নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি

পশ্চিমাদের প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা ধারণা ও তত্ত্বগুলোর মাঝে সবচে বড় মিথ্যা হলো, বাকি দুনিয়া কে এ কথার উপর বিশ্বাসী করে তোলা যে, একমাত্র তাদের মূল্যবোধই হলো বৈশ্বিক এবং নিরপেক্ষ। কিন্তু এ কথাটি অধিকাংশ মানুষের অজ্ঞাতেই থেকে যায়, পশ্চিমের মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে তার নিজস্ব বিশ্ববিক্ষণ এবং দর্শনের উপর ভিত্তি করে। বাকি দুনিয়ার বিশ্বাস,আইন ও মূল্যবোধের সাথে এর বিস্তর পার্থক্য এবং যোজন দূরত্ব রয়েছে। ঠিক যেরকম আমেরিকা তার ডলার কে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত করছে, ডলারকে বিশ্ববাজারের লেনদেনের মানদণ্ড হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছে, তেমনই পশ্চিমও তার জ্ঞান, চিন্তা, মূল্যবোধ ও আদর্শের মুদ্রা ছেপে সবাইকে বলে, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লেনদেনের জন্য একে সর্বজনীন মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করো। ফলে, যেভাবে ডলারের সম্পর্ক হলো আমেরিকার অর্থনীতির সাথে, পশ্চিমের মূল্যবোধ আর মতাদর্শও সম্পর্কিত তার নিজস্ব বিশ্বাস এবং বিশ্ববিক্ষণের সাথে। সুতরাং যদি একটা বার্থ হয়, তাহলে অপরটিও বার্থ হবে।


ঠিক একারণেই “মূল্যবোধের” যে পশ্চিমা ধারণা আছে, তথা মানবাধিকার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক ন্যায্যতা, এবং সমতা ইত্যাদির পশ্চিমা সংস্করণই পুরো দুনিয়া-জুড়ে সর্বব্যাপ্ত এবং প্রচলিত। এখন আপনি পৃথিবীর যে দেশেই যান, যদি এইসব “পবিত্র” ও “অলঙ্ঘনীয়” শব্দাবলী আওড়াতে থাকেন, তাহলে আপনি খুব সহজেই এবং তৎক্ষণাৎ কিছু নৈতিক মুদ্রা লাভ করতে পারবেন। এই শব্দগুলো মূলত সেক্যুলার লিব্যারাল মতাদর্শের শ্রুতিমধুর প্রতিশব্দ (euphemism) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং শব্দের প্রকৃত অর্থ, যা আমাদের মনে ভেসে উঠে, এর খুব সামান্যই ধারণ করে এসব মতাদর্শ।

অপরদিকে ইসলাম এমনসব আদর্শ ও শব্দের জোর প্রচার করছে, যা প্রকৃত অর্থেই সর্বজনীন এবং পৃথিবীর সকল ধর্ম ও মতাদর্শের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। যেমন, ন্যায়বিচার, ভারসাম্যতা, অধিকার এবং স্বাধীনতা। পশ্চিমা লিবারেল মতাদর্শের বাইরে ইসলাম এই শব্দগুলোকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। যেখানে শব্দের অর্থ যথার্থভাবেই তার আদর্শকে ধারণ করছে।


এমন বহু শব্দ আছে, যার একান্ত নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে, যা অন্য কোনো সমাজ সংস্কৃতি ধর্ম ও মতাদর্শে পাওয়া যায়না। যেমন, (সেক্যুলার) গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, নারীবাদ, মানবতাবাদ, এবং উদারতাবাদ (Liberalism)।
তো,পশ্চিমা বিশ্ব বীক্ষণ ( অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাংক) এই শব্দগুলোকে অত্যন্ত দামী এবং গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহু মুসলিম এই শব্দগুলো গ্রহণের মাধ্যমে তাদের কাছে ধরাশায়ী হন। এইসব শব্দের উপর পশ্চিমা সমাজের যে দাবী রয়েছে সেটা মিটাতে গিয়ে নিজেকে বিলীন করে দেন। আমরা আজকাল প্রায়শ দেখি অনেক মুসলিম সেক্যুলার গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, নারীবাদ, মানবতাবাদ এবং উদারতাবাদ জাতীয় শব্দাবলী অনায়াসে ব্যাবহার করছেন, স্রেফ নিজেদের ইনসাফ লাভের জন্য না, বরং স্বয়ং ইসলামের মতাদর্শ হিসেবে এগুলো কে ব্যাখ্যা করছেন!


বিশেষত পশ্চিমা উপনিবেশবাদ মুসলিম দুনিয়ার জাগ্রত মানস কে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবার পর তারা অত্যন্ত বিপদজনক-ভাবে এসব মুদ্রার ব্যবহার শুরু করেন ইসলামকে ব্যাখ্যা করার জন্য।
মুসলিমরা অতি সরলতা-বশত বিশ্ব বাজারে প্রচলিত যেকোনো শব্দকেই গ্রহণ করে নেন, এবং নিজেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে থাকেন। এই শব্দ যে সম্পূর্ণ বিজাতীয় এবং মারাত্মক রকমের ইসলাম পরিপন্থী আদর্শকে ধারণ করে, সে ব্যাপারে সামান্যই সচেতন থাকেন। তাদের অজুহাত হলো, এইসব শব্দের যদি সুনির্দিষ্ট ধ্রুব কোন অর্থ থাকেও, যা পশ্চিমা মতাদর্শ থেকে গড়ে উঠেছে, তথাপি একে আমরা আমাদের মতো করে ভিন্ন অর্থে সংজ্ঞায়িত করে ব্যবহার করতে পারবো।


কেউ আবার একধাপ এগিয়ে শব্দগুলোকে কিঞ্চিৎ মেরামত করে নেন, এবং শুরুতে “ইসলামি” শব্দটা জুড়ে দেন, যেন একে সর্ব-মহলে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেন। যেমন “ইসলামি গণতন্ত্র, ইসলামি নারীবাদ, ইসলামি সমাজতন্ত্র” ইত্যাদী৷ এক্ষেত্রে আমেরিকায় প্রচলিত একটি প্রবাদের কথা স্মরণ হয়– একটা শুকরকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব, যদি তার লেজে একটি ফিতা বেঁধে দাও, এবং গায়ে কিছু সুগন্ধি ছিটিয়ে দাও। কিন্তু তখনও সেটা একটা শুকরই থাকবে।


রাসূল সা: সাহাবীদেরকে মদের পাত্র ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন, যদিও তারা এতে করে পানি পান করতেন। কেননা এগুলো নিছক সাধারণ কোন পাত্র না, মদের পাত্র, এবং এগুলোর ভিন্ন একটি দ্যোতনা রয়েছে। তো, ভিন্ন দ্যোতনা রাখে, যা সম্পূর্ণ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, এমন শব্দ মুসলমানরা কী হিসেবে ব্যাবহার করেন! তাদের এই বিষয়টা স্রেফ মদের পাত্র ব্যবহারের সাথে সমতূল্যই না, বরং এই পাত্রগুলো দিয়ে মদ পান করার শামিল, এবং “মদ” পান করে বলেন যে, এটা তো “মদ” না। ( রাসূল সা: সত্যিকারার্থেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন,কিছু মুসলিম মদ পান করবে ঠিকই, কিন্তু একে মদ হিসেবে স্বীকার করবেনা।)


আমরা দেখি মুসলিমরা বলেন – আমি যখন সেক্যুলার গণতন্ত্রের ( secular democracy) কথা বলি তখন আমি মূলত এর মাধ্যমে নেতা ও নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা বুঝাই, আল্লাহর কর্তৃত্ব ও শাসনকে অস্বীকার করিনা”। তারা এই অর্থ দাঁড় করান Democracy শব্দের সত্তা-গত অর্থের দিকে না তাকিয়েই। “demos kratos” এর অর্থ হলো, চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব এবং বিধান প্রণয়ন মানুষের হবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। তথাপি মুসলিমরা যদি তাদের দাঁড় করানো নিজস্ব অর্থের উপর অটল থাকেন এবং এই শব্দই (secular democracy) ব্যবহার করতে চান, তাহলে তাদের জন্য সহজ একটি প্রশ্ন হলো: আপনি যদি গণতন্ত্র বলতে স্রেফ নেতা নির্বাচন বুঝে থাকেন, বিধান ও শাসনের ক্ষেত্রে আল্লাহর কর্তৃত্বকে অস্বীকার না করেন, তাহলে গণতন্ত্রের পাশাপাশি ধর্ম-তন্ত্রেও (theocracy) আপনার কোন আপত্তি থাকার কথা না। তাহলে গণতন্ত্রের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করবেন, কিন্তু রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র চলবে আল্লাহর আইনে, এটা কি মানেন? এই বিপরীত যুক্তিতে সততার সাথে একমত হওয়ার মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে।


কতিপয় মুসলিম বলেন, নারীবাদ মানে হলো স্রেফ নারীদের অধিকার বিষয়ক দাবী দাওয়ার আন্দোলন। যদিও সকল আইনি প্রতিষ্ঠানই নারীদের অধিকার নিশ্চিত করেছে, বিতর্ক কেবল অধিকারগুলো কী, সেটা ঠিক করা নিয়ে। সেক্ষেত্রে নারীবাদের দাবী হলো সর্বক্ষেত্রে চূড়ান্ত সমতা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে লিঙ্গ ভিত্তিক আচরণের নির্মূল, নারীদেরকে সমস্ত দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা, শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী নারী পুরুষের কাজ কর্মের যে বিভাজন তার বিরোধিতা করা এবং অবশ্যই এসবের মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা গড়ে তোলা। তো, মুসলিমরা যদি নারীবাদ বলতে স্রেফ নারী অধিকার নিয়ে কথা বলা বুঝে থাকেন এবং এই শব্দ ব্যবহারের যুক্তি দাঁড় করান, তাহলে এর বিপরীতে তাদের কে পুরুষ-বাদ (Masculinism)কেও সানন্দে সমর্থন করা উচিৎ। নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও অধিকার আছে নিশ্চয়, সেটার সমর্থন করা কি উচিৎ নয়? কতজন একমত হবেন এই বিপরীত যুক্তির সাথে?


কেউ কেউ মনে করেন সেক্যুলারিজম মানে স্রেফ এই ইহজগতের বস্তুগত কিছু কাজ কারবার, যেমন রাস্তা নির্মাণ করা, পানির ব্যবস্থা করা, স্কুল কলেজ নির্মাণ করা ইত্যাদি। ধর্ম বা পরকালের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই। তারা এমনকি এই দাবীও করে বসেন যে, ইসলামের ইতিহাসের মুসলিম খলিফারাও ছিলেন সেক্যুলার এবং সেক্যুলারিজমই রাসূলের সা: শিক্ষা!!


কিন্তু সেক্যুলারিজম বলতে আদৌ এমন কিছু কে বুঝায় না। এই শব্দ একটি বিশাল রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করে, যার মূল কথা হলো, রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে সবধরনের ধর্মীয় বোধ, বিশ্বাস, দর্শনকে আলাদা করা। এর মানে হলো, সেইসব আইন ও নৈতিকতাকে অস্বীকার করা, যেগুলো বাহ্যিক লাভ ক্ষতির বিবেচনার বাইরে। মানে,সেইসব কাজকেই ভালো মন্দের তালিকায় রাখা হবে, যে কাজগুলোর লাভ ক্ষতির দিকটি প্রকাশ্যে বুঝা যায়। এর বাইরে ধর্মীয় আইন বা সত্তা-গত মূল্যবোধের কোন মূল্য থাকবে না। যেমন পরকীয়া, প্রকাশ্যে ধর্মাবমাননা, সুদি ব্যাংকে লেনদেন, নারীদের যৌন হেনস্থা, মদপান ইত্যাদি সবকিছুই তখন বৈধ হয়ে যাবে। কেননা এসব কাজ থেকে বিরত রাখতো যে ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও নৈতিক মূল্যবোধ, এর কোনটাই সেক্যুলারিজমে গ্রহণযোগ্য না।


যদি সেক্যুলারিজম বলতে কেবল বস্তুগত উন্নতি বুঝায়, তাহলে পৃথিবীতে এমন কোন সেক্যুলারিস্ট কি আছে,যে সংবিধান হিসাবে আল্লাহর এই বাণী কে মেনে নেবে: “যখন তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ো তখন আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে যাও সমাধানের জন্য।” অথচ এটাই ছিল মদিনার সংবিধান।

রাস্তা নির্মাণ,খাল নালা তৈরি,স্কুল কলেজ বানানো এসবের কোনটাই নিরপেক্ষ ও ধর্মহীন কোন কাজ না, বরং এর পেছনে কোন না কোন চিন্তা, ধর্ম বা মতাদর্শ তাকে উৎসাহিত করে এসব করতে। কোন সরকার যদি রাস্তা তৈরি করে এই উদ্দেশ্যে যে, রাস্তা নির্মাণ করে মানুষের সেবা করলে আল্লাহ খুশি হবেন, তাহলে অবশ্যই একে সেক্যুলার কাজ বলা যাবেনা! কোন সরকার এই হিসেবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করেনা যে, এসব বানানোটাই স্বাভাবিক, সকলেই বানায়। কেননা, রোমান সাম্রাজ্য ও ইসলামী খেলাফতের উদাহরণ বাদ দিলে, পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর কেটেছে সরকারিভাবে কোন রাস্তাঘাট বানানো ছাড়াই। সরকার তখনই এসব উন্নয়ন কর্মে হাত দিবে যখন সে কোন নির্দিষ্ট মতবাদ কিংবা ধর্মকে লালন করবে, (যেমন,কমিউনিজম, লিবারেলিজম অথবা ইসলাম) যে মতবাদ বা ধর্ম তাকে উৎসাহিত করবে যে, রাষ্ট্রের উচিৎ জনগণের নিরাপদ জীবন যাপন সহজের জন্য এসব উন্নয়নমূলক কাজ কর্ম করা হোক।


যদি তাই হয়,তাহলে যেসব মুসলিম সেক্যুলারিজমকে কেবল বাহ্যিক উন্নতির অর্থে গ্রহণ করে নিয়েছেন তারা কি “সেক্যুলার সরকার” এর পাশাপাশি “ধর্মীয় সরকার”কেও সমানভাবে মেনে নিবেন? যেহেতু ধর্মীয় সরকারও রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, খাল নালা ইত্যাদি বস্তুগত উন্নয়নে এগিয়ে আসবে, ধর্মীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই! নিতান্ত বোকা সেক্যুলার না হলে এতে কেউ রাজি হবেনা।


মানবতাবাদ(Humanism) কে গ্রহণ করেছেন অনেক মুসলিম। তাদের দাবী হলো, মানবতাবাদ মানে হলো মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকা। মুসলিমদের জন্য এটাও ভ্রান্ত এবং সরল বিশ্বাস। কেননা,মানবতাবাদ বলতে একটি মানব সর্বস্ব বা মানব কেন্দ্রিক মতবাদকে বুঝায়। যে মতবাদে “মানুষই হলো সবকিছুর একমাত্র পরিমাপক” এবং ” ইহকাল”ই হলো তার সকল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু, এর বাইরে আর কিছুতেই সে বিশ্বাসী না, এমনকি আল্লাহও। এর ফলস্বরূপ দেখা যায়, আজকের যুগে মানবতাবাদী (Humanist) মাত্রই নাস্তিক হয়ে থাকেন। নাস্তিকতা যদি হয় তার আকায়েদ (বিশ্বাস), তাহলে মানবতাবাদ হলো সেই আকায়েদের ধর্ম।


তথাপি,মুসলিমরা যদি নিজেদের কে মানবতাবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে চান, মানবাধিকার রক্ষার নামে, তাহলে “ঐশী আইন” (divine law) শব্দটি গ্রহণ করে নিতেও কোন আপত্তি থাকার কথা না। যেহেতু এটাও মানবাধিকার রক্ষার প্রতি সমান বা বেশী গুরুত্ব দেয়, এবং সেটা আল্লাহ কেন্দ্রিক আদর্শ থেকে আসে।


সেইসব মুসলিমরা যদি এই শব্দগুলো ব্যাবহারে এতোটাই অকৃত্রিম ও আলাভোলা হয়ে থাকেন,যেহেতু “এগুলোর গ্রহণযোগ্য অর্থও আছে”,সুতরাং সমস্যা নাই, তাহলে দেখা যাক নিম্নের শব্দগুলো ব্যবহারে তারা একমত হন কিনা, এগুলোর নতুন ” গ্রহণযোগ্য অর্থ” (অজুহাত) অনুসারে:-

  • ইসলামি বহু-ঈশ্বরবাদ: এর দ্বারা “স্রেফ এটা বুঝায়” যে, এক আল্লাহতেই বিশ্বাস রাখা, শুধু তার নাম ভিন্ন ভিন্ন।
  • ইসলামি ফ্যাসিবাদ: এর অর্থ হলো ঐক্যের মাধ্যমে শক্তিশালী হওয়া।
  • ইসলামি সমাজতন্ত্র: এর অর্থ হলো সম্প্রদায়ের মূল্যবোধকে সম্মান করা।
  • ইসলামি নাস্তিক্যবাদ: মানে, মিথ্যা প্রভুর ইবাদতকে অস্বীকার করা, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইবাদতকে অস্বীকার করা না!
  • ইসলামি মূর্তিপূজা: এর মানে হলো, অতীত ও বর্তমানের মুসলিম বীরদের সম্মান প্রদর্শন করা, কীর্তিমান ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাদের মূর্তি বানিয়ে রাখা, আক্ষরিক অর্থে না যদিও!
  • ইসলামি বর্ণবাদ: মানে,আমরা কেবল আদম আঃ এর জাতীকেই সম্মান করি।
  • ইসলামিক স্যাটানিজমঃ মানে, আমরা শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি, এবং তার কাজের বিরোধিতা করি।
  • ইসলামি ত্রিত্ববাদ: এর অর্থ হলো,আল্লাহর তিনটি বিশেষ ব্যাপারে উপর আমরা বিশ্বাস রাখি,তথা তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ, তাওহীদে উলুহিয়্যাহ, তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত।

কোন সন্দেহ নেই, এই নতুন শব্দাবলী এবং তার অর্থসমূহ খুবই উদ্ভট এবং হাস্যকর। কেউ যদি এসব শব্দ ব্যবহার করে এবং উপরোক্ত উপায়ে ব্যাখ্যা করে, তাহলে আমরা তার বোকামিতে হেসেই খুন হবো! কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন, তথাকথিত “ইসলামি নারীবাদ, ইসলামি সেক্যুলারিজম, ইসলামি গণতন্ত্র এবং ইসলামি মানবতাবাদ” জাতীয় শব্দও সমান হাস্যকর এবং উদ্ভট, যখন মুসলিমরা অবলীলায় এগুলো ব্যবহার করেন, এবং এসবের পেছনে কাল্পনিক অজুহাত দাঁড় করান।

মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই এসব নকল মুদ্রার ব্যবহার বর্জন করতে হবে। আমাদের উচিৎ এমন সব ধার করা শব্দ ব্যবহার না করা, যেগুলো পূর্ব থেকেই কোন বিশেষ মতবাদ, বহুল প্রচলিত অর্থ এবং ইসলামবিরোধী আদর্শকে ধারণ করে। বরং স্বয়ং ইসলাম আমাদেরকে যে শব্দাবলী দিয়েছে, কুরআন হাদীস ও ফিকহে, এসব বিষয়ের উপযোগী করে, সেগুলো ব্যবহার করা দরকার। অথবা সেইসব শব্দের যথোপযুক্ত তর্জমা (অনারব মানুষদের জন্য) ব্যবহার করা যেতে পারে।


মুসলিমরা যদি পশ্চিমা শব্দগুলো ব্যবহার করেন, যেগুলোর মতাদর্শিক অর্থ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত, তাহলে সেসব শব্দই মুসলিমদের জন্য পশ্চিমা আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠার প্রধান ভূমিকা পালন করবে। এবং এভাবেই পশ্চিম তার মতাদর্শকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আপনি যদি আরব খৃষ্টানদেরকে তাওহীদ শব্দটা শিখান তাদের ত্রিত্ববাদ বা আল্লাহর ধারণাকে বুঝানোর জন্য, তাহলে দুয়েক প্রজন্ম পরের খৃষ্টানরা ত্রিত্ববাদ বলে আর কোনকিছুকে চিনতে পারবেনা, সবাই তাওহীদ বিশ্বাসী হয়ে যাবে।


কতক মুসলিম আবার এতোটাই সরল চিন্তা করেন যে, তারা মনে করেন এইসব শব্দের পেছনে যে মতবাদ আছে,তার কেবল ভালো দিকগুলোই আমরা গ্রহণ করতে পারি, এতে কোন সমস্যা হবেনা। এই চিন্তা যে কতটা বিপদজনক, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, তার একটা মানদণ্ড আগে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে ঠিক করে তারপর অন্যদের টা দেখা উচিৎ। যতদিন পর্যন্ত কুরআন এবং রাসূল সাঃ এর শিক্ষা আমাদের কাছে সবচে ব্যাপক, বিশুদ্ধ এবং স্পষ্ট পথ নির্দেশক হিসেবে আছে, ততদিন পর্যন্ত ভালো মন্দের নির্ণায়ক অন্যকিছু হতে পারেনা।

একবার হযরত উমর রাযিঃ রাসূল সা: এর কাছে আহলে কিতাবদের কিছু বইপত্র নিয়ে আসলেন এবং সেখান থেকে পাঠ করতে লাগলেন। এতে রাসূল সা: খুবই রাগান্বিত হলেন। বললেন, আমি তোমার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বিধান নিয়ে এসেছি সেটাই অধিকতর সুস্পষ্ট এবং বিশুদ্ধ। তাদের কাছে কোনকিছু জিজ্ঞেস করতে যেওনা, হতে পারে তারা তোমাকে ভালো কিছু বলল কিন্তু তুমি তা অস্বীকার করে বসলে, অথবা তারা মন্দ কিছু বলল, কিন্তু তুমি তা মেনে নিলে! সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ,আজ যদি হযরত মুসা আঃ জীবিত থাকতেন, তাহলে তিনিও আমারই অনুসরণ করতেন। (মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৮৭) যদি ওহির বিধানেই সবকিছুর সমাধান হয়ে থাকে,তাহলে এর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বা যৌক্তিকতা কী?
আল্লাহ বলেনঃ এই কিতাবে আমি কোনকিছুকেই উপেক্ষা করিনি
( কুরআন-৬/৩৮) আল্লাহ আরও বলেনঃ আমি তোমার কাছে এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ, এবং মুসলমানদের জন্য হেদায়েত, দয়া এবং সুসংবাদ স্বরূপ। ( কুরআন-১৬/৮৯)

সুতরাং চলুন পশ্চিমকে আমরা তাদের “বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিকতার মুদ্রাগুলো” ফিরিয়ে দেই। নিশ্চিতভাবেই এই শব্দগুলো তাদের মতাদর্শ ও বিশ্বাসকেই ধারণ করে এবং তাদের ক্ষেত্রেই এগুলো প্রযোজ্য। আমরা আমাদের কুরআন সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার করবো, যেগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: দিয়েছেন আমাদেরকে নিজেদের আদর্শ ও চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য। আমাদের বিশ্বাসকে খাঁটি রাখা এবং কোনরূপ বিকৃতি ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক পদচারণায় সঠিক পথে থাকার এটাই একমাত্র উপায়।


নিউ টেস্টামেন্টের মার্কের বাইবেলে (১২ঃ১৫-১৭) একটি বিখ্যাত ঘটনা আছে। যখন ঈসা আলাইহিস সালামের বিরোধী-পক্ষের কেউ তার কাছে জানতে চাইলো, ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা মূর্তি পূজারি রোমান শাসককে কর দিবে কিনা?
ঈসা আঃ তাদের মুনাফেকির কথা জানতেন। তিনি বললেন, কেন আমাকে ফাঁদে ফালানোর চেষ্টা করছ তোমরা? একটা রোমান মুদ্রা নিয়ে আসো। তারা একটি মুদ্রা নিয়ে আসলো। তিনি মুদ্রা দেখিয়ে বললেন, এখানে কার ছবি ও বিবরণ আছে? তারা বলল, সিজারের। ঈসা আঃ বললেন, তাহলে যা সিজারের সেটা সিজারকেই কে দিয়ে দাও, এবং যা আল্লাহর সেটা আল্লাহকে দিয়ে দাও। তাঁর এমন জবাবে তারা খুবই বিস্মিত হয়েছিলো।

( আব্দুল্লাহ আন্দালুসি ,পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মুসলিম। জন্ম ও বেড়ে উঠা লন্ডনে। মাত্রা চৌদ্দ বছর বয়সে খৃষ্টধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলাম ও আধুনিক মতবাদগুলো নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ডের প্রথম সারির একজন মুসলিম চিন্তাবিদ, লেখক ও বিতার্কিক। Muslim Debate Initiative নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তিনি। এই লেখাটি তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে। )

Picture of হুজাইফা মাহমুদ
হুজাইফা মাহমুদ
হুযাইফা মাহমুদ, জন্ম হবিগঞ্জ সদরে। দারুল আরকাম বিবাড়িয়া থেকে হিফজ সম্পন্ন করার পর ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়ায় অধ্যয়ন করেছেন আট বছর। দারুল উলুম দেওবন্দেও দাওরায়ে হাদীসে অধ্যয়ন করেছেন। দেশে ফিরে হাদীস শাস্ত্র বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন একবছর, দারুল ফিকরে। একটা সময় কবি হিসেবে দুই বাংলায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। 'অন্ত:স্থ ছায়ার দিকে' তাঁর প্রথম কবিতার বই। অবশ্য কাব্য চর্চার চেয়ে ইসলাম শরীয়া দেশ সমাজ দর্শন ইতিহাস রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মি প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখার প্রতিই তার বেশি ঝোঁক। অনুবাদ করেছেন কিছু দূর্দান্ত বই। বর্তমানে তিনি ওমান প্রবাসি।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
ক্রোধ সংবরণ: কেন ও কিভাবে