হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব

হাদিসের পরিচয় এবং ইসলামে এর অবস্থান


আলোচনার সুবিধার্থে শুরুতেই হাদিস ও সন্নাহর শাস্ত্রীয় অর্থ ও সংজ্ঞা জেনে নেয়াটা জরুরী। হাদিস ও সুন্নাহ কে অধিকাংশ হাদিস শাস্ত্রবিদ একই অর্থে গ্রহণ করেছেন। একটি অপরটির সমার্থক শব্দ। কেউ কেউ আবার এ দুয়ের মাঝে সামান্য পার্থক্য করেছেন। (মোস্তফা আ’যমি, দিরাসাত ফিল হাদিস, পৃঃ ১,২ )
অধিকাংশের মত হিসেবে আমরা হাদিস ও সুন্নাহ কে একই অর্থে ব্যবহার করবো।
হাদিস হলো রাসূল সা: থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণীত সকল কথা, কাজ অথবা অন্যের কোন কাজের ব্যাপারে সরব ও নীরব স্বীকৃতি, তাঁর দৈহিক ও চারিত্রিক বর্ণনা, চাই তা নবুয়ত প্রাপ্তির আগে হোক কিংবা পরে। আরও সংক্ষেপে বলা যায়, রাসূল সা: এর সাথে সম্পৃক্ত সবকিছুই হাদিস বা সুন্নাহ হিসেবে স্বীকৃত। (আ’যমি, দিরাসাত ফিল হাদিস, পৃঃ ২)


হাদিসের আরও দুইটি পরিভাষা রয়েছে যা ব্যাপকভাবেই ব্যবহৃত হয়, যথা-খবর ও আসার। এর মাঝে সবচেয়ে ব্যাপক অর্থ ধারণ করে আসার,এর মাধ্যমে রাসূল সা: এর হাদিসের পাশাপাশি সাহাবী ও তাবেঈনদের কথা বা কাজকেও বুঝানো হয়ে থাকে।
হাদিস বা সুন্নাহ হলো ইসলামী শরিয়াহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ও মৌলিক উৎস। কুরআনের পরই এর মর্যাদা-গত অবস্থান। আরেক দৃষ্টিতে দেখলে কুরআন ও হাদিস একটি অপরটির উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। হাদিস বাদ দিয়ে শুধু কুরআন কে সামনে রেখে ইসলাম কে পূর্ণাঙ্গরূপে বুঝা আদৌ সম্ভব না। এজন্য ইসলামের একেবারে শুরু থেকেই মুসলমানরা কুরআনের সাথে সাথে রাসূল সা: এর হাদিসকেও পরম যত্নে আঁকড়ে ধরেছেন। হাদিসের এই মহান গুরুত্ব অনুধাবন করেই মুসলমানগণ হাদিসকে যথার্থভাবে সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রায়োগিক পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য যে বিস্তর প্রচেষ্টা এবং বিশাল কর্মযজ্ঞ সমাধা করেছেন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এর দ্বিতীয় উদাহরণ নেই।


হাদিস মৌলিকভাবে কুরআনেরই ব্যাখ্যা। ওহির মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূলের সা: কাছে কুরআন পাঠিয়েছেন, এবং এর সাথে ব্যাখ্যাও পাঠিয়েছেন। আল্লাহ বলেন: নিশ্চয় একে(কুরআন) সংগ্রহ করা ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমার হাতেই। সুতরাং আমি যখন পাঠ করি, তুমি তার পঠন অনুসরণ করো। অতঃপর আমার উপরেই রয়েছে এর ব্যাখ্যার দায়িত্ব। (সুরা ক্বিয়ামাহ-১৭-১৯)
অর্থাৎ, কুরআনের যে ব্যাখ্যা আল্লাহ রাসূল সা: কে শিখিয়েছেন সেটাই হাদিস বা সুন্নাহ হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে। সেজন্য হাদিস কে অপঠিত ওহি (ওহি-য়ে গাইরে মাতলৌ) বলা হয়। মানে, এটি কুরআনের মতোই ওহি, তবে কুরআনের মতো একে পাঠ করা হয়না।


কুরআনের পাশাপাশি হাদিসও মুসলিমদের জন্য সমানভাবে অবশ্য-অনুসরণীয় আল্লামা তাকি উসমানি তার কিতাব হুজ্জিয়তে হাদিস (হাদিসের প্রামাণ্যতা) এ প্রায় বিশটি আয়াত উল্লেখ করেছেন, যেখানে আল্লাহ স্পষ্টভাবে কুরানের সাথে রাসূল সা: কে ও অনুসরণ করতে বলছেন। আর রাসূল সা: কে অনুসরণ করার একমাত্র উপায় হলো হাদিস কে সার্বিকভাবে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নেয়া।


এখানে দুয়েকটি আয়াত উল্লেখ করে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো।
আল্লাহ বলেন: আমি তোমার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যেন তুমি তা মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করে দাও তাদের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে,যেন তারা চিন্তা করতে পারে। (নাহল-৪৪)
এই আয়াতে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, রাসূল সা: এর অন্যতম দায়িত্ব হলো কুরআন কে মানুষের কাছে বোধগম্য আকারে ব্যাখ্যা করা, নিজের কাজ,কথা ও আচরণের মাধ্যমে। কুরআনের আদেশ নিষেধ সহ যাবতীয় বিধানাবলি রাসূল সা: ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন,এবং যথাযথভাবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। এই দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। সুতরাং রাসূল সা: এর ব্যক্তি জীবন কে এই মহান দায়িত্বের বাইরে রেখে কুরআন বোঝা কোনভাবেই সম্ভব না। এটা যারা স্বীকার করবেন না, তারা বস্তুত কুরআনকেই স্বীকার করলেন না।

রাসূল সা: এর সামগ্রিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন: তোমাদের জন্য নিশ্চয় আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ, তার জন্য যে আল্লাহ ও আখিরাতের দিন কে কামনা করে এবং আল্লাহ কে অনেক বেশী স্মরণ করে। (আহযাব-২১)
কুরআনে বিশোর্ধ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন: তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো। কোথাও একথা বলেননি যে, তোমরা শুধু আল্লাহর আনুগত্য করো। বরং সুরা নিসার এক আয়াতে আল্লাহ বলেন: যে রাসূলের আনুগত্য করলো সে যেন আল্লাহরই আনুগত্য করলো। (নিসা-৮০)
অপর আয়াতে বলেন: রাসূল তোমাদের কাছে যে বিধান নিয়ে আসে, তা তোমরা আঁকড়ে ধরো, আর যে বিষয় থেকে নিষেধ করে তা থেকে দূরে থাকো। (হাশর-৭)
সুরা আ’রাফের এক আয়াতে আরও স্পষ্ট করে ঘোষণা এসেছে: যারা সেই রাসূল কে অনুসরণ করে, যিনি অক্ষরজ্ঞানহীন নবী, যার বিবরণ তারা তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাবে পেয়েছে, যিনি তাদের কে সৎ কাজের আদেশ করেন এবং অসৎ কাজ থেকে বারণ করেন, তাদের জন্য পবিত্র বিষয়গুলো কে বৈধ করেন এবং অপবিত্র বিষয়গুলো কে অবৈধ ঘোষণা করেন, এবং যিনি তাদের থেকে দূর করে দেন বোঝা ও বন্ধন, যা তাদের উপর ছিল। সুতরাং যারা তাঁর উপর ঈমান আনে,তাকে মান্য করে এবং সাহায্য করে, এবং সেই নুরের অনুসরণ করে যা তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তারাই সফলকাম হবে। (সুরা আ’রাফ-১৫৭)


১৫৮ নাম্বার আয়াতের বক্তব্যও একই রকম। এই আয়াত দ্বয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূল সা: কে বিধান প্রণয়নের স্বতন্ত্র অধিকার দিয়েছেন, যে বিধান কুরআন ব্যতীত অন্য মাধ্যমে রাসূল সা: কে জানিয়েছেন। অবধারিতভাবেই সেই বিধান জানার একমাত্র মাধ্যম হলো রাসূলের হাদিস।


কুরআনের এই সমস্ত আয়াত সামনে রাখলে দেখা যায় যে রাসূল সা: এর নিঃশর্ত আনুগত্যের ব্যাপারটি অকাট্য-ভাবে প্রমাণিত, এবং প্রত্যেক মুসলমানের উপর চূড়ান্ত আবশ্যক। এর কোন বিকল্প নেই। কেননা আল্লাহর আনুগত্য নির্ভর করছে তার রাসূলের আনুগত্যের উপর। সুতরাং কেউ যদি রাসূল সা: কে বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহ কে অনুসরণ করার দাবি করে, তাহলে তার দাবীটি নিতান্তই অমূলক এবং মিথ্যা দাবী। এজন্যই ইসলামের শুরু থেকে নিয়ে প্রাক-আধুনিক সময় পর্যন্ত কোন ইসলামি দল বা মতবাদ রাসূল সা: এর হাদিস বা সুন্নাহ কে প্রমাণ হিসেবে পুরোপুরি বর্জন করেনি। রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অবস্থানের কারণে হাদিসের বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ও শাখা-গত বিষয়ে অনেকের মাঝে মতানৈক্য থাকলেও মূল বিষয়ে সকলেই একমত।

হাদিস অস্বীকারের প্রাচীন ইতিহাস


হাদিসের ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্য থেকেই এমন একটি বিচ্ছিন্ন চিন্তার উদ্ভব ঘটতে পারে, অর্থাৎ কুরআন কে অনুসরণের নামে হাদিস কে বর্জন করতে চাইবে একটি দল,এ ব্যাপারে রাসূল সা: স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেছেন। মিকদাদ ইবনে মা’দিকারিব রাযিঃ থেকে বর্ণীত, রাসূল সা: বলেন: একদল লোক তাদের জলুসপূর্ণ খাটিয়ায় হেলান দিয়ে বসে থাকবে ( দাম্ভিকতা ও অহংকার বুঝানোর অর্থে), এবং তাদের সামনে যখনই রাসূলের সা: কোন আদেশ বা নিষেধের কথা বলা হবে,তখন তারা বলবে, তোমাদের এবং আমাদের মাঝে রয়েছে আল্লাহর কিতাব। সুতরাং সেখানে যাকে হারাম বলা হয়েছে আমরা কেবল সেটাকেই হারাম বলব এবং যাকে হালাল বলা হয়েছে কেবল সেটাকেই হালাল বলব। রাসূল সা: বলেন, জেনে রাখো আমাকে কিতাব দেয়া হয়েছে এবং কিতাবের সাথে তার সমপরিমাণ কর্তৃত্ব ও দেয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তার কিতাবে যেভাবে কোন জিনিসকে হারাম ঘোষণা দেন,রাসূল সা: ও কোন জিনিস কে হারাম ঘোষণা দেয়ার অধিকার রাখেন। ( সুনানে দারেমি- ৬০৬ )


রাসূল সা: এর পর সাহাবিদের যুগে এমন দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার দেখা পাওয়া যায়। বিখ্যাত তাবেঈ হাসান বসরি (১১০ হি:) বর্ণনা করেন, একদা ইমরান ইবনে হুসাইন রাযিঃ আমাদের কাছে রাসূলের সা: হাদিস বর্ণনা করছিলেন। তখন একলোক বলল, হাদিস না শুনিয়ে আমাদের কে কুরআনের বিধান শুনান। ইমরান ইবনে হুসাইন বললেন, তুমি এবং সঙ্গী-সাথীরা তো কুরআন পড়ো নিশ্চয়। তাহলে তুমি কি নামাজের বিস্তারিত বিবরণ কুরআন থেকে দেখাতে পারবে? স্বর্ণ, উট এবং অন্যান্য সম্পদে যে যাকাতের বিধান রয়েছে, সেটি কি কুরআন থেকে দেখাতে পারবে? অথচ এসব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ রাসূল সা: আমাদের কে শিখিয়ে গেছেন তার হাদিসে। লোকটি তখনই তার ভুল বুঝতে পারলো, এবং অনুতপ্ত হয়ে বলল, আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, আল্লাহ আপনাকেও বাঁচান। (মুসতাদরাকে হাকেম, ১/১০৯)


এমন আরেকটি ঘটনা পাওয়া যায় উমাইয়া ইবনে খালেদ নামক একজনের ব্যাপারে। তিনি ইসলামের সমস্ত বিধান কুরআন থেকে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। একপর্যায়ে এসে বিখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, কুরআনে মুকিম অবস্থার নামাজ এবং ভয়ের সময়ের নামাজের (সালাতুল খাওফ) কথা রয়েছে, কিন্তু সফর অবস্থায় নামাজের কথা নেই কেন? ইবনে উমর তার এই কর্মপন্থা কে নিতান্তই অপছন্দ করলেন এবং বললেন: দেখো, আল্লাহ আমাদের কাছে তার রাসূল মুহাম্মদ সা: কে পাঠিয়েছেন,এমন অবস্থায় যখন আমরা কিছুই জানিনা। সুতরাং এখন আমরা ঠিক তাই করি যা রাসূল সা: কে করতে দেখেছি, এবং তাই জানি যা রাসূল সা: আমাদের কে জানিয়েছেন।(মুসতাদরকে হাকেম-১৩০)


ওমর রাযিঃ এক জুমার খুতবায় বলেন, কতিপয় মানুষ বলাবলি করে, যিনার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ কুরআনে বেত্রাঘাতের বিধান দিয়েছেন, কিন্তু প্রস্তরাঘাতের বিধান কোথা থেকে এলো? জেনে রাখো রাসূল সা: এই শাস্তি প্রয়োগ করেছেন, সুতরাং তার পরবর্তীতে আমরাও একই শাস্তিই প্রয়োগ করবো। ( মুসনাদে আহমাদ -১৫৬)


এসব ঘটনা থেকে বুঝা যায় সাহাবিদের সময়ে বা তার পরবর্তী সময়ে যে বা যারা হাদিসের প্রামাণ্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়েছিলেন তারা নিছক অজ্ঞতা বা অসচেতনতা বশত কারণেই হয়েছিলেন। এর পেছনে কোন আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রণোদনা ছিলোনা। তাদের কে যখন সচেতন করা হয়েছে,তৎক্ষণাৎ তারা ফিরে এসেছেন। হিজরি দ্বিতীয়/ তৃতীয় শতকে ইরাক অঞ্চলে ক্ষুদ্র একটি দল হাদিসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করতে লাগলো, এবং এর প্রামাণ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করতে লাগলো।কিন্তু সমকালীন আলেমগণ তাদের এই চেষ্টা কে অঙ্কুরেই বিনাশ করে ফেলেন। বিশেষত ইমাম শাফেঈ ( ২০৪ হিঃ) তার বিখ্যাত কিতাব “কিতাবুল উম্ম” এ এদের সকল আপত্তির শক্ত জবাব দেন। ফলত এই চিন্তা তৎকালীন মুসলিম সমাজে সামান্যতম প্রভাব সৃষ্টি করার আগেই শেষ হয়ে যায়।


শিয়া, মু’তাযিলা, খারেজি, ইবাদি প্রমুখ দলগুলোর সাথে হাদিসের প্রায়োগিক ও পদ্ধতিগত কিছু পার্থক্য রয়েছে মূলধারার সুন্নি ইসলামের সাথে। কিন্তু এই দলগুলোর প্রত্যেকেই হাদিস বা সুন্নাহ কে শরীয়তের মৌলিক উৎস হিসেবে স্বীকার করে, এবং হাদিসের প্রামান্যতার ব্যাপারে একমত। (দিরাসাত ফিল হাদিস- ২৫/২৬, ডক্টর মোস্তফা আ’যমি)

পশ্চিমা একাডেমিয়ায় হাদিস চর্চার সূচনা ও ইতিহাস-


ইসলাম, আরব এবং বৃহত্তর অর্থে প্রাচ্য নিয়ে পশ্চিমের যে কর্তৃত্ত্বমূলক জ্ঞান-শাখা রয়েছে সেটা কে বলা হয় প্রাচ্যবাদ(Orientalism)। ইসলাম ও প্রাচ্য বিষয়ক জ্ঞান চর্চার সূচনা যদিও আরও বহু আগে ঘটেছে, কিন্তু ইসলামী জ্ঞানকাণ্ডের বৃহত্তম শাখা হাদিসের ব্যাপারে বিশেষভাবে পশ্চিমা আগ্রহের সূচনা ঘটেছে এই ঊন-বিংশ শতকের মধ্যভাগে এসে। এই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইসলামের কলপর্ব গুলোর গঠনমূলক অধ্যয়ন। হাদিস বিষয়ে আধুনিক ওরিয়েন্টালিস্ট স্কলারদের মাঝে গবেষণা শুরু হয় রাসূল সা: এর জীবনী কে ঐতিহাসিক পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পাঠের প্রয়োজনীয়তা থেকে। কুরআনের পাশাপাশি তারা হাদিসকেও গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন। একই সাথে হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা এবং ইসলামের ইতিহাস চর্চার যে ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি রয়েছে তাকে নানান দিক থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন করলেন। এজন্য শুরুর দিকে হাদিসের যেসব ক্রিটিক হয়েছে সেগুলো মূলত ওরিয়েন্টালিস্ট ইতিহাসবিদদের মাধ্যমেই হয়েছে, যারা রাসূল সা: এর জীবনী কে পশ্চিমা পদ্ধতিতে বিনির্মাণ(reconstruction) করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।


ওয়ায়েল হাল্লাকের মতে, গুস্তাফ ওয়েল(১৮০৮-১৮৮৯) হলেন প্রথম ( নিশ্চিতরূপে প্রথম না হলেও প্রথমদের একজন) প্রাচ্যবিদ যিনি ১৮৪৮ সালে সুনির্দিষ্টভাবে হাদিসের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।তার মৌলিক প্রস্তাব ছিল-হাদিসের বৃহত্তম একটি অংশ কে বানোয়াট ও জাল হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ। ১৮৬১ সালে আলয়জ স্প্রেঙ্গারও(১৮১৩-১৮৯৩) হাদিসের ব্যাপারে একই দাবি তোলেন। (Hallaq,the authenticity of hadith, 1998)


তাদের অব্যবহিত পরে উইলিয়াম ম্যুর, যিনি ইন্ডিয়াতে ঔপনিবেশিক প্রশাসক ও শিক্ষাবিদ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন, (১৮১৯-১৯০৫) তার বিখ্যাত বই The life of Mahomet( ১৮৬১) এ রাসূল সা: এর জীবনী বর্ণনায় হাদিস কে অন্যতম ঐতিহাসিক উপকরণ হিসেবে ব্যাবহার করেছেন। তবে এই আলোচনা করতে গিয়ে তিনি হাদিসের সত্যাসত্য (reliability) যাচাইয়ের জন্য নিজের মতো করে কিছু মানদণ্ডও তৈরি করেছিলেন। তথাপি হাদিস সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত হলো, হাদিস কোন গ্রহণযোগ্য সূত্র নয়, এগুলো তৈরি করা হয়েছে মূলত রাসূল সা: এর মহত্ত ও মর্যাদার উচ্চতা বয়ানের জন্য, এর পাশাপাশি তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানগত বৈধতা তৈরির জন্য। রাসূলের সা: জীবনী ও শিক্ষা জানার একমাত্র গ্রহণযোগ্য সূত্র হলো কুরআন। (William muir,the life of Mahomet, P:37,38)


হাদিসের প্রথম দিকের এই কাজগুলোই হাদিস কে মৌলিক ও স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে ওরিয়েন্টাল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করে, এবং পরবর্তীদের জন্য দুয়ার খুলে দেয়। পূর্বোক্ত প্রাচ্যবিদদের প্রত্যেকেই হাদিস কে নিছক ঐতিহাসিক নথিপত্র এবং রাসূলের সা: জীবনী আলোচনার সূত্র হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু একই সময়ে প্রাচ্যবিদদের ক্ষুদ্র আরেকটি দল, যাদের মূলে ছিলেন এডওয়ার্ড সাচাও(Edduard sachau 1845-1930) নামে এক জার্মান প্রাচ্যবিদ, যারা আবিষ্কার করেছিলেন যে ইসলামে হাদিসের অবস্থান কেবল ঐতিহাসিক নথিপত্র হিসেবেই না, বরং ইসলামী আইন, বিধান ও জীবনাচরণের সাথেও রয়েছে এর গভীর যোগসূত্র। কুরআনের পাশাপাশি হাদিসও শরীয়া আইনের বৃহত্তম উৎস। (Salem Alshehri, Western works and views On Hadith, P:205)


১৮৪০ থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত সময়টাকে পশ্চিমা একাডেমিয়ায় হাদিস চর্চার প্রারম্ভিক পর্ব হিসেবে ধরা হয়। এই কালপর্বের স্কলার-গন হাদিস নিয়ে আলোচনার সূচনা ঘটান, তবে তখনো সেটা পুরো-দমে শুরু হয়নি।বরং সূত্র হিসেবে এর গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে তারা প্রবল সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন।
১৮৯০ থেকে নিয়ে বর্তমান, এই কালপর্বে পশ্চিমা প্রাচ্য-তাত্ত্বিক একাডেমিয়াতে হাদিস-চর্চার একটি সুশৃঙ্খল ধারা গড়ে উঠেছে, এবং তারা এই বিষয়ে পূর্বের তুলনায় আরও বেশি পাণ্ডিত্য ও পরিপক্বতা লাভ করেছেন। হাদিস শাস্ত্রে ক্লাসিক মুসলিম স্কলারদের রেখে যাওয়া সুবিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে পরিচিত হয়েছেন। এই কালপর্ব কে পুনরায় দুইভাগে ভাগ করেছেন ডক্টর সালেম। ১৮৯০ থেকে নিয়ে ১৯৫০ পর্যন্ত, এই সময়ে প্রধান দুই ব্যক্তির কাজ হাদিস বিষয়ক আধুনিক স্কলারলি গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করেছে। ১৮৯০ সালে ইগনায গোল্ডযিহার(Ignaz Goldzihar,1850-1921) তার বিখ্যাত বই Muslim studies প্রকাশ করেন, জার্মান ভাষায়। ১৯৫০ সালে জোসেফ শাখত (Joseph Scacht,1902-1969) The origin of Muhammedan jurisprudence নামে তার সুবিস্তৃত গবেষণা কর্মটি প্রকাশ করেন, এবং তাও যথারীতি জার্মান ভাষায়।


এই বৃহৎ কলেবরের বই দুটিকেই এখন পর্যন্ত প্রাচ্য-তাত্ত্বিক একাডেমিয়ায় হাদিস গবেষণার ভিত্তি এবং পথপ্রদর্শক হিসেবে মানা হয়। গোল্ডযিহারই প্রথম হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা ও সত্যতা নিয়ে ক্রিটিক্যাল চিন্তার প্রবর্তন করেন। এবং একই পথ অবলম্বন করেন জোসেফ শাখত। গোল্ডযিহার হাদিসের অথেন্টিসিটি কে চ্যালেঞ্জ করেছেন হাদিসের টেক্সট (মতন) কে সামনে রেখে, অপরদিকে শাখত হাদিস কে চ্যালেঞ্জ করেছেন সনদ কে কেন্দ্র করে।
তাদের পর যারা প্রাচ্য-তাত্ত্বিক একাডেমিয়ায় হাদিস চর্চা করেছেন এবং করছেন, তারা মূলত এই দুজনের কাজকেই বিস্তৃত করেছেন, এবং হাদিসের শাখা-গত কিছু বিষয়ে গবেষণার পরিধি বাড়িয়েছেন কেবল। যদিও এর বাইরেও অল্প বিস্তর ব্যতিক্রম পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম বেশ কয়েকজন প্রাচ্যবিদের দেখা পাওয়া যায়, যারা পূর্বোক্ত দুজনের বলয় ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন এবং স্বাধীন গবেষণা করে ভিন্ন মতামত প্রস্তাব করেছেন। ওয়ায়েল হাল্লাকের মতে, গোল্ডযিহার এবং শাখত এর পরে স্কলার-গন তাদের কে কেন্দ্র করে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

একদল তাদের গবেষণা কে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে নিয়েছেন, কোন ক্রিটিক বা যাচাই বাছাই ছাড়াই। পশ্চিমা স্কলারদের মাঝে এই দলটিই মূলধারা এবং প্রবল।

আরেক দল যারা গোল্ডযিহার এবং শাখত এর গবেষণা কে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছেন, এবং এ ব্যাপারে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত ট্র্যাডিশনাল যে বোঝাপড়া আছে তাকে গ্রহণ করেছেন। এদের মাঝে উল্যখযোগ্য হলেন মোস্তফা আযমি, ফুয়াত সেজগিন, নাবিয়া এবোট এবং জোহান ফোয়েক।


তৃতীয় দলটি প্রথমোক্ত দুই দলের মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং দুটি দলের মাঝে সমন্বয় করতে চেয়েছেন। এই দলে আছেন হ্যরাল্ড মোজকি, ডি স্যান্টিলানা, ফজলুর রহমান মালাক, জি এইচ জোয়েনবল এবং জেমস রবসন। (Hallaq, The authenticity of hadith, P:3)


কিন্তু গবেষণার পদ্ধতি ও পরিণতির বিচার প্রথম দল এবং তৃতীয় দলের মাঝে তেমন মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। উভয় দলই হাদিস গবেষণার যে ইসলামিক ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি আছে, সেটিকে মূল্যায়ন করেননি। সুতরাং বর্তমান লেখায় আমরা হাদিসের অথেন্টিসিটি বিষয়ে গোল্ডযিহার এবং শাখত এর প্রস্তাবনাগুলো নিয়েই সংক্ষেপে আলোচনা করবো।


হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নে প্রাচ্যতাত্ত্বিক গবেষণার ধরণ


ইসলাম কিংবা প্রাচ্য বিষয়ক যেকোনো প্রাচ্য-তাত্ত্বিক গবেষণার সাথে জোরালো-ভাবে ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রশ্ন জড়িত। এডওয়ার্ড সাইদ দেখিয়েছেন, জ্ঞান কিভাবে ক্ষমতা কে অঙ্গীভূত করে। জ্ঞানই শক্তি, এই বিখ্যাত কথাটির অর্থ হলো-কোন একটা বিষয় জানা বা অধ্যয়ন করার মানে সে বিষয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। প্রাচ্যবাদী জ্ঞান কিভাবে প্রাচ্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রধান সহায়ক হয়, সেটি আমরা সুদীর্ঘ ইউরোপিয়ান উপনিবেশের যুগে দেখেছি। সে হিসেবে ফরাসি ও ওলন্দাজদের আফ্রিকার ইসলামি আইন ও সংস্কৃতি বিষয়ক পাণ্ডিত্য, কিংবা ব্রিটিশদের ইন্ডিয়াণ পার্সিয়ান ইসলাম বিষয়ক জ্ঞানচর্চা, ইউরোপিয়ান কূটনৈতিকদের উসমানি খেলাফত বিষয়ে তুমুল আগ্রহ, এবং তাদের সকলের ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের খুঁটিনাটি সকল চর্চাই মূলত একটি রাজনৈতিক ও ঔপনিবেশিক প্রকল্পের বৃহত্তর অংশ। হাদিস বিষয়ক তত্ত্বতালাশও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।


উনিশ ও বিশ শতকের প্রাচ্যবিদগণ হাদিস কে এতোটা গুরুত্বের সাথে কেন নিয়েছিলেন এ থেকেই সেটা বুঝা যায়। প্রাচ্য-তাত্ত্বিক ইতিহাসবিদরা ইসলামের নবী এবং ইসলামের প্রথম যুগ, তথা রাসূল সা: এর সময়কালের একটি ক্রিটিক্যাল ফ্রেইম বা কাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে হাদিসকে দ্বিতীয় সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারা হাদিস কে একটি বিস্তৃত তথ্য ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যেখানে বিপুল তথ্যের পাশাপাশি ইসলামের বিবিধ বিষয়ে আইডিয়া নির্মাণও সম্ভব। (Jonathan Brown, Hadith Muhammad’s legacy in the medieval and modern world, P:254)


যেকোনো ঐতিহাসিক তথ্য ও বিবরণ কে যাচাই করার জন্য মুসলিমরা ইসলামের শুরু থেকেই তাদের নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। বিশেষত হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে এবং অ-নির্ভরযোগ্য হাদিস ও ঘটনাবলী থেকে ইসলামকে মুক্ত রাখতে তারা এমন এক কার্যকরী ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীর জ্ঞান-জগতে যার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। কিন্তু পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা যখন হাদিস ক্রিটিসিজম শুরু করলেন তখন তারা সেসব স্বীকৃত ও কার্যকরী পদ্ধতির আশপাশেও ঘেঁষেননি।

এক্ষেত্রে তারা প্রয়োগ করেছেন Historical Critical Method (HCM)। রেনেসাঁ পরবর্তী ইউরোপে হিউম্যানিজম ও ক্রিটিকাল এপ্রোচ থেকে এই তত্ত্বের জন্ম হয়, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সূত্রগুলোর বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। যেকোনো ঐতিহাসিক টেক্সটের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা, এবং একে সন্দেহ করতে থাকা। লর্ড একটন (Lord Acton 1902) এর মতে আধুনিক ইতিহাসবিদ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে পূর্বেই নিশ্চিত হয়ে যাবেনা,বরং তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে এর সত্যতার ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ। (Acton, A lecture on the study of history, P:44-45)


ইতিহাস হলো সূত্রের ওপারে তাকিয়ে প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধান করা। অর্থাৎ, ঐতিহাসিক সূত্র যা বলছে নিছক তার উপরই নির্ভর না করে বরং সূত্রগুলো কে সামনে রেখে প্রকৃত পক্ষে কী ঘটেছিলো, মানব-ইতিহাসের ধারাবাহিকতা কাল-পরিক্রমা ও বৈশিষ্ট্য মেনে তা অনুমান করে নেয়া।


ডক্টর সালেমের মতে, একজন প্রাচ্য-তাত্ত্বিক হাদিস বিশারদের কাছে প্রতিটি হাদিস একেকটি ঐতিহাসিক নথি বা তথ্য। চাই তা রাসূল সা: থেকে প্রমাণিত হাদিস কিংবা তাঁর নামে বানানো হাদিস, সবগুলোই এই ক্রিটিকের কাছে সমান মর্যাদা রাখে। তিনি এই টুকরো টুকরো “ফ্যাক্টগুলো”কে একত্রিত করে সেই সময়ের একটি ফ্রেইম বা কাঠামো নির্মাণ করেন। অধিকাংশ প্রাচ্যবিদ হাদিস কে নিছক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। (Salem, Western work on hadith, P:207)


উইলিয়াম ম্যুর যেমনটা দাবি করেছেন, মুসলিমদের নিকট হাদিসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ যে কিতাব, সহীহ আল বুখারী, এই বুখারীর হাদিসগুলোকে ইউরোপিয়ান ক্রিটিসিজম(HCM) এর মানদণ্ডে যাচাই করা হয়, তাহলে খুব সামান্য কিছু পরিমাণ হাদিসই নির্ভরযোগ্য হিসেবে টিকবে। ম্যুর আরও দাবী করেন, হাদিস যাচাইয়ের যে ক্লাসিক্যাল পদ্ধতি আছে, তা নিতান্তই অকার্যকর। কেননা, হাদিসের সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এটা কেবল হাদিসের সনদ (chain of narrators) এর উপর গুরুত্ব দেয়,মতন (Text and context) কে গুরুত্ব দেয়না। (Muir, P:42)
স্রেফ হাদিসই নয়, বরং যেকোনো ইসলামী শাস্ত্র কে তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেছেন। ফলত ইসলামী জ্ঞান ও তার বুঝাপড়ার ইতিহাসে ইসলামের ট্র্যাডিশনাল চর্চা এবং প্রাচ্যবিদদের নব্য আবিষ্কৃত পদ্ধতির চর্চা উভয়ে প্রচন্ডভাবে সাংঘর্ষিক, সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত।

হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নে গোল্ডযিহার এবং শাখতের প্রস্তাবনাসমূহ:


আমরা পূর্বেই বলেছি, পশ্চিমা একাডেমিয়ায় হাদিসের উপর সবচে মৌলিক এবং প্রভাববিস্তারী কাজ করেছেন দু’জন। যথা, ইগনায গোল্ডযিহার (Muslim Studies-1889) এবং জোসেফ শাখত(The origin of muhammedan jurisprudence-1950)। হাদিসের ব্যাপারে তারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, পরবর্তী পশ্চিমা স্কলার-গনও ব্যাপকভাবে তাকেই গ্রহণ করেছেন, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত। গোল্ডযিহারের অব্যবহিত পরে তারই দেখানো পথে আরও দুইজন প্রাচ্যবিদ তার কাজকেই আরও শক্তিশালী এবং সম্প্রসারণ করেছেন,যথাক্রমে হেনরি লেমেন্স (১৮৬২-১৯৩৭) এবং স্যামুয়েল মারগোলিয়োথ(১৮৫৮-১৯৪০)। এখন পর্যন্ত তাদের প্রভাবই প্রবলভাবে বিদ্যমান। ইউরোপের পণ্ডিতগণ গোল্ডযিহারের বইটি কে উনবিংশ শতকে ইসলামী গবেষণার মাইলফলক হিসেবে দেখেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামের পূর্নাঙ্গ একটি চিত্র ইউরোপের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন খোদ ইউরোপের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। হিস্টোরিক্যাল ক্রিটিসিজমের পূর্ণা-ঙ্গ ব্যবহার করেছেন গোল্ডযিহার, যিনি ইতিহাস বিশ্লেষণে জর্মন পদ্ধতির প্রতি একান্ত অনুগত। (Jonathan Brown, P:268)


গোল্ডযিহার মূলত হাদিসের উৎস এবং এর ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোচনা করেছেন, উমাইয়া ও আব্বাসী খেলাফতের সময়ে মুসলিম সমাজে এর অবস্থান কোন পর্যায়ে ছিল সে হিসেবে। একই সাথে মুসলিমদের মধ্যকার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিবাদের সাথে হাদিসের আইনি সম্পর্কের তত্ত্ব-তালাশ নিয়েছেন। তার বইয়ের ভূমিকায় তিনি বলছেন,মুসলিমরা হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নে যে অবস্থান গ্রহণ করেছে, এবং রাসূলের সা: কাজ ও কথা সম্বলিত যে পরিমাণ হাদিস তারা প্রসিদ্ধ হাদিসের কিতাবগুলোতে পায়, এর পেছনে কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকা সম্ভব না।
বরং অধিকাংশ হাদিসই তৈরি হয়েছে প্রথম যুগের মুসলিমদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটগুলো কে সামনে রেখে। মুসলিম সমাজ যখন সম্প্রসারিত হতে লাগলো এবং ধর্ম ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে তারা নানান বাস্তবতার মুখোমুখি হতে লাগলো,তখন হাদিসও সেসব সামাজিক কনটেক্সট কে সামনে রেখে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে তার যুক্তি হলো,হাদিসের নির্দিষ্ট সংখ্যা নিয়ে মুসলিমদের মাঝে কোন ঐকমত্য নাই, এ থেকে বুঝা যায়, হাদিস একটি চলমান প্রক্রিয়া ছিল তখন, সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মতে, হাদিস রাসূলের কথা ও কাজের কোন ঐতিহাসিক দলিল বা উত্তরাধিকার নয়,বরং দল বিভক্ত মুসলিম সমাজের বিবিধ আকাঙ্ক্ষার সরাসরি প্রতিফলন। (Goldzihar, Introduction to Islamic theology and law, P:40)


রাসূলের সা: আদেশ, নিষেধ এবং নির্দেশনা যেহেতু মুসলিমদের নিকট সবসময়ই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেহেতু হাদিস কে ব্যবহার করে কিভাবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করা যায়,সেটা মুসলিমগণ খুব দ্রুতই আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। (Goldzihar, Muslim studies, P:22-23)
প্রথম তিন শতকে “হাদিস বানানোর” পেছনের কারণ ও প্রণোদনা কে গোল্ডযিহার চারভাগে ভাগ করেছেন। রাজনৈতিক এজেন্ডা, আইনি(ফিকহি) এজেন্ডা, দলীয়(মাযহাব) এজেন্ডা এবং সামাজিক ও ঐতিহাসিক এজেন্ডা। তার মতে, হাদিস জাল করার পেছনে ক্রিয়াশীল এই এজেন্ডাগুলর মাঝে সবচে বড় এজেন্ডা ছিল রাজনৈতিক। বিশেষত প্রচুর হাদিসের কনটেক্সট এবং প্রাথমিক পর্যায়ের হাদিস ট্র্যাডিশনের ধরণ লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে উমাইয়াদের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা নির্মাণে হাদিস জাল করার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।(পূর্বোক্ত-৪০)
হাদিসের কনটেক্সট থেকেই বুঝে ফেলা সম্ভব, হাদিসটি কারা বানিয়েছে, কী উদ্দেশ্যে বানিয়েছে এবং কোন সময়কালে বানিয়েছে।


হাদিস কিভাবে রাজনৈতিক এজেন্ডা কিভাবে বাস্তবায়ন করেছে, এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণীত একটি প্রসিদ্ধ হাদিস এনেছেন। হাদিসের ভাষ্য হলো, তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে বিশেষ সওয়াবের নিয়তে যেও না। অর্থাৎ, পৃথিবীতে এই তিনটি মসজিদই কেবল বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, এবং মসজিদে আক্বসা। দুনিয়ার বাকি মসজিদ মর্যাদার দিক দিয়ে সমান।গোল্ডযিহার নিছক ধারণা-বশত এবং হাস্যকর ভাবে এই হাদিসটিকে জাল এবং রাজনৈতিক এজেন্ডাসম্বলীত হাদিস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এবং হাদিস জালকারী হিসেবে ইবনে শিহাব যুহরী কে চিহ্নিত করেছেন। যুহরি উমাইয়া খলীফাদের (যারা মসজিদে আক্বসা অঞ্চলে ছিলেন) কথানুযায়ী মসজিদে আক্বসার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে হাদিস বানিয়েছেন। ইবনে শিহাব যুহরী, যাকে ইসলামের ইতিহাসে মুহাদ্দিসদের সম্রাট এবং হাদিস শাস্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ প্রতিম হিসেবে দেখা হয়। তাঁর মতো সুবিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজনের ব্যাপারে হাদিস জাল করার মতো গুরুতর অভিযোগ উত্থাপনের পেছনে গোল্ডযিহার কোন নির্ভরযোগ্য বা অ-নির্ভরযোগ্য কোনপ্রকারের ঐতিহাসিক দলীল প্রমাণের ধারও ধারেন নি!


হাদিসের পরিমাণ দেখিয়ে তিনি দাবী করেন, ইসলামের শুরুর যুগে অল্পবিস্তর কিছু হাদিস কে সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিলো যদিও, কিন্তু সংখ্যায় তা অতি নগণ্য। কিন্তু এই নগণ্য সংখ্যার হাদিসই পরবর্তীতে বিশাল একটি পরিমাণ হয়ে দাঁড়ায়, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। এ থেকেও বুঝা যায় যে, হাদিসের সামান্য কিছু পরিমাণ ব্যতীত বৃহত্তর পরিমাণটাই জাল বা নকল, পরবর্তী প্রজন্মের আবিষ্কার।


গোল্ডযিহার হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা নির্ণয়ের পুরো প্রকল্পটি দাঁড় করিয়েছেন হাদিসের মতন বা টেক্সট পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণের উপর। হাদিসের উৎস,সময় এবং নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণে সনদও(বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খলতা) যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটা তিনি স্বীকার করেননা। তার মতে হাদিস যাচাইয়ের জন্য সনদের উপর নির্ভর করাটা বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যা-জনক। কেননা এই সনদ ট্র্যাডিশনের কোন সায়েন্টিফিক ভিত্তি নাই, এবং এটা তেমন শক্তিশালী কোন মানদণ্ডও না, যার মাধ্যমে সমস্ত হাদিস কে পরীক্ষা করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সনদ কোন কাজেই আসবেনা যদি হাদিসের টেক্সটই বিভিন্ন বৈপরীত্য ও অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে থাকে। তিনি বলেন, সনদ বিশুদ্ধ থাকলে মুসলিম স্কলার-গন হাদিসের টেক্সট নিয়ে আর কিছুই ভাবতেন না, যদিও টেক্সটের মাঝে স্থূল কোন অসঙ্গতি থাকে। তার সিদ্ধান্ত গুলোই পরবর্তী পশ্চিমা স্কলার-গন কোন বাছবিচার ছাড়াই ক্রমাগত আওড়ে গেছেন।
ডক্টর সালেম বলেন, গোল্ডযিহার মনে করতেন, প্রতিটি ধর্মই সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয় এবং নানান দিকে বিকশিত হয়। হাদিস কে ইসলামের লিগ্যাল অথরিটি হিসেবে স্বীকার না করে তিনি একে ইসলামের শুরু থেকে প্রথম তিন শতক পর্যন্ত এর বিবর্তন ও বিকাশের দলিল হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
তার মতে ইসলাম সবসময়ই বিবর্তিত হতে থাকা একটি ধর্ম,যার শুরু হয়েছিলো ইহুদি ধর্ম থেকে তার ধর্মীয় উপকরণগুলো ধার করে নেয়ার মাধ্যমে। (Salem Alshehri, Western works on hadith, P:212)


তবে একথা সত্য যে, গোল্ডযিহার এর অধ্যয়নের বিস্তৃতি ছিল, এবং হাদিস শাস্ত্রের সাথে তার সম্পর্কটাও অন্যদের চেয়ে গভীর। জামিয়া আযহারে দীর্ঘদিন হাদিসের শায়েখদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। কিন্তু জ্ঞানের ব্যাপারে তার অসততা ও দুরভিসন্ধির কারণে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেন নি। ইসলামের ব্যাপারে এক নিষ্ঠুর আক্রোশ তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সর্বদা, সত্য প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


জোসেফ শাখত এর প্রস্তাবনাসমূহ


পশ্চিমা একাডেমিয়ায় ইসলামের জ্ঞান-তাত্ত্বিক ডিসকোর্সে গোল্ডযিহারের পর সবচে বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী স্কলার হিসেবে শাখতকেই ধরা হয়। তিনি গোল্ডযিহারের ভাবশিষ্য, এবং তার চিন্তার ধারাই বহন করেছেন, তবে প্রকাশ করেছেন এক ভিন্ন আঙ্গিকে। অনেকের মতে গোল্ডযিহারের কাজে যেসব অপূর্ণতা ও অসঙ্গতি থেকে গিয়েছিলো, শাখত সেটা যথাযথভাবে পূরণ করেছেন তার সাড়াজাগানো বই দ্যা অরিজিন অফ মোহামেডান জুরিসপ্রুডেন্স এ। H.A.R Gibb এর মতে, শাখত এর এই বই ভবিষ্যতের জন্য ইসলামি সভ্যতা ও আইন বিষয়ে গবেষণার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে, অন্তত পশ্চিমে।


চারটি মূল পয়েন্ট কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে এই বই, যথা ইসলামের শুরুর যুগে আইনি ধারার উন্নয়ন, আইন সম্বলিত (ফিকহি মাসায়েল) হাদিসের বৃদ্ধি, বনু উমাইয়া খিলাফতকালে আইনের প্রাতিনিষ্ঠিকিকরণ এবং ফিকহি মাযহাবগুলোর মাঝে পারস্পরিক মতপার্থক্য, এবং পদ্ধতিগত-ভাবে হাদিস কে ফিকহি মাসায়েলের ভিত্তি স্বরূপ গ্রহণের ব্যাপক প্রবণতা।


লক্ষণীয় বিষয় হলো হাদিসের উৎস, সময় ও নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্নে গোল্ডযিহার এবং শাখত এর মাঝে কোন মতপার্থক্য নেই, তারা উভয়েই একমত যে, হাদিস কোনভাবেই রাসূল সা: এর প্রকৃত কাজ ও কথা কে উপস্থাপন করেনা। গোল্ডযিহারের মতে হাদিস পরবর্তীতে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট কে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে, অপরদিকে শাখতের মত হলো, যখন থেকে মুসলিমদের মাঝে আইনি ধারার(ফিকহ) উন্নয়ন এবং বিন্যস্তকরণ শুরু হয়েছে তখন আইনি ধারাগুলো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে হাদিস বানানোর প্রচলন শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে শাখত ব্যাবহার করেছেন হাদিসের সনদ ট্র্যাডিশন কে। গোল্ডযিহার হাদিসের টেক্সট থেকে যাচাই করেছেন হাদিসটি কারা বানিয়েছে এবং কী উদ্দেশ্যে বানিয়েছে। এক্ষেত্রে শাখত যাচাই করেছেন সনদ কে। তার মতে সবগুলো সনদেরই একটা কমন লিঙ্ক থাকে। সেই কমন লিঙ্ক তত্ত্ব অনুসরণের মাধ্যমে বুঝা যায় হাদিসটি কে বানিয়েছে। অর্থাৎ একটা হাদিসের সনদে অনেক বর্ণনাকারী থাকলেও তাদের মূলে থাকে একজন বর্ণনাকারী, যার কাছ থেকে তারা সবাই হাদিসটি গ্রহণ করেছেন, সেই একজনকেই শাখত হাদিসটির রচয়িতা বলে চিহ্নিত করছেন।


তার মতে ইসলামের প্রথম এবং দ্বিতীয় শতকে যখন ফিকহি মাযহাবগুলো সংগঠিত হচ্ছে, তখন হাদিসের সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং অপ্রতুল ছিল, ফলে যেকোনো আইনি সিদ্ধান্তের পেছনে লিগ্যাল অথরিটি হিসেবে হাদিস পাওয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা, তখন ফকীহ বা ইমামগন নিজেদের বানানো হাদিসের আশ্রয় নিয়েছেন। (A’zami, On schacht’s The Origin Of Muhammadan jurisprudence, P:6,7)


একটি হাদিস ঠিক কোন সময়ে বানানো হয়েছে এটা চিহ্নিত করা যায় হাদিসটি কখন লিগ্যাল ডিসকোর্সে হাজির হয়েছে সে দিকে লক্ষ্য করলে, এবং তার কথিত সনদের “কমন লিঙ্ক থিউরি” অনুসরণের মাধ্যমে। এবং এই কমন লিঙ্কের মাধ্যমেই বুঝা যায় কোন সনদটি আসল এবং কোন সনদটি তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে বানানো। গোল্ডযিহার হাদিস যাচাইয়ের জন্য ইসনাদ কে পুরোপুরি মূল্যহীন এবং অযোগ্য হিসেবে দেখেছিলেন, কিন্তু শাখত এই ইসনাদের মাধ্যমেই গোল্ডযিহারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। তাদের উভয়ের মাঝে আপাত পার্থক্য এতটুকুই।


রিয়াদ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর মোস্তফা আ’যমি (মৃ ২০১৭) তার Studies in early hadith literature(1967) বইয়ে গোল্ডযিহার এবং শাখতের প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে সবিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার অপর বই On schacht’s The Origin Of Muhammadan jurisprudence(1996) এ বিশেষভাবে শাখত এর দাবিগুলো সম্পর্কে সবিশদ আলোচনা করেছেন। এছাড়া ডক্টর মোস্তফা আস সিবাঈ (মৃ ১৯৬৪) এবং ডক্টর ফুয়াত সেজগিন (মৃ ২০১৮) এই ব্যাপারে শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক কাজ করে গেছেন।


ইসলামী জ্ঞানজগতে হাদিসের প্রাচ্যবাদী বয়ানের প্রভাব


ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপের কূটনীতিবিদগণ মুসলিম দেশগুলো তে “প্রগতিশীল ইসলাম” নামক একটি এলিট ধারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। যারা ইউরোপীয় সভ্যতা, আলোকায়ন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের জাগতিক উন্নতির প্রতি গভীর অনুরক্ত থাকবে, এবং সর্বোপরি চিন্তা চেতনায় ইউরোপীয় মডেলের “আধুনিক” হয়ে উঠতে চাইবে। ঊন-বিংশ শতকের মিসরের সম্রাট নেপোলিয়ন এবং লর্ড ক্রোমারের এই “প্রগতিশীল ইসলাম” প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ এডওয়ার্ড সাইদ দিয়েছেন তার বিখ্যাত বই Orientalism এ। এবং লর্ড ক্রোমার Modern Egypt বইয়ে বেশ খোলামেলা-ভাবেই তার প্ল্যান পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছেন।

ঠিক সেসময়টাতে ঔপনিবেশিকদের অনুগত প্রাচ্যবাদী পণ্ডিতমহল কর্তৃক হাদিসের নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্ন একটি বড়সড় বিতর্ক আকারে উঠে আসে, এবং খুব সহজেই সেটা “প্রগতিশীল” মুসলিম অঙ্গনে একটি গ্রহণযোগ্য বিতর্কের বিষয় হিসেবে স্থান পেয়ে যায়। যেকোনো জ্ঞান-তাত্ত্বিক প্রশ্নের মোকাবেলায় সহস্র বছর যাবৎ চর্চিত ইসলামের ট্র্যাডিশনাল যে পন্থা রয়েছে, তার তুলনায় তারা ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বের প্রাচ্যবাদী পদ্ধতি কে বেশি আধুনিক এবং কার্যকরী মনে করা শুরু করলেন। এই আঠারো ও উনিশ শতকের কতিপয় মুসলিম স্কলার ইসলামে হাদিসের অবস্থান এবং এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা বিষয়ে পূণর্বিবেচনার আহবান জানান। বিশেষত উপনিবেশ শাসিত ইন্ডিয়া ও মিশরে এর জোর আওয়াজ ওঠে। এই “প্রগতিবাদী মুসলিমগণ” ইসলামকে আধুনিকতা ও প্রাচীনতার মাঝে দোদুল্যমান অনিশ্চয়তার ভেতর দেখতে পান। এবং সর্বগ্রাসী ইউরোপীয় আলোকায়িত সভ্যতায় ইসলামের ভূমিকা কি হবে সেটা নিয়ে ভাবেন।


এমন চিন্তা থেকেই ঊনিশ শতকের শেষে এসে এই মুসলিম স্কলারগণ হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রাচ্যবাদী কায়দায় প্রশ্ন তুলা শুরু করেন,এবং হাদিসের ব্যাপারে গণ-সন্দেহ তৈরি করেন।আধুনিক বিজ্ঞান, মতবাদ ও দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কিংবা বিজ্ঞানের সাথে আপাত বিরোধ আছে, এমন সকল হাদিস তারা নির্বিচারে বর্জন করতে শুরু করেন। হাদিস যাচাইয়ের এই পদ্ধতিই একসময় তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে হাদিস বর্জনের দিকে নিয়ে যায়, এবং শুধুমাত্র কুরআনকেই ইসলামী জ্ঞানের একমাত্র উৎস হিসেবে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান, চেরাগ আলি এবং আহমদ খাজা অমৃতসরি এই পথেই হাঁটেন। তাদের এই চিন্তাকেই পরবর্তীতে গোলাম পারভেজ এবং আব্দুল্লাহ চক্রালভী প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রাতিষ্ঠানিকতা দান করেন আহলে কুরআন নাম দিয়ে। তাদের মতে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝার জন্য কুরআনই যথেষ্ট, হাদিসের কোন প্রয়োজন নেই। (Daniel W.Brown, Rethinking Tradition in Modern Islamic thought, P:98)


ড্যানিয়েল ব্রাউনের মতে, হাদিসের ব্যাপারে এই সন্দেহমূলক আচরণ এবং একে বর্জন করে স্রেফ কুরআন কে গ্রহণ করার পেছনে একমাত্র প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে গোল্ডযিহার এবং তার মত অপরাপর প্রাচ্যবিদদের হাদিস বিষয়ক প্রস্তাবনা ও উদ্ভাবনসমূহ। (W.Brown, P:102)


উনিশ শতকেই গোল্ডযিহার এবং এবং মারগোলিয়থের হাদিস বিষয়ক কাজগুলো আরব খৃষ্টান মিশনারিদের দ্বারা আরবিতে এবং ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে প্রচারিত হতে লাগলো।প্রগতিশীল মুসলিম মহলে এগুলো খুব সমাদৃত হলো এবং একে কেন্দ্র করে তাদের চিন্তা আন্দোলনের গতিপথ নির্দিষ্ট হতে লাগলো। এছাড়াও মিশর, লেবানন, সিরিয়া থেকে প্রচুর ছাত্র পাঠানো হতো ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা সেখানে প্রাচ্যবাদী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের চিন্তা নিয়েই দেশে ফিরতো। ( সিদ্দিক আল-বাশির, আত-তা’লিক্বাতুন নাক্বদিয়াহ, পৃঃ৭২-৭৩)


ঔপনিবেশিক মিশরের আধুনিকতাবাদীরা হাদিস বিরোধী এই আন্দোলনকে জ্ঞান-তাত্ত্বিকভাবে বিভিন্ন দিক দিয়ে বেগবান করেছেন। কিন্তু ভারতের আহলে কুরআন আন্দোলনের ন্যায় মিশরের আধুনিকতাবাদীরা সরাসরি এই অবস্থান গ্রহণ করেনি। তারা কখনো পুরোপুরিভাবে হাদিস বর্জনের কথা বলেননি। তারা বরং নিজ থেকে হাদিস গ্রহণ ও বর্জনের একটি মানদণ্ড ঠিক করেছিলেন। যদি এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হত তাহলে হাদিস কে গ্রহণ করতেন, অন্যথায় বর্জন করতেন। তাদের মতে,কোন হাদিস যদি মুতাওয়াতির পর্যায়ের হয়, কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, এবং আধুনিক যুক্তি ও বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলেই কেবল একটি হাদিস গ্রহণ করা যেতে পারে, অন্যথায় এটি জাল বা বানানো হাদিস হিসেবেই বিবেচিত হবে।
মোহাম্মদ আব্দুহুকেই এই ধারার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেখা হয়। তিনি স্পষ্টভাবেই ঘোষণা দিয়েছেন, মুসলিমদের সময় এসেছে হাদিসের পরিবর্তে কুরআনকেই একমাত্র বিশুদ্ধ ও সন্দেহমুক্ত কিতাব হিসেবে আঁকড়ে ধরার। (ফিদ্দাহ বিনতে সালেম, আল-আসারুল ইস্তেশরাক্বি পৃঃ১২৫)


আব্দুহুর পর রশিদ রেজা, কাসেম আমিন, ইসমাইল মানসুর, আহমদ আমিন, মাহমুদ আবু রাইয়াহ, ইব্রাহীম ফাওযি, সা’দ আশমাউই সহ অসংখ্য গবেষক ও চিন্তকগণ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই হাদিসের প্রাচ্যবাদি বয়ান কে হাদিস যাচাইয়ের ধ্রুব মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ডক্টর মোস্তফা আস-সিবাঈ তার বিখ্যাত বই “আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা” তে দেখিয়েছেন, কিভাবে এই প্রাচ্যবাদ প্রভাবিত চিন্তক ও গবেষকগণ সরাসরি ইসলামের জ্ঞানচর্চার ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি কে চ্যালেঞ্জ করে বসেন এবং একে এই সময়ের জন্য মূল্যহীন হিসেবে আখ্যা দেন।


ডক্টর ফিদ্দাহ বিনতে সালেম “আল আসারুল ইস্তেশরাক্বি” তে মিশর ও আরবের প্রাচ্যবাদ প্রভাবিত চিন্তক ও গবেষকদের হাদিস বিষয়ক কাজগুলোকে সবিশদ বিশ্লেষণ করেছেন এবং এই চিন্তার উৎস সন্ধান করেছেন। প্রাচ্যবাদ কিভাবে মুসলিম চিন্তার সবচেয়ে মজবুত জায়গাটাতেও আঘাত হেনে নড়বড়ে করে দিয়েছে, ডক্টর ফিদ্দাহর বই থেকে সেটা স্পষ্টভাবেই বুঝা যায়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো বর্তমান সময়ে এই প্রবণতা আরও ব্যাপক আকারে আশঙ্কাজনক হারে মুসলিম সমাজে দেখা দিয়েছে। যার শেকড় আমরা অনায়াসেই হাদিসের প্রাচ্যবাদি বয়ানে খুঁজে পাই।


শেষকথা


হাদিস হলো সমুদ্রসম এক বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার। এর ভেতরে নির্ভরযোগ্য, অ-নির্ভরযোগ্য সবধরনের হাদিসই রয়েছে। কোন মুসলিম এই দাবি করেন না যে, রাসূল সা: এর নামে যা পাওয়া যায় তার সবটাই নির্ভরযোগ্য হাদিস। কিন্তু হাদিস যেহেতু দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেহেতু কুরআনের পাশাপাশি হাদিসকেও সংরক্ষণের ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহই করেছেন।


একেবারে শুরুর যুগের হাদিস বিশারদগণ হাদিস কে তাদের অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। কোন হাদিস কতটা শক্তিশালী এবং গ্রহণযোগ্য, এবং কোন হাদিসটি দুর্বল বা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়, সেটা যাচাইয়ের জন্য তারা অকল্পনীয় বিস্তৃত এবং সুশৃঙ্খল একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। সুতরাং হাদিসের নির্ভরযোগ্য হওয়া বা না হওয়ার প্রশ্নটি মুসলিম জ্ঞান-জগতের ভেতরকার প্রশ্ন, প্রাচ্যবাদের নতুন আবিষ্কার নয়। বিশেষত প্রথম তিন শতকের হাদিস বিশারদগণ হাদিসের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্নটিকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব ও সতর্কতার সাথে মোকাবেলা করেছেন। এবং এই প্রশ্ন কে সামনে রেখে তারা উসুলে হাদিস, ইলমুর রিজাল, ইলমুল ইস্তেলাহ, ইত্যাদি নামে এমন ব্যাপক ও বিস্তৃত কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত তুলনাহীন। পৃথিবীর আর কোন জাতি বা ধর্ম তাদের অতীত কে এতোটা সুরক্ষিত ও মজবুত উপায়ে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং হাদিস বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে হাদিসের ট্র্যাডিশনাল জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়াটা আবশ্যক।

শেয়ার করুন

image_print
Picture of হুজাইফা মাহমুদ
হুজাইফা মাহমুদ
হুযাইফা মাহমুদ, জন্ম হবিগঞ্জ সদরে। দারুল আরকাম বিবাড়িয়া থেকে হিফজ সম্পন্ন করার পর ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়ায় অধ্যয়ন করেছেন আট বছর। দারুল উলুম দেওবন্দেও দাওরায়ে হাদীসে অধ্যয়ন করেছেন। দেশে ফিরে হাদীস শাস্ত্র বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন একবছর, দারুল ফিকরে। একটা সময় কবি হিসেবে দুই বাংলায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। 'অন্ত:স্থ ছায়ার দিকে' তাঁর প্রথম কবিতার বই। অবশ্য কাব্য চর্চার চেয়ে ইসলাম শরীয়া দেশ সমাজ দর্শন ইতিহাস রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মি প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখার প্রতিই তার বেশি ঝোঁক। অনুবাদ করেছেন কিছু দূর্দান্ত বই। বর্তমানে তিনি ওমান প্রবাসি।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া