পারে না। অথচ অন্তর দ্বারা গোনাহের কাজকে ঘৃণা করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। কোন অবস্থাতেই কারো থেকে এই বিধান রহিত হয় না।


• হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন মামলায় সাহায্য করবে, অথবা যুলুমে সাহায্য করবে, সে আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষে থাকবে, যতক্ষণ না তা থেকে বিরত হয়। ইবনে মাজাহঃ ২৩২০ ও হাকেমঃ ৭২৪৭

• হজরত ইবনে মাসউদ রাঃ বর্ণিত আরেক হাদীসে নবীজি যুলুমে সাহায্যকারিকে তুলনা করেছেন উটের সাথে। নবীজি বলেন, যে ব্যক্তি যুলুম করা স্বত্ত্বেও তার সম্প্রদায়কে সাহায্য করবে, সে হচ্ছে এমন উটের মত যা কূপে পড়ে গেছে, ফলে তাকে লেজে ধরে টানা হচ্ছে। মুসনাদে আহমদঃ৪২৯২, সুনানে আবু দাউদঃ


হাদিসের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকার আল্লামা খাত্ত্বাবি রহঃ লিখেছেন, অর্থাৎ যুলুমে সাহায্যকারি লোকটি পাপে জড়িয়ে পড়ল। এবং ধ্বংস হয়ে গেল, সেই উটের মত যা একটি কূপে পড়ে গিয়েছে ফলে লেজে ধরে তাকে টানা হচ্ছে। কিন্তু সে পতন ও ধংস থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। (মায়ালিমুস সুনানঃ ১/৫৩৫)

• ইমাম যুহরি বর্ণনা করেন, নবীজি বলেছেন, তুমি নিজে চক্রান্ত করো না, কোন চক্রান্তকারিকে সাহায্যও করো না। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মন্দ চক্রান্ত কেবলই চক্রান্তকারিকে আক্রান্ত করে। সুরাঃ তুমি নিজে যুলুম করো না, আবার কোন যালেমকে সাহায্যও করো না। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমাদের যুলুমের ক্ষতি তোমাদের উপরই আরোপিত হবে। সুরা; (ইমাম ইবনুল মুবারক রচিত আয যুহদঃ ৭২৫)

• হজরত ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণিত হাদীসে নবীজি বলেন, যে ব্যক্তি কোন যালেমকে সাহায্য করবে, তার ভ্রান্ত বিষয় দ্বারা (মাযলুমের) অধিকার নস্যাত করার জন্য, তার থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। ইমাম ত্ববারানি কৃত মু’জামে আওসাতঃ ২৯৪৪

দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনুল আসীর রহঃ লিখেছেন, অর্থাৎ সে আর আল্লাহ তায়ালার নিরাপত্ত্বায় থাকবে না। কেননা নিজেকে সে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।


• দেখুন, সুদ খাওয়া ও দেয়া উভয়টিই হারাম। একইভাবে ঘুষ নেয়া ও দেয়াও হারাম। হাদীসে কিন্তু এর বাইরে আরো কিছু মানুষের কথা বলা হয়েছে, যারা কোন না কোন ভাবে এই হারাম কাজগুলো ঘটার পেছনে ভূমিকা রাখে। যাদের সমর্থন ও সহযোগিতায়ই সংঘটিত হয় এগুলো। আর একারণে সরাসরি সুদ ঘুষ না খেলেও তাদের অপরাধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন সুদের ব্যাপারে হজরত জাবের রাঃ নবিজির হাদীস বর্ণনা করছেন, রাসুল সাঃ অভিসম্পাত করেছেন সুদখোর, সুদ দাতা, এর লেখক এবং সাক্ষীদেরকে। তিনি বলেছেন, এরা সকলেই সমান (গোনাহগার)। সহি মুসলিমঃ ১৫৯৮


লক্ষণীয় ব্যাপার হল, সুদের লেখক ও সাক্ষীদের ভূমিকা শুধুই সুদী কারবারটি সংঘটিত হতে সাহায্য করা। তবুও পাপ ও যুলুমে সাহায্য করার ব্যাপারে ইসলামের যে মৌলিক নিষেধাজ্ঞা এটি এখানেও কার্যকর রয়েছে। একই কথা ঘুষের ক্ষেত্রেও। নবিজি বলেন, ঘুষ যে খায়, যে দেয়, এবং এই দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি করে দেয়, সবার উপর অভিসম্পাত। কাশফুল খাফাঃ ২/১৮২


• যুলুম ও যালেমকে সহযোগিতা বিষয়ে হাদীস থেকে আরেকটি বিশেষ শিক্ষা আমরা পাই। হাদীসে বারবার বলা হয়েছে যে ব্যক্তি কোন কাজের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে, সে সরাসরি ঐকাজ করছে বলে ধরা হবে। (ফয়জুল কাদীরঃ ৭৬৬)


সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি বলেছেন, জমিনে যখন পাপ করা হয়, তখন পাপের স্থানে উপস্থিত ব্যক্তি যদি একে অপছন্দ করে তাহলে সে সেখানে অনুপস্থিত বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু কেউ সেখানে অনুপস্থিত হওয়ার পরও পাপটিকে যদি পছন্দ করে, এর প্রতি সন্তুষ প্রকাশ করে, তাহলে সে পাপে উপস্থিত হিসেবে গণ্য হবে। সুনানে আবু দাউদঃ ৪৩৪৫


তাছাড়া পাপের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশকে এতটা ভয়াবহ গণ্য করার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এর মাধ্যমে পাপের প্রতি মানুষের যে দূরত্ব থাকার কথা, সেটা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ফলে আজ হোক কাল হোক, সেও এমন পাপের সাথে জড়িয়ে যেতে পারে।


যুলুমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যে যালেমকে সাহায্য করছে, সে এই যুলুমের প্রতি সম্মত ও সন্তুষ্ট, সে জন্যই তো এতে সাহায্য ও সমর্থন করছে। সন্তুষ্ট যদি না হত, তাহলে সাহায্য করার তো প্রশ্নই উঠে না।

• হাদীসের আরেকটি শিক্ষাও এখানে প্রাসঙ্গিক। নবীজি বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভায়ের জন্য সে জিনিস পছন্দ করে যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (সহি বুখারিঃ ১৩)
স্পষ্ট কথা, কেউই নিজে জুলুমের শিকার হওয়াকে পছন্দ করবে না। তাহলে অপর মুসলিম ভাই যখন নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে, তখন সে যালেমকে কিভাবে সহযোগিতা করছে? এই সহযোগিতা স্পষ্টতই হাদীসের উক্ত শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক।

• তাছাড়া কোন মুসলিম যদি যুলুমের শিকার হয় তাহলে হাদীসে বলা হয়েছে মযলুমকে সাহায্য করো। মুসলিম মুসলিমের ভাই, এই ভ্রাতৃত্বের দাবী হিসেবে বলা হয়েছে, সাহায্যের প্রয়োজন হলে এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে সাহায্য না করে, শত্রুর হাতে তুলে দিবে না। (সহি মুসলিম) মাজলুমকে শুধু সাহায্যই নয়, হাদীসে তো যালেমকে যুলুম থেকে বিরত রাখার জোরালো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নবীজি বলেন, মানুষ যখন যালেমকে যুলুম করতে দেখেও তাকে বারণ করবে না, তখন এই আশঙ্কা রয়েছে আল্লাহ সবাইকে শাস্তি দিবেন। সুনানে আবু দাউদঃ ৪৩১৬
একজন মুসলিমের প্রতি যেখানে হাদীসের নির্দেশনা হচ্ছে মাযলুমকে সাহায্য করা এবং যালেমকে সর্বাত্মকভাবে প্রতিহত করা, সেখানে যালেমকে উলটো সহযোগিতা করার দ্বারা নবীজির কতগুলো নির্দেশনা অমান্য করা হচ্ছে? এবং এর ভয়াবহতা কীরকম তা কি আমরা টের পাচ্ছি?!

পূর্বসুরি ইমামদের দৃষ্টিতে যুলুম ও যালেমকে সহযোগিতা

সালাফ বা পূর্বসুরি ইমামদের কর্মপন্থার স্থান ইসলামে  অনেক উঁচু ও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নবীজির ঘোষনা হচ্ছে, শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম হচ্ছে আমার সময়ের মানুষ। তারপর শ্রেষ্ঠ তাদের পরবর্তিরা। এরপর শ্রেষ্ঠ হচ্ছে তাদের পরে যারা আসবে। তাদের পরে মিথ্যা ও খেয়ানত ব্যাপকতা লাভ করবে। সুনানে তিরমিযিঃ ২৩০৩। এখান থেকে নবীজির সাহাবি, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের মর্যাদা ইসলামে বিশেষভাবে স্বীকৃত। তাদের কর্মপন্থা পরবর্তি মুসলিমদের জন্য অনুকরণীয় ও আদর্শ। এর কারণ হচ্ছে, হাদীসে যেমন বলা হয়েছে, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনে তাদের অতুলনীয় নিষ্ঠা ও সর্বোচ্চ বিসর্জন। ইসলামে এটি তর্কাতীত ও প্রতিষ্ঠিত বিষয়। আর এজন্য একজন মুসলিম কুরআন ও হাদীসের পাশাপাশি এটাও বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন, নবীজির সাহাবিগন, তাদের পরবর্তি প্রজন্ম তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগন কুরআন ও হাদীসের বিধানগুলো বাস্তব জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করেছেন। তাঁদের পদাঙ্ক ধরেই যথাযথভাবে ইসলামি বিধি বিধান পালন করা সম্ভব।

যুলুম ও যালেমকে সহযোগিতা করা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য গত দুই লেখায় আমরা তুলে ধরেছি। এই নিবন্ধে আমরা দেখব, ইসলামের মহান পূর্বসুরি ইমামগণ কুরআন ও হাদীসের শিক্ষাটি নিজেদের জীবনে কিভাবে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারব, তারা যালেমকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে এতটাই সজাগ ছিলেন, যা আমরা হয়তো অনেক সময় কল্পনাও করতে পারি না।

ইমাম সুফিয়ান সাওরি রহঃ ছিলেন কুফার শীর্ষ ফকীহ ও মুহাদ্দিস। হাদীসের সকল কিতাবেই তাঁর সূত্রে বিপুল সংখ্যক বর্ণনা রয়েছে। ইমাম যাহবি লিখেছেন, একবার এক দর্জি তাঁর কাছে এসে বলল, আমি একজন দর্জি। বাদশার কাপড় সেলাই করে দিই। (সেই বাদশা যালেম ছিল।) আমি কি যালিমের সাহায্যকারি হিসেবে গণ্য হব? সুফিয়ান সাওরি উত্তরে বললেন, বরং তুমি সরাসরি যালেম। আর যালেমের সাহায্যকারি হবে সে ব্যক্তি যে তোমার কাছে সূঁচ ও সুতা বিক্রি করে থাকে। (হাফেজ যাহাবি কৃত আল কাবায়েরঃ ১১২) লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, সে সময়ের একজন সাধারণ দর্জিও এ ব্যাপারে সজাগ ছিলেন, যুলুম করা যেমন নিষিদ্ধ ও খারাপ কাজ, এতে সহযোগিতা করাটাও ভয়াবহ। এজন্যই তিনি তার কাজটি যুলুমে সহযোগিতার মধ্যে গণ্য হবে কি না, এটা যাচাই করার জন্য সময়ের একজন শীর্ষ আলেমের কাছে জানতে চাইছেন।

ইমাম আহমদকে তো পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁর নামই পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট। তিনি মুসলিম উম্মাহর বরেণ্য চার ইমামের একজন। একাধারে মুহাদ্দিস ফকীহ সাহসী বীর ও বুযুর্গ ব্যক্তি। ইসলামী ইতিহাসে একটা সময় এসেছিল যখন কয়েকজন আব্বাসী খলীফা ইসলামের একটি স্বীকৃত আকীদাকে অস্বীকার করে বসেন। শুধু তাই নয়, ইসলামি পন্ডিত ইমাম আলেমদেরও তারা ভ্রান্ত বিশ্বাসটি গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। কিন্তু অনেক আলেমই স্পষ্টভাবে তাদের সেই আবেদনটি নাকচ করে দেন। শুরু হয় তাদের উপর সীমাহীন নিপীড়ন ও যুলুম। এসকল প্রতিবাদি আলেমদের শীর্ষে যিনি ছিলেন, এবং সবচে বেশি নির্যাতন সহ্য করেছেন, তিনি হলেন ইমাম আহমদ রহঃ। এই ইমাম আহমদ সম্পর্কে আবু বকর আল মারওয়াযি লিখেছেন, তারা যখন ইমাম আহমদকে জেলে বন্দি করল তার কাছে এক কারারক্ষি আসল। সে তাঁর কাছে জানতে চাইল, আবু আব্দুল্লাহ, যালেম ও তার সহযোগিদের সম্পর্কে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে, এটি কি সহিহ? ইমাম আহমদ বললেন, হ্যাঁ। কারারক্ষি প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি আমি যালেমদের সহযোগি হিসেবে বিবেচিত হব? ইমাম আহমদ তাকে বললেন, যালেমদের সহযোগি সেই ব্যক্তি যে তোমার চুল কেটে দেয়, কাপড় ধুয়ে দেয়, তোমার খাবার প্রস্তুত করে, তোমার সাথে লেনদেন করে। আর তুমি তো সরাসরি যালেম। (ইবনুল মুফলিহ কৃত আল ফুরুউঃ ১১/১৪৫) এখানেও লক্ষনীয়, একজন কারারক্ষীর মনেও যুলুমে সহযোগিতার স্পর্শকাতরতাটি কত জোরালোভাবে বিদ্যমান!

প্রখ্যাত তাবেঈ হাসান বসরী রহঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন যালেমের জন্য দীর্ঘ জীবন লাভের দোয়া করল, সে তো আল্লাহর অবাধ্যতা করা হোক, এটা পছন্দ করল। (ইমাম বাইহাকী সংকলিত শুয়াবুল ঈমানঃ ১২/৪১)

 হাদীস ও তাফসীরের ইমাম প্রশিদ্ধ তাবেঈ হজরত আতা ইবনে আবি রাবাহ রহঃ বলেছেন, কারো জন্য বৈধ নয় কোন যালেমকে সাহায্য করা, যালেমের জন্য কিছু লেখা, তার সংগী হওয়াও বৈধ নয়। এর কোন কিছু যদি কেউ করে, তাহলে সে যালিমের সহযোগি হিসেবে বিবেচিত হবে। (তাফসীরে কুরতুবি, সুরা ক্বাসাসঃ ১৭)

হাফেজ ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন, পূর্ববর্তি বহুসংখ্যক ইমাম বলেছেন, যালেমদের সহযোগি হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে তাদের কলমের কালি প্রস্তুত করে দেয়, কিংবা বাশ চেছে কলম বানিয়ে দেয়। আবার তাদের কেউ কেউ বলেছেন, যালেমদের সহযোগি হল যে ব্যক্তি তাদের কাপড় ধুয়ে দেয়। (মাজমুউল ফাতাওয়াঃ ৭/৬৪)

মাইমুন ইবনে মিহরান বলেছেন, যালেম, যুলুমে সাহায্যকারি, এবং যুলুম পছন্দকারি, সকলেই সমান (অপরাধি) (খারায়েতি রচিত মাসাইউল আখলাকের সূত্রে মাওসুআতুল আখলাক আল ইসলামিয়াঃ ২/৩৩৩)

তাউস ইবনে কাইসান ছিলেন প্রথমসারির বরেণ্য পন্ডিত তাবেঈ। তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে তাউসও হাদীস ও ফিকহের বড় ইমাম হয়েছিলেন। এই আব্দুল্লাহ ইবনে তাউস ও ইমাম মালেককে আবু জাফর মানসুর একবার ডেকে পাঠালেন। ইমাম মালেক বলেন, আমরা যখন মানসুরের কাছে গেলাম তিনি সজ্জিত গোছানো বিছানায় বসে ছিলেন। তার সামনে শাস্তি প্রয়োগ করার চাটাই বিছানো ছিল। আর ছিল কয়েক জন জল্লাদ, যারা মানুষের মাথা উড়িয়ে দিচ্ছিল। মানসুর আমাদের ইশারা করে বসতে বললেন। আমরা বসে গেলাম।

তিনি দীর্ঘ সময় মাথা নিচু করে রইলেন। অতঃপর ইবনে তাউসের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আপনার পিতা থেকে আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি আমার পিতাকে বর্ণনা করতে শুনেছি, নবীজি বলেছেন, কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি সবচে ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হবে যাকে আল্লাহ তায়ালা শাসন করতে দিয়েছেন, কিন্তু সে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে যুলুম করেছে।

খলীফা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। ইমাম মালেক বলেন, আমি কাপড় গুটিয়ে ফেললাম এই আশঙ্কায় যে তাঁর রক্ত আমার শরীরেও লেগে যাবে। তারপর খলীফা তাঁকে দোয়াতটি এগিয়ে দিতে বললেন। তিনি দিলেন না। এভাবে তিনি তিনবার বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাকে কেন দোয়াত দিচ্ছেন না? তিনি বললেন, আমি আশঙ্কা করেছি, এই দোয়াত দিয়ে আপনি কোন পাপের কথা লিখবেন, ফলে এতে আমিও আপনার অংশীদার হয়ে যাব! খলীফা একথা শুনার পর বললেন, আপনারা এখান থেকে উঠে যান। আব্দুল্লাহ বললেন, আমরা এটাই চাচ্ছিলাম। ইমাম মালেক বলেন, সে দিন থেকে আমি আব্দুল্লাহ ইবনে তাউসের মর্যাদা বুঝতে পারছি। ওয়াফায়াতুল আ’য়ানঃ ২/৫১১

ইমাম আবু হানিফার ঘটনাটি তো সবারই জানা। এই আব্বাসি খলীফা মানসুরই তাকে প্রধান বিচারকের পদ গ্রহণ করতে বলেছিলেন। তিনি শপথ করে বলেছিলেন, আপনাকে বিচারকের পদ নিতেই হবে। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা কিছুতেই পদটি গ্রহণ করতে সম্মত হননি। ফলস্বরূপ তাঁকে বেত্রাঘাত করা হয়েছে। যেতে হয়েছে কারাগারে। এবং তিনি সেখানেই ইন্তিকাল করেছেন। সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ ৬ঃ ৪০২

কেন তিনি খলীফা মানসুরের বিচারক হতে চাননি? ইমাম আবু হানিফা দেখেছেন, খলীফা মানসুর একজন যালেম শাসক। তার অধীনে কাজ করলে যুলুমের সমর্থন ও সহযোগিতা করতেই হবে। যুলুম করা যেমন অপরাধ ও কদর্য বিষয়, যুলুমে সহযোগিতাও কদর্য ও নিষিদ্ধ। ইমাম আবু হানিফা সত্য ইনসাফ ও ন্যায়ের পক্ষের মানুষ ছিলেন, তিনি ছিলেন সততার আদর্শে উতসর্গিত প্রাণ। ফলে ক্ষমতাধর বাদশার পক্ষ থেকে বিচারক পদের প্রলোভন, তারপর হুমকি ধমকি, শারীরিক নীপিড়ন, কারাবাস এর কোন কিছুই তাকে সত্য থেকে টলাতে পারে নি। তিনি তো জীবন দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু যুলুম ও যুলুমে সহযোগিতার সামনে মাথা নত করেন নি।

যুলুম থেকে হেফাজত করুন, যালেমকে সহযোগি হওয়া থেকেও রক্ষা করুন, মহান রবের কাছে এই মোনাজাত করি!

শেয়ার করুন

image_print
Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া