পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট

পারফেকশন

আমাদের সকল কাজের সাথে মন ও চিন্তার সম্পর্ক খুব গভীর। শুধু গভীর নয়, বরং সকল কাজ মূলত মনের চাওয়া ও মস্তিষ্কের চিন্তা দ্বারাই পরিচালিত হয়। ফলে চিন্তা ও মানসিকতায় কোন অসঙ্গতি থাকলে তা প্রতিদিনের কাজে কর্মেও দৃশ্যমান হবে। এ কারণে ছাত্র যামানায় বা শিক্ষকতার কালে পড়ালেখা বিষয়ে আমার চিন্তা এবং চেতনা—উভয়টিরপ্রতি নজর রাখা ও পরিচর্যা করা খুব জরুরী একটি বিষয়। সেই জায়গা থেকে চিন্তাগত সূক্ষ্ম একটি বিষয় আমরা আলাপ করতে পারি।

পারফেকশনিজম (Perfectionism) বা পরিপূর্ণতাবাদ বলে মনোবিজ্ঞানে একটি ধারণা আছে। সংক্ষেপে বললে—এটি বিশেষ একটি মানসিক প্রবণতা। এর দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি ছোট বড় সকল কিছু কল্পনার মতো সুন্দর ও পরিপূর্ণ রূপে করতে চায়।

পূর্ণতার কামনাটি মৌলিকভাবে খারাপ কিছু নয়। বরং খুবই কাঙ্ক্ষিত ও কল্যাণকর। আমরা যে কাজই করব তা সাধ্যের সবটুকু দিয়ে পরিপূর্ণভাবে করব—এ লক্ষ্য আমাদের থাকতে হবে। কিন্তু প্রয়োজন হলো ভারসাম্য। শরীরের তাপ যেমন বেঁচে থাকার জন্য জরুরী, কিন্তু বেড়ে গেলে ‘জ্বর’ হিসেবে আবির্ভুত হয়ে অচলাবস্থা তৈরী করে, তেমনি পরিপূর্ণতার কামনা জীবনের উন্নতির জন্য আবশ্যক, কিন্তু অত্যাধিক বেড়ে গেলে তা মানসিক সমস্যা আকারে হাজির হয়ে সামনের পথ চলাকে বাধাগ্রস্ত করে।

পারফেকশনের সমস্যা তৈরী হলে মানুষ অবসাদ ও হতাশায় আক্রান্ত হয়, কর্মচাঞ্চল্য স্তিমিত হয়ে আসে এবং তার উৎপাদনশীলতা অনেক কমে যায়। পাশাপাশি তার আচরণকে আরো নানা ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে পারে খুবই নেতিবাচকভাবে।

পারফেকশনের এই সমস্যাটি কারো জীবনে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। আবার কারো কারো চিন্তায় ছড়িয়ে পড়ে সূক্ষ্মভাবে। অনেক সময় আক্রান্ত মানুষটি টেরও পায় না।

পারফেকশনের সংকট

কারো মধ্যে এ সমস্যাটি দেখা দিলে বাহ্যত সে তিন ধরণের সংকটে পড়তে পারে।

এক.

এক হলো: যেনতেনভাবে করলে হবে না – খুব ভালোভাবে করতে হবে—এই ভেবে দরকারি কাজগুলো পিছিয়ে যেতে থাকে।

যেমন, আপনি কোন সময়ই ক্লাসনোট নিতে পারেন না। কারণ, ক্লাসে নোট নিতে গেলে সাধারণত তা খুব একটা গোছালো, পরিপূর্ণ ও মনমতো হয় না। ফলে নোট করতে গিয়েও রেখে দেন। ভাবেন, এখন না। কাজটা সময় নিয়ে এবং দরকারি শরাহগুলো সামনে রেখে গুছিয়ে করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সে সুযোগ আর হয়ে উঠে না।

পড়াশোনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয় ও বিভিন্ন শাস্ত্র সম্পর্কে আমাদের জানতে হয়। কীভাবে করব মনে মনে সেই নকশা তৈরী করি। তবে, অন্য অনেক ব্যস্ততার ভিতর দিয়ে সেগুলো হাতে নিতে ইচ্ছে করে না। ভাবি, বেশ একটু সময় নিয়ে ভালোভাবে পড়তে হবে। এরপর বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়, বিষয়গুলো আর জানা হয় না। এই ব্যাপারটা ঘটতে পারে বিভিন্ন ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও।

কোন কোন সময় তালিমি মুরুব্বি, ইসলাহি মুরুব্বি অথবা কোন উস্তাদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও কেউ কেউ অবচেতনে এই সমস্যার শিকার হতে পারেন। দেখা গেল কোন কারণে যোগাযোগে বেশ কিছু দিন গ্যাপ হয়ে গেছে। এরপর মনে হতে থাকে এখন আর সাধারণভাবে সাক্ষাত করলে হবে না। পর্যাপ্ত মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে খুবই সুবিধামতো একটা সময়ে যেতে হবে এবং অত্যন্ত জোরালো সাক্ষাত করে সম্পর্কটা নবায়ন করে আসতে হবে। কিন্তু এই ভেবে যত দিন যায়, দূরত্ব বাড়েই শুধু। সাক্ষাতটা আর হয়ে উঠে না।

পেছনের কিছু পড়া ছুটে গেলেও আমরা এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়াগুলো ফেলে রাখতে পারি। ভাবি, নতুন সবক মাঝখান থেকে না ধরে পেছনেরগুলো আগে ভালোভাবে পড়ে নিই, তারপর ধারাবাহিক হবো। কিন্তু সেই অফুরন্ত অবসর ও অখণ্ড সময় পাওয়া হয় না কখনোই। ফলে পুরনো পড়ার সাথে নতুন পড়াগুলো যুক্ত হয়ে পড়ার পাহাড় জমে যায়।

বেশি সমস্যা হতে পারে পরীক্ষার সময় নিকটবর্তী হলে। আমরা সুন্দর ও আঁটঘাট বাঁধা জ্বালাময়ী একটি সুচনার অপেক্ষা করে করে ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকি। এদিকে পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে, সেই সুচনাটা আর আসে না।

এ জায়গাটিতে আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় আমাদেরকে সমস্যায় ফেলে। ইংরেজিতে একে বলা হয় প্রোকরাস্টিনেশন (Procrastination)। গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ সামনে রেখে ‘এই তো এক্ষুনি ধরছি’ করে করেও কাজটা শুরু না করে বিনোদনমূলক কিছুতে লিপ্ত হয়ে থাকা কিংবা আলসেমি যাপন করা। এ সময়টিতে আমরা সাধারণত নিজেদেরকে প্রবোধ দিই এই বলে যে, কাজটা তো করবই, তার আগে কিছুটা মানসিক স্ফুর্তি তৈরী করা যাক। এই ব্যাপারটা কোন কাজ একদম হাতের কাছে রেখেও হতে পারে, আবার নিকট সময়ই শুরু করতে যাচ্ছি এমন দূরবর্তী কাজের ক্ষেত্রেও হতে পারে। দুঃখজনক হলো, বেশিরভাগ সময়ই কাজটা আর শেষ পর্যন্ত করা হয়ে উঠে না। বা করলেও একদম শেষ দিকে গিয়ে তাড়াহুড়োর কারণে বাজেভাবে সম্পন্ন করতে হয়। বিশেষত পরীক্ষার ক্ষেত্রে এমন খারাপ অভিজ্ঞতা অনেকের জীবনে থাকতে পারে।

এ জায়গাটিতে আমরা যা করতে পারি তা হলো, কাজ ফেলে না রেখে শুরু করে দেওয়া। একটা কথা আছে, ইবতেদা মুশকিল হ্যায়, ইনতেহা নিহি। শুরু করলে এক সময় শেষ হবে। অল্প সময়েই পূর্ণতায় পৌঁছার যে তাড়না, এটা ক্ষতিকর। যে কাজ করে, তার জীবনে অখণ্ড অবসর বলে কিছু নাই। আজ যে ব্যস্ততা, কালও সে ব্যস্ততা থাকতে পারে, বরং আরো বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। সুতরাং, যে কাজটা করতে চাই, আজকের দশটা ব্যস্ততার ভীড়ে সেটিও যুক্ত হোক এগারো নম্বর ব্যস্ততা হিসেবে।

দুই.

দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো: পারফেকশনের সমস্যায় আক্রান্ত মানুষেরা সবসময় নিজেকে দেখে অসম্পূর্ণ ও অকৃতকার্যরূপে। তুচ্ছ ও হীন মনে করে। এ থেকে তৈরী হয় আত্মগ্লানী ও হতাশা। আত্মবিশ্বাস নাই হয়ে যায়। মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। সব সময় মনোপীড়া ও বিষণ্ণতায় ভোগে। এমন মানুষের পক্ষে জীবনের পথে বেশি দূর এগোনো মুশকিল। পাশাপাশি এটি আশপাশের মানুষকে তুচ্ছ ভাবতেও প্ররোচিত করে। কারণ, তার কল্পনার মতো করে দক্ষতা, সৌন্দর্য, জ্ঞান বা মনীষা তেমন কারো মধ্যেই সে দেখতে পায় না। এভাবে এক সময় সে অপ্রৈথিবীক হয়ে উঠে। অনেকের ক্ষেত্রে তো সমস্যা এতো দূর বাড়ে যে, সে তার দৃষ্টি সীমার ভিতরে একজনমাত্র যোগ্য আলেম খুঁজে পায় না, নিজের জন্য কোন ইসলাহি মুরুব্বি বেছে নিতে পারে না, পড়ার জন্য একটা বইও হাতে তুলতে পারে না, বন্ধুত্ব করার মতো কোন মানুষকে তার মনে ধরে না। সে বাস করে মূলত একটি কল্পিত পৃথিবীতে, যেখানের সবকিছু শতভাগ সঠিক, সঙ্গত, বিশুদ্ধ ও সুসংহত। কিন্তু এ পৃথিবীটা আসলে মানুষের বাস্তব পৃথিবী নয়। মানুষের বাস্তব পৃথিবী হলো পূর্ণতা ও অপূর্ণতার মিশেলে তৈরী একটি যৌগিক ধারণার নাম।

এখানে একটি বিষয় পরিস্কার করে রাখা ভালো—নিজেকে তুচ্ছ ভাবা খুবই কাঙ্ক্ষিত বিষয়। তবে এটা হলো সেই তুচ্ছতার অনুভূতি, যা মানুষকে বিনয়ী, প্রতিজ্ঞ ও কর্মচঞ্চল করে তুলে। কিন্তু এখানে যে তুচ্ছতার কথা বলা হচ্ছে, এটি সেটি নয়। এই তুচ্ছতা মানুষকে হতাশ ও হতোদ্যম করে। দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক।

এখানে প্রয়োজন হলো, নিজের অবস্থানটা ইতিবাচক বুঝা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে যা আছে তা নিয়ে কাজ করতে থাকা।

তিন.

তৃতীয়ত, পারফেকশন মানুষকে খুবই অভিযোগপ্রবণ ও সমালোচনা মুখর করে তুলতে পারে। সে তখন জগতের সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে যায়। যে দেশে, যে সমাজে ও যে সময়ে সে বসবাস করছে, সেসবের সংকটের কথা বিবেচনায় নিতে পারে না। সাধ্যের পরিমাণ ও সম্ভাব্যতা মনে রাখতে পারে না; বরং নিজের কল্পিত একটি ইউটোপিয়ান শুদ্ধতা দিয়ে সবকিছুকে বিচার করে একচেটিয়াভাবে ক্রমাগত দোষারোপ করতে থাকে। এভাবে এক সময় সে পরিণত হয় একজন নেতিবাচক মানুষে। আত্মীয়তার সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, তার থেকে উপকৃত হওয়া মানুষজন, উলামায়ে কেরাম, শিক্ষাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সবসময় আগ্রাসী ও নেতিবাচক উক্তি করতেই থাকে। এটি এমনকি কখনো কখনো কাউকে ধ্বংসাত্মক মানুষেও পরিণত করতে পারে।

এখানে মূলত দরকার হলো ভারসাম্য। স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা দিয়ে নির্মিত ইউটোপিয়ান শুদ্ধতা হলো আমাদের মনজিল। এর দিকে আমরা ক্রমশ এগিয়ে যাব, কিন্তু বাস্তবতা ও জাগতিক সীমাবদ্ধতাকে ভুলে নয়। উভয়টির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেই। আমি সংকট ও দোষত্রুটি নিয়ে আলোচনা করব অবশ্যই, কিন্তু পরিমিতির সাথে, সুবিবেচনা মাথায় নিয়ে এবং গতিপথটা সর্বদা নির্মানের দিকে অভিমুখী করে।

শেয়ার করুন

image_print
Picture of সাবের চৌধুরী
সাবের চৌধুরী
সাবের চৌধুরীর জন্ম হবিগঞ্জ সদরে। হিফজ সম্পন্ন করেছেন হরষপুর মাদ্রাসায়। বিবাড়িয়ার দারুল আরকাম, ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ও দারুল ফিকরে কেটেছে তার শিক্ষাজীবন। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। লেখালেখি ও সম্পাদনাও করছেন নিয়মিত। মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে জীবনে রোদ্দুরে, অটুট পাথর, কোথাও নিঝুম হয়েছে কেউ~ বেশ পাঠক প্রিয় বই।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি