সেক্যুলারিজম: রাষ্ট্র থেকে গির্জার পৃথকীকরণ- জা’ফর শেখ ইদ্রিস

রাষ্ট্র থেকে গির্জার পৃথকীকরণের ধারনাটি পশ্চিমে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে, এবং তাদের মাধ্যমেই এটি একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এই ধারণাটি উদ্ভূত হয়েছে মূলত পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতিতে খৃষ্টান ও অন্যান্য লোকদের সমস্যাবলীকে মোকাবেলার জন্য একটি প্রায়োগিক কৌশল হিসেবে।


ধীরে ধীরে, যেভাবেই হোক, রাষ্ট্র থেকে গির্জার কর্তৃত্ব কে পৃথক করার ধারণাটি প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্যই একটি জনপ্রিয় কিংবা বলা চলে অবশ্যাম্ভাবি রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে এখন দেখা হয় যেকোনো রাষ্ট্রে বসবাসের জন্য ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং নাগরিকত্বই তার মূল ভিত্তি হওয়া উচিৎ; যেহেতু বহু ধর্মের বহুলোক বসবাস করে একই রাষ্ট্রে। রাষ্ট্র যদি কোন একক ধর্মের আজ্ঞাবাহক হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য ধর্মের লোকেরা নিজেদেরকে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করবে, এবং অপর একটি ধর্মকে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। তারা হয়তো তখন নিজেদের ধর্মীয় আচার আচরণ ও বিধিবিধান চর্চায় বাধাগ্রস্ত হবে, এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদ-প্রাপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত হবে। যেমন প্রেসিডেন্টের পদ বা আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যেসব জায়গা আছে। যা পরবর্তীতে নানান সঙ্কট ও সংঘাত তৈরি করবে, এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।


এসব কারণে এই পদ্ধতির (সেক্যুলার) প্রবক্তা ও সমর্থকরা মনে করলেন, সবচে ভালো হয় রাষ্ট্র যদি সেক্যুলার অবস্থান গ্রহণ করে; মানে কোন ধর্মকে সমর্থনও করবে না আবার কোন ধর্মকে অস্বীকারও করবে না। বরং ধর্মের ব্যাপারটা সম্পূর্ণই নাগরিকদের উপর ন্যস্ত থাকবে; কোন ধর্ম বা মূল্যবোধ তারা লালন করবে আর কোন ধর্মের বিধিবিধান মেনে চলবে–সেটা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছানুযায়ী হবে।


তো, এটা হলো নিরপেক্ষ সেক্যুলার রাষ্ট্রের একেবারে আদর্শ উদাহরণ, পশ্চিমা রাজনীতিবিদগণ যেটার বাস্তবায়ন ঘটানোর ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার এই রাজনৈতিক প্রকল্প এমন কিছু কাল্পনিক পূর্বানুমান তৈরি করেছে, বাস্তব জগতে যার অস্তিত্ব পাওয়া খুবই মুশকিলের ব্যাপার। তেমন কিছু বিষয় এখানে বিচার-বিবেচনা করে দেখা যাক।


ধারণা করা হয় যে, একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্য সব ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা খুবই সম্ভব, তবে এর ভিত্তি হলো ধর্ম রাষ্ট্রের কোন বিষয়ে নাক গলাতে পারবে না এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলীর উপর প্রভাব খাটাতে পারবে না। এটা সম্ভব হতো, যদি বাস্তবেই রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলীর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক না থাকতো, এবং তারা উভয়েই যদি একে অপর থেকে পৃথক কোন সত্তা হতো। যেহেতু, ধর্মের সম্পর্ক কেবলই কিছু সমষ্টিগত বিশ্বাস, বিধিবিধান আর ব্যক্তির নিজস্ব আচার-আচরণের মাঝেই সীমাবদ্ধ না যে, সমাজের উপর এর কোন প্রভাব থাকবে না। বরং বহুল প্রসিদ্ধ ধর্মগুলোর অধিকাংশেরই–খৃষ্টান, ইহুদি, ইসলাম–এমন অনেক আইন-কানুন আছে যেগুলোকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা সম্ভব না। সেটা পারিবারিক বা ব্যক্তি-পর্যায় থেকে নিয়ে বৃহত্তর সমাজ পর্যন্ত, এমনকি খাদ্য-পানীয়সহ মানুষের দৈনন্দিন রুটিনের বহু কাজ আছে যা সরাসরি রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত।


এই বিরোধ সমাধানের জন্য পশ্চিমা রাজনীতিবিদগণকে কিছুটা আপোসকামিতায় নেমে আসতে হয়েছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাষ্ট্রের আইন-কানুন বানানোর ক্ষেত্রে কিছু ধর্মীয় (খৃষ্ট ধর্ম) মূল্যবোধকেও রাখা হবে। আর পশ্চিমা ফরেইন পলিসিতে খৃষ্টান ধর্মীয় মূল্যবোধ কী, সেটা একদমই পরিষ্কার, বিশেষত ইসলামী বিশ্বের মোকাবেলায়।

একই সময়ে খৃষ্ট ধর্মের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল নিতান্তই অবহেলিত ও প্রশ্নের সম্মুখীন। উদারবাদী আন্দোলনগুলো (liberal movements) বেশ আক্রমণাত্মক হয়েছিল তার প্রতি। তারা প্রশ্ন তুলল, বর্তমানে খৃষ্টানদের যেসব গ্রন্থসমূহকে পবিত্র গ্রন্থ ও আল্লাহর বাণী হিসাবে মানা হয়, এগুলো স্রেফ কিছু মানুষের বানানো কথা, যার লেখকেরা তৎকালীন সমাজ ও সংস্কৃতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এই মতবাদটি আরও ভালোভাবে শক্তিশালী ও সমর্থিত হয় বাইবেলের আলাদা আলাদা সংস্করণ উপস্থিত থাকায়। এক সংস্করণের সাথে অপর সংস্করণের বৈসাদৃশ্য প্রচুর। একইভাবে, বাইবেলে কিছু ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে–যেমন সমকামিতা–তো, সেসব নিষেধাজ্ঞাকে স্রেফ সামাজিক আইন হিসাবে দেখা উচিৎ, যা একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত মেনে চলা হতো। বর্তমান সময়ে সেই মান্ধাতা আমলের আইন মেনে চলার কোন যুক্তি নাই।


বাইবেল-বিরোধী এই আন্দোলন রাজনীতিবিদ, নেতা-নেত্রী, এমনকি ধর্মীয় পণ্ডিতদেরও সমর্থন লাভে সক্ষম হয়। এর ফলস্বরূপ, সেক্যুলারিজম নিজে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বাকি থাকেনি আর। এখন চাইলে সেক্যুলারিজমকে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবেও বিবেচনা করা যায়, পশ্চিমা সমাজে যার উগ্র অনুসারী ও সমর্থক আছে, এবং তারা প্রতিনিয়ত খ্রিস্টবাদকে আক্রমণ ও এর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।
সুতরাং, রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার এই আধুনিক প্রবণতাকে মুসলমানরা কিভাবে গ্রহণ করতে পারে তাদের নিজেদের দেশে?


ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অন্যতম একটি হলো কুরআন কোনরূপ সন্দেহ ছাড়াই শতভাগ আল্লাহর কালাম, এবং হাদিসও আল্লাহ কর্তৃক প্রদর্শিত মুসলমানদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পথ-নির্দেশনা। ইসলাম কোনোভাবেই রাষ্ট্র থেকে আলাদা হতে পারে না। কেননা, ইসলাম একদম খোলামেলা-ভাবে সবিস্তারে মানুষকে তাদের ব্যক্তি-জীবন থেকে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত সবকিছুর নির্দেশনা দেয়।সুতরাং সেক্যুলারিজম কে বর্জন করা ব্যতীত মুসলামনদের আর ভিন্ন কোন পথ নেই, যেহেতু সেক্যুলারিজম শুরুতেই রাষ্ট্র থেকে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও আইনকে বাতিল করে দেয়।


সেক্যুলার রাষ্ট্রের সমর্থকরা এই বিতর্ক উত্থাপন করেন যে, এক ধর্মের মূল্যবোধ সেই রাষ্ট্রের অন্যান্য ধর্মের লোকদের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না, যেমনটা আমাদের অনেক দেশেই দেখা যায়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, অমুসলিমরা কোন মুসলিম দেশে কম হোক বা বেশি হোক, সেক্ষেত্রে সেক্যুলারিজম এর কোন সমাধান নয়। অমুসলিমরা মুসলিম রাষ্ট্রে হয় নিজেরা সেক্যুলার হবে, ইসলামকে রাষ্ট্রের আইন হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য, নতুবা তারা নিজ নিজ ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হবে, এবং তারা চাইবে রাষ্ট্রের আইন চলুক তাদের ধর্ম অনুযায়ী। তো, এই উভয় অবস্থাতেই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোন ছাড় দেয়া সম্ভব না।


এখানে বিশেষভাবে যে জিনিসটি মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো, ইসলামি আইন অনুসারে ইসলামি রাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মপালন নিষিদ্ধ নয়। বরং ইসলামের সাথে সাথে রাষ্ট্রে বসবাসরত অন্যান্য ধর্ম-বিশ্বাসের লোকদেরকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষা দেয়া হবে।


পশ্চিমের সেক্যুলারপন্থীরা প্রথমত এ মতের সাথে একমত হবে, তারপর প্রশ্ন তুলবে, ইসলামী আইনের অধীনে তো সকল ধর্মের নাগরিক সমান অধিকার পাবে না। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম দেশে কোন অমুসলিম কখনো প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না।
এই প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থাও তো এর ভিন্ন কিছু না! কেননা কোন মুসলমান সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। যেহেতু সেক্যুলার সিস্টেমে একজন প্রেসিডেন্টকে দেশের সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে হয়। একজন মুসলমানকে তার নিজস্ব ধর্মের বিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়ে সেক্যুলার বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে হয়, এবং সেটা বাস্তবিক অর্থেই স্বতন্ত্র একটি ধর্ম।


মুসলমানদের জন্য ‘ধর্ম’ শব্দটি নিছকই কতগুলো বিশ্বাস আর বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপ নয়, বরং এটা এমন এক সামগ্রিক জীবনের কথা বলে যাতে রয়েছে সবরকমের মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, আচার-আচরণ, এবং জীবনযাপনের সার্বিক দিকনির্দেশনা।


সুতরাং, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোন দেশের জন্য সেক্যুলারিজম আদৌ কোন সমাধান নয়। কারণ, এর মৌলিক দাবীই হলো মানুষ তার খোদা-প্রদত্ত বিধিবিধানকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মানব-রচিত ধর্মকে গ্রহণ করবে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করা মুসলমানদের জন্য কোন ‘অপশন’ হতে পারে না, যেহেতু এটা আল্লাহর আইনকে বাতিল করে দেয় মানব-রচিত আইন গ্রহণ করার জন্য।


সেক্যুলারিজম এবং নৈতিক মূল্যবোধ

মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ,যেমন সততা,বিশ্বস্ততা,ন্যায়,সতীত্ব ইত্যাদি হলো সহজাত মূল্যবোধ,যা স্বয়ং আল্লাহ মানুষের ভেতর প্রোথিত করে দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন এমন এক জীবন-বিধান দিয়ে,যা এই সহজাত মানবিক স্বভাবের সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আল্লাহ বলেন: অতএব তোমার মুখ দীনের প্রতি একনিষ্ঠ-ভাবে কায়েম করো। আল্লাহর প্রকৃতি(ফিতরাত) ,যার উপর মানুষ কে তিনি সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন হয়না। এটিই হচ্ছে প্রকৃত দীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানেনা। ( সুরা রুম,আয়াত-৩০)


একজন বিশ্বাসী মানুষ এইসব নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলে তার স্বভাবজাত প্রেরণা থেকেই, যা বিশ্বাসের জোরে বলিয়ান হয়। কারণ যে ধর্মে সে বিশ্বাস রাখে,সেই ধর্মই তাকে আদেশ দেয় এগুলো মেনে চলার জন্য,এবং এর বিনিময়ে পরকালে তার জন্য মহা পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর বিপরীতে সেক্যুলারিজমের সবচে কম ক্ষতিকর রূপটিকেও যদি আমরা গ্রহণ করি,অর্থাৎ স্রেফ ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করা, তাহলেও আমরা দেখি সেক্যুলারিজম মৌলিকভাবেই মানব হৃদয়ে নৈতিক মূল্যবোধের প্রধান দুটি স্তম্ভ কে নিদারুনভাবে অবহেলা ও মূল্যহীন করে তুলছে। অর্থাৎ ধর্মীয় বিধান এবং মানুষের সহজাত সত্ত্বা-গত বোধ।


আর যদি আমরা সেক্যুলারিজমের নাস্তিক্যবাদি কট্টর রূপটির দিকে তাকাই,তাহলে দেখবো যে এটি নৈতিক মূল্যবোধের প্রধান দুটি স্তম্ভ কে কেবল মূল্যহীন ই না,বরং পুরোপুরি ধ্বংসই করে দিয়েছে। ধর্ম ও স্বভাবজাত মূল্যবোধের জায়গায় তারা এনে বসিয়েছে মানব ইচ্ছা বা খেয়াল খুশির বিধান। সেটা কখনও স্বৈর-তান্ত্রিক পদ্ধতিতে কতিপয় মানুষের বিধান,আবার কখনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনেক মানুষের বিধান ও চাহিদা।
আল্লাহ বলেন: তুমি কি তাকে দেখেছো,যে তার কামনা বাসনা কে উপাস্য-রূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তবে তার অভিবাভক হবে? ( ফুরকান-৪৩)


যেহেতু মানুষের চাহিদা ও কামনা বাসনা নিয়ত পরিবর্তনশীল, সুতরাং এগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা মূল্যবোধ এবং আচরণও সদা পরিবর্তনশীল। আজকের বিবেচনায় যে জিনিসটি কে অপরাধ এবং আইনত কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, হয়তো আগামীকালই সেটা আইনত বৈধ হয়ে যাবে, এবং একে প্রশংসাযোগ্য কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে। আর যে এর বিরোধিতা করবে সে হয়ে পড়বে “নৈতিকভাবে ভুল” (politically incorrect) ।


এইযে এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গিতে অনায়াসে স্থানান্তরিত হওয়া, এর মূল কারণ হলো মানুষের স্বভাবজাত ধর্মীয় মূল্যবোধ কে সমাজ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের এমন ঘটনা হর-হামেশাই ঘটছে। একটা ট্র্যাডিশন -মানা সমাজ বা এর সদস্যারা যতোই অজ্ঞ-মূর্খ হোক, তারা কিছু মৌলিক মূল্যবোধ/ অন্তর্নিহিত ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলে। কিন্তু সমাজটা যতোই সেকুলারিজমে প্রবেশ করে, ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলা লোকের সংখ্যা তত কমতে থাকে, তাদের প্রভাবও ক্রমাগতভাবে প্রান্তিক বা কোণঠাসা হতে থাকে। এটা চলতেই থাকে যে পর্যন্ত না সমাজটি সামষ্টিকভাবে ওই মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে ওঠে, যে-মূল্যবোধ গুলোকে একদা তারাই ঊর্ধ্বে তুলে রাখতো বা প্রাধান্য দিত।


আবার, প্রচলিত জাহিলি সমাজ কিন্তু কিছু ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলে কারণ সেগুলো তাদের আকাঙ্ক্ষা বা বাসনার সাথে মিলে , ওগুলো তাদের ঐতিহ্যের সাথে যায় এবং তাদের প্রত্যাশার সাথে এগুলোর কোন দ্বন্দ্ব হয়না।
আল্লাহ বলেন: আর যখন তাদের ডাকা হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি,যেন তিনি তাদের মাঝে একটি মীমাংসা করে দেন,তখন দেখো তাদের মাঝে একটি দল তা প্রত্যাখ্যান করে ফিরে যায়। কিন্তু যখন ন্যায়পরায়ণতা তাদের পক্ষে যায়,তখন তারা তাঁর কাছে আসে ঘাড় নুইয়ে। (সুরা নূর-৪৮-৪৯)


সত্যের সাথে তাদের সম্পর্ক হলো শয়তানের মতো, যেমনটা রাসূল সা: আবু হুরায়রা রাযিঃ কে বলেছেন। শয়তান আবু হুরায়রা রাযিঃ কে প্রতি রাতে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছিলো। এটা শুনে রাসূল সা: বলেছেন,সে সত্যই বলেছে। যদিও সে ভয়ানক এক মিথ্যাবাদী। অর্থাৎ,সর্বদা মিথ্যা বলে অভ্যস্ত ব্যক্তিও কখনও সত্য বলতে পারে।


বর্তমান পশ্চিমা সেক্যুলার সমাজগুলো হলো এই পরিবর্তনশীল এবং জাহিলি সভ্যতার পরস্পরবিরোধী স্বভাব ধারণের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। তারা এক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ কে একটি আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল ব্যাপার হিসেবে দেখে। আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু মূল্যবোধ কে চিরন্তন “মানবিক মূল্যবোধ” এর নামে চিহ্নিত করে, এবং এর লঙ্ঘন কে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। তাদের আরোপিত এই মূল্যবোধ যারা লঙ্ঘন করবে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।


এই সমস্যার উৎস এমন দুটি মৌলিক নীতি ও আদর্শ,যার উপর গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার সমাজগুলো প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত,সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে কথা ও কর্মের সত্য মিথ্যা বা ন্যায় অন্যায় নির্ধারণ করা। দ্বিতীয়ত,ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি। এই দুটি মূলনীতিই একটি অপরটির সাথে সাংঘর্ষিক হবে, যদি না তাদের কে অপর আরেকটি মূলনীতির অধীনে রাখা হয়,যা তাদের উভয়ের মাঝে সমাধা করবে।


সেক্যুলারিজম তার সত্ত্বা-গত কারণেই ধর্ম কে সবকিছু থেকে খারিজ করে দেয়। আর সেক্যুলারিজমের পশ্চিমা সংস্করণে ফিতরাহ ( স্বভাবজাত মূল্যবোধ)কে মানবজাতির জন্য কোনটা উপকারী এবং কোনটা ক্ষতিকর এটা নির্ধারণের জন্য মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা হয়না। ফলে কোন বিকল্প না রেখেই পূর্বোল্লিখিত দুটি মূলনীতি কে অবধারিতভাবে গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ কোন কাজটি অনুমোদিত এবং যথাযথ, এবং কোনটি নয়, সেটা ঠিক করা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মূলনীতি দ্বারা। এই উভয় মূলনীতির মাঝে পারস্পরিক বৈপরীত্য ও দ্বান্দ্বীকতা স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হচ্ছে সেসব সমাজে চলমান কিছু সরগরম ইস্যুর মাধ্যমে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,যারা সমকামিতা কে গ্রহণ করা এবং তাদের জন্য সমাজের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করার প্রবক্তা আছেন,তারা তাদের এই দাবী প্রতিষ্ঠা করতে চান ব্যক্তি অধিকারের (individual rights) মূলনীতির উপর ভিত্তি করে। তারা মনে করেন, কোন মানুষের যৌন চাহিদা কেমন,কার প্রতি,সেটা প্রকাশ করলে, এ নিয়ে অন্যদের বিচলিত হওয়ার কোন অধিকার নাই। একই যুক্তি প্রদর্শন করেন তারাও,যারা গর্ভপাত ( Abortion) কে সমর্থন করেন। তাদের মুখে সবসময়ই একথা শুনা যায় যে, “আমার একান্ত নিজস্ব বিষয়ে এবং নিজের শরীরে আমার ইচ্ছা-স্বাধীনতা প্রয়োগ করা থেকে কোন যুক্তিতে নিষিদ্ধ করা হবে আমাকে! কোন কর্তৃপক্ষের মোটেও এই অধিকার নেই যে সে এরকম ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবে!”


তো সমকামিতা এবং গর্ভপাতের বিরোধিতা যারা করেন,তখন তাদের একমাত্র যুক্তি হলো, এই জাতীয় কাজ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধের পরিপন্থী! যদিও গর্ভপাতের বিরোধিতা যারা করেন তাদের অনেকেই নৈতিক ও ধর্মীয় জায়গা থেকে করেন,কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে বলতে পারেন না। নৈতিক ও ধর্মীয় যুক্তি প্রয়োগ ও করা সম্ভব না। যেহেতু সেক্যুলার সমাজ এই দুটোর কোনটিকেই গ্রহণ করতে সক্ষম না।


যদি আমরা এটা মেনে নেই যে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত ব্যতীত মূল্যবোধের আর কোন ভিত্তি নাই,এবং স্থান কাল পাত্র ভেদে মূল্যবোধের পরিবর্তন সম্ভব,তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় যে মূল্যবোধ এবং মানুষের ইহ-পরকালিন জীবনের লাভ ক্ষতির মাঝে কোনধরনের সম্পর্ক নাই। অর্থাৎ সকল মূল্যবোধ ই সমান ভাবে বৈধ,সুতরাং কোন সমাজ একে গ্রহণ বা বর্জন করাতে কিছু যায় আসেনা। আজকের দিনে যেসব কাজ ও আচরণ কে একটি সেক্যুলার সমাজ জঘন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে,যেমন শিশুদের যৌন হয়রানি (Pedophilia) ,নারীদের ধর্ষণ ইত্যাদি,এবং এসব অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির আইন রয়েছে, এটা স্রেফ বর্তমান সময়ের ঝোঁক ও প্রবণতা হিসেবে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যদি আজকের এই জঘন্য অপরাধগুলোই আগামীকাল বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়বে ব্যক্তি স্বাধীনতার মূলনীতির ভিত্তি তে।


যে কারণে একজন ধর্মহীন মানুষ(secularist) দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যখন সে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয় যে, যেসব কাজ কে সে জঘন্য অপরাধ বলে মনে করছে এর কোনটাই সেক্যুলারিজমের মূলনীতি,তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে নয়,বরং সমষ্টিগত ভাবে আল্লাহ মানুষের ভেতরে যে সুস্থ চিন্তা ও স্বভাবজাত নৈতিক বোধ প্রোথিত করে দিয়েছেন তারই অবশিষ্টাংশ বোধের কারণে, সেক্যুলারিজম কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা সত্ত্বেও তার ভেতরে যা এখনও ক্রিয়াশীল।


সেক্যুলার মানুষের দ্বিধা ও সংশয় হয়তো আরও বেড়ে যাবে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, কি কারণে সে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কে প্রাধান্য দিয়েছে,যেখানে চাইলে সে নিজেই এগুলোর মানদণ্ড নির্ধারণ করতে পারতো ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তিতে?


এর উত্তরে যদি সে বলে,এর কারণ স্রেফ তাঁর ব্যক্তিগত প্রাধান্য এবং ঝোঁক,অথবা দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি অতি ভক্তি। তাহলে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূলনীতি তে যারা এসব ক্ষেত্রে তার বিরোধিতা করবে, অথবা তার সমাজের চেয়ে ভিন্ন আদর্শ লালন করে যে সমাজ তাদের ব্যাপারে সে কি বলবে? অর্থাৎ তার সমাজে যা অপরাধ অন্যকোন সমাজে সেটা অপরাধ না।


সেক্যুলার সমাজগুলোর মূল্যবোধের এই অযৌক্তিক ভিত্তিই তাদেরকে কখনও সেইসব মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়,যেগুলো তারা তখনও আঁকড়ে ধরে আছে। এবং এই অযৌক্তিক ভিত্তিই তাদের কে দুর্বল জাতিগুলোর উপর দখলদারি,সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের পথ খুলে দেয়। কোনকিছুই তাদের কে এ থেকে বিরত রাখতে পারবেনা। তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলবে,আমরা যদি অমুক দেশটির উপর আক্রমণ করি বা দখল করে ফেলি তাহলে এতে আমরা জাতীগতভাবে অনেক লাভবান হবো। তখন দেশের বৃহত্তর একটি অংশ তার সমর্থনে দাঁড়িয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে তার প্রস্তাবই তখন হয়ে পড়ে অফিসিয়াল পলিসি।

তো,স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে আরেকটি জাতির উপর আক্রমণের বৈধতার ব্যাপারে যে জনমত তৈরি হয়েছে এর ভিত্তি কোন নৈতিকতা নয়,বরং স্রেফ সম্পদের লোভ। ইতিহাস ঘাঁটলে এটাই দেখা যায় যে,সমস্ত অপরাধ ও অন্যায়ের বৈধকরণ ঘটেছে এই মূলনীতিতেই। প্রকৃতপক্ষে এই একই মূলনীতি,অর্থাৎ নৈতিক লক্ষ্য ব্যতীত স্রেফ লোভের বশবর্তী হয়ে পশুরাই কেবল অন্য পশুদের উপর আক্রমণ করে।


একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই দেখা যায়,প্রকৃত পক্ষে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতও কোন সেক্যুলার সমাজের মৌলিক ভিত্তি হতে পারে না। কেননা,কাউকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়া হলে তার এমন একটি মানদণ্ডের প্রয়োজন দেখা দিবে,যাকে সে তার ইচ্ছার নির্ণায়ক হিসেবে ব্যাবহার করবে। ঠিক একইভাবে,সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতও স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন মানদণ্ড নয়। বরং এটাও অনেকগুলো একক ব্যক্তির ইচ্ছার সমষ্টি, যার ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ড রয়েছে। এ পর্যায়ে এসে একটি অপরটির সাথে সাংঘর্ষিক হয়,যা আমরা পূর্বে দেখিয়েছি।


সুতরাং, সেক্যুলার সিস্টেমে একজন মুক্ত মানুষ ও মুক্ত সমাজের ইচ্ছার মূল ভিত্তি কী? কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংশয় না রেখেই একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে,এর ভিত্তি হলো কিছু মানুষের ইচ্ছা ও কামনা বাসনা, যা আল্লাহর দেয়া প্রকৃত মূল্যবোধের জায়গাকে দখল করে রেখেছে।

শেয়ার করুন

image_print
Picture of হুজাইফা মাহমুদ
হুজাইফা মাহমুদ
হুযাইফা মাহমুদ, জন্ম হবিগঞ্জ সদরে। দারুল আরকাম বিবাড়িয়া থেকে হিফজ সম্পন্ন করার পর ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়ায় অধ্যয়ন করেছেন আট বছর। দারুল উলুম দেওবন্দেও দাওরায়ে হাদীসে অধ্যয়ন করেছেন। দেশে ফিরে হাদীস শাস্ত্র বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন একবছর, দারুল ফিকরে। একটা সময় কবি হিসেবে দুই বাংলায় প্রসিদ্ধ ছিলেন। 'অন্ত:স্থ ছায়ার দিকে' তাঁর প্রথম কবিতার বই। অবশ্য কাব্য চর্চার চেয়ে ইসলাম শরীয়া দেশ সমাজ দর্শন ইতিহাস রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মি প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখার প্রতিই তার বেশি ঝোঁক। অনুবাদ করেছেন কিছু দূর্দান্ত বই। বর্তমানে তিনি ওমান প্রবাসি।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া