প্রথম যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলাম, কী পরিমাণ বিস্মিত হয়েছিলাম—বড় হবার পর সেই স্মৃতি মনে করার আর সুযোগ নেই। এরপর যত বড় হয়েছি ক্রমশ অভ্যস্থতায় সবকিছু সয়ে এসেছে। আশ্চর্য সুন্দর সবুজ গাছপালা, পাহাড় নদী মানুষ ও সম্পর্ক—সকল কিছু নিগূঢ় অনুভবে বিস্ময়ের যে কাঁপন তৈরী করার কথা ছিল, তা আর তৈরী করে না।
তবে কৈশরের শেষ ও তারুণ্যের দিনগুলোতে আমাদের চৈতন্য নতুন এক সংবেদনশীলতায় জেগে ওঠে। অদ্ভুত এ দিনগুলোতে দুপুরের শূন্য নীল আকাশের দিকে তাকালে হৃদয় হাহাকার করে। নদী আর নদী থাকে না; আধ্যাত্মিক কবিতার মতো মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। সুদূর দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে অযথাই চোখ ভিজে যায়। গহীন গ্রামের নিঃসঙ্গ যে পথটি নিশ্চুপ পড়ে আছে যুগ যুগ ধরে একই ভাবে, আচানক মনে হয় এ যেন কিছু বলতে চায়।
আমার কেন যেন মনে হয়—মানুষ জীবন ও সমাজ, চারপাশের পৃথিবী ও প্রাণপ্রবাহের সাথে একজন মানুষের নিবিঢ় পরিচয় তৈরী হয় মূলত এ সময়টিতেই। আট থেকে বাইশ কি পঁচিশ। এরপর মনুষের মনোযোগ সরে যায় বিবিধ পথে। ভবিষ্যত চিন্তা, কর্ম জীবনের ব্যস্ততা, পরিবারের দায় ও সামাজিকতা—এসবে বন্দি হয়ে যেতে হয় তাকে, ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায়। তারুণ্যের সেই ভাবালুতা থাকে না, সে ফুরসতও আর মিলে না।
এ সময় তার যে স্মৃতি অভিজ্ঞতা ও অনুভব, এটিই তার পরবর্তী মৌলিক সকল অনুভূতির ভীত হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর সাথে সে সম্পৃক্ত হয় মূলত সেই সময়টার ভিতর দিয়ে, তারই মধ্যস্থতায়। তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে কি মানবিক প্রয়োজনে তাকে ‘প্রাগ্রসরতার নীতি’ মানতে হয় ঠিক, কিন্তু মৌলিক পরিবর্তনটা হয় না আসলে। ফলে একজন মানুষের পৃথিবী বলতে সে সময়কার পৃথিবীটাই। এখান থেকে সে কোনোদিন বের হতে পারে না।
আমার এ অনুমান হয়তো সঠিক নয়, কিংবা পূর্ণাঙ্গ নয়; কিন্তু নিজের ব্যাপারে ব্যক্তিগত অনুভবটা এমনই। আশির দশকের একেবারে শেষ প্রান্তে জন্মেছিলাম। নব্বইয়ে পার করেছি ঘোরগ্রস্ত কৈশর। নতুন শতাব্দির প্রথম দশকে লেগেছিল তারুণ্যের ছোঁয়া। মানসিকভাবে আমি এখনো সেই নব্বই আর শূন্য দশকেই রয়ে গেছি। সেই পুরনো গ্রামে, যেখানে নৈঃশব্দ ছিল, প্রশস্ততা ছিল, সুন্দর মাটি ও ঘাস ছিল। ছিল বিচিত্র পাখিরা। তাদের কলকাকলিতে গাছপালা মুখর ছিল। মানুষের ব্যস্ততা কম ছিল, পুরো বিকেল জুড়ে মাঠভরা শিশুরা ছিল এবং সকলের মাঝে অসম্ভব সুন্দর একটি যোগাযোগ ছিল।
এরপর দেখতে দেখতে চোখের উপর মাঠঘাট সব ভরে গেল ঘরবাড়ি আর দোকানপাটে। চারপাশে অজস্র শব্দ ও অসংখ্য মানুষ, যাদের বেশিরভাগকেই আমি চিনি না। ভাঙ্গাচোরা মফস্বল শহর পুরনো খোলনলচে পাল্টে আবির্ভুত হলো সম্পূর্ণ নতুন এক চেহারায়। আর, আমি ক্রমশ চেপে আসা একটি অপ্রশস্ততায় হাঁশফাস করতে লাগলাম।
এই যে পরিবর্তন, এ যে শুধু আমার চারপাশে ঘটেছে তা নয়; পুরো পৃথবীই ক্রমশ বদলে গেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, চিন্তা ও দর্শন, আচরণ ও জীবনপরিক্রমা—কোনো কিছুই স্থিত নেই। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রবাসী মনে হয়। চারপাশ দেখি আর ভাবি—এসব কী হচ্ছে! এ আমি কোথায় এলাম!
২.
আমি জানি, পৃথিবীর নিয়মটাই এমন। সময়ের সাথে এ বদলাবেই। এবং যুক্তির জায়গা থেকে পরিবর্তনের ধারণাটিকে আমি কখনোই নিন্দা করি না। তবু, পুরাতনের প্রতি আমাদের এই যে আকর্ষণ, স্মৃতির কাতরতা, অভ্যস্থ জীবনপ্রবাহের প্রতি একান্ত পক্ষপাত—এ হয়তো আমাদের আদিম প্রবণতা।
এ কারণে নতুনকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। ভিতরে এক ধরণের শংকা ও ভীতি কাজ করে। ফলে আমরা একটা মনস্তাত্ত্বিক আত্মদ্বন্দ্বের ভিতরে বসবাস করি। সম্ভবত এই দ্বান্দ্বিকতার কারণেই সুযোগ পেলে পুরাতনের প্রতি আমাদের হাহাকার প্রকাশ করে নতুনের সমালোচনা করি। এক পা আগাই তো দু পা পিছিয়ে যাই। আর অবচেতনে খুব সূক্ষ্ম একটা অনুভূতি কাজ করে—এসব আসলে আরোপিত। সাময়িক। এই পৃথিবী আমার নয়। পুরনো সময়টা এই ফিরল বলে।
হৃদয় ও চিন্তার এই স্থিতাবস্থা একচেটিয়া ভালো কি মন্দ সেই বিচারে যাচ্ছি না; কিন্তু প্রসঙ্গত কিছু বিষয় নজরে আনতে চাইছি। কারণ, শেষ সত্য তো এই—নতুনমাত্রই খারাপ নয়। কিছু আছে অনিবার্য। একে নিতে না পারলে সৃষ্টি হবে সংঘাত ও সংঘর্ষ। সামাজিক সচলতা বাধাগ্রস্ত হবে। কিছু আছে প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর। সভ্যতার স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা। প্রয়োজনীয় এই নতুনকে গ্রহণ করতে না পারলে দিন শেষে আমিই অনুপোযুক্ত ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠব।
তাছাড়া স্মৃতি ও সত্তায় জেগে থাকা সকল পুরাতনই যে ভালো, সে নিশ্চয়তাও কি আছে? সেই সকল মন্দ পুরাতন দূর হয়ে তার জায়গায় হয়তো এসেছে নতুন ন্যায্যতা। এ নতুনকে গ্রহণ করা আমার দায়িত্ব। তাই সামাজিক ও পারিবারিক প্রথা, শাসন ও সম্পর্ক, আচরণ ও বিনিময়—সকল কিছু খুব সূক্ষ্মভাবে যাচাই করতে আমি আগ্রহী।
এই পুরনো সময় ও অনুভবে মানসিকভাবে বন্দি হয়ে থাকাটা কখনো এতো সূক্ষ্ম ও অবচেতনে হয়ে থাকে, আমরা টের পাই না। কোনো কোনো সময় এই বন্দিত্ব আমাদেরকে কিছু অন্যায্য আচরণের দিকেও পরিচালিত করে।
বড়ো ভাই ছোট ভাইকে অনেক সময় শৈশবের সেই ছোট্ট জায়গা থেকেই বিবেচনা করে। কিন্তু মানুষ তো এক বয়সে থেমে থাকে না। সে নিয়ম মতোই ছোট ভাইটি কখন বড়ো হয়ে তার নিজেরও একটা মতামত, পছন্দ অপছন্দ তৈরী হয়েছে বড়ো ভাই হয়তো সচেতনভাবে তা টের পায় না। ফলে, ছোট ভাইয়ের সাথে তার আচরণটা হয় সেই ছোটবেলার মতোই। এটা ছোট ভাইকে মানসিকভাবে পীড়িত করে। হয়তো মুখ ফুটে বলে না। কিন্তু অনেক সময় অসন্তোষ, এমনকি কখনো বিদ্রোহও তৈরী করে।
ছোটবেলা থেকে কর্মের পারিশ্রমিক দেখে আসছি একটা পরিমাণে। কিন্তু মাঝখানে বিশ বছরে সে জায়গাটিতে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। মূল্যস্ফীতি যেমন হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতিও ঘটেছে। কিন্তু পুরনো অনুভূতিতে বন্দি থাকার কারণে ঘরের কাজের মানুষের বেতন, কর্মচারির পারিশ্রমিক কিংবা শিক্ষকের সম্মানি—এসব জায়গায় গিয়ে ন্যায্যটা দিতে পারি না। পুরনো অনুভূতি ও অভ্যাসের আলোকে মনে হয় সব তো ঠিকই আছে। কিন্তু নতুন সময়ের বিচারে তা যে অন্যায্য, সেই অনুভূতিটা জাগে না।
তবু, দিন বদলের এই যাত্রা মোটের উপর একটা স্বাভাবিক নিয়মের ভিতরে ছিল; কিন্তু ২০১৫ থেকে ২৫—এ দশ বছরে পৃথিবীতে ভিন্ন এক ধরণের পরিবর্তন এসেছে। সামজ কাঠামোতে, আচরণ ও মানসিকতায়, প্রযুক্তিতে ও জীবনপরিক্রমায়। একে চির-আচরিত ‘নতুন পুরাতনের দ্বন্দ্ব’ মূলনীতি দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। বিশেষ এই নতুন সময়কে বিচার করতে হবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব ও মুসলিম পরিবারগুলোকে এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
একটা সময় ছিল দীনি ফ্যামিলির কিশোর তরুণেরা টিভি সিনেমা দেখতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। খেলার স্বাভাবিক সময় ছাড়া অন্য কোনো সময় কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও গেলেও পড়তে হতো জবাবদিহিতার মুখে। সিনেমা হলে যাওয়া তো রীতিমতো অসাধ্য সাধন। পর্নমুভি দেখার কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু এখন পৃথিবীর সকল টিভি চ্যানেলের এক মহা সমূদ্র নিয়ে তার ঘরেই একাধিক মোবাইল বিদ্যমান। এমনকি একটা কিশোর নিজেই মোবাইল কিনে ফেলছে। বাধা দিলে আত্মহত্যা করে ফেলার মতো ঘটনাও একটা দুটো নয়।
এই যে ভয়াবহ পরিবর্তন, সে অনুপাতে আমাদের নজরদারি, সচেতনতা, শাসনপদ্ধতি ও নিয়ন্ত্রণকৌশল কি আমরা পরিবর্তন করতে পারছি? নব্বইয়ের দশকে একটা কিশোরের সাইকেলের আবদার আর এখনের একটা কিশোরের মোবাইলের আবদারকে কি আমরা সত্যিকার অর্থে আলাদা করে দেখতে পারছি? ভাবা দরকার।
সঙ্গ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব তৈরী করে। জীবনের মোড় ঘুরিয় দেয়। সে কারণেই একটা সময় ছিল, যখন এলাকায় যার তার সাথে মিশতে পারতাম না। আড্ডা দিতে পারতাম না। শাসনের মুখোমুখি হতে হতো। কিন্তু বর্তমানে অনেকগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে চাইলে যে কারো সাথে এবং যে কোনো ধরণের মানুষের সাথে একটা কিশোর ও তরুণ দিনের পর দিন সময় কাটাতে পারছে। ফলে, সৎ সঙ্গ ও অসৎ সঙ্গ পার্থক্য করে দেওয়ার পুরনো নীতি এখন আর কোনোভাবেই কার্যকর নয়। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কি আসলে সেভাবে ভাবতে পারছি? এর সমাধান কী? আমি ঠিক জানি না আসলে। কিন্তু ভাবা যে দরকার, সেটুকু নিশ্চয়ই উপলব্ধি করি।
প্রযুক্তিতে সর্বশেষ যে বিষয়টি এসে যুক্ত হয়ে পৃথিবীব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তা হলো AI প্রযুক্তি বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বাংলায় যাকে বলছি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। এটা রীতিমতো জাদু দেখাচ্ছে আর আমরা সে জাদুতে বুঁদ হয়ে আছি। মহাসমারোহে আনন্দচিত্তে এর জয়ধ্বনি করে বিপুল প্রচারণা চালাচ্ছি একে গ্রহণ করার জন্য। আমি একে এড়াতে বলছি না, মেনে নিতে বা অংশ নিতে নিষেধও করছি না। সময়ের অনিবার্য উপাদান হিসেবে এতে অংশ না নিলে কোনঠাসা হব জানি; তবু, আমার মনে হয় আমাদের একটু নড়েচড়ে বসা দরকার। অনিবার্য হিসেবে মেনে নেওয়া এক জিনিস আর আনন্দচিত্তে গ্রহণ করা আরেক জিনিস।
বর্তমান AI একদমই প্রাথমিক স্তরে আছে। এবং ভবিষ্যতে কীসে পরিণত হতে যাচ্ছে তা চোখের সামনেই দেখতে পাওয়া যায়। কয়েক দিন আগে দেখলাম AI পরিচালিত এমন কিছু ক্ষুদ্রাকৃতির ড্রোন তৈরী করা হয়েছে, যা মাছির মতো উড়ে গিয়ে একদম সুনির্দিষ্টভাবে একজন মানুষকে খুন করে আসবে। সেই মানুষটা কোথাও গিয়ে তার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। সকল কিছু ভেদ করে যমদূতের মতো এটা তার কাছে পৌঁছে যাবে। নিজের অফিসে বসে এমন এক লক্ষ ড্রোন কোনো এলাকায় পাঠিয়ে দিলে কোনো ধ্বংসযজ্ঞ না চালিয়েই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সে এলাকার সমস্ত মানুষকে খুন করে আসবে, সামান্য সময়ের ভিতরে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইমেইল, বিভিন্ন এপসহ সামগ্রিকভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষের তথ্য জায়ান্ট কোম্পানি ও সে দেশের সরকারের হাতে বিদ্যমান। এর সাথে এসে যুক্ত হয়েছে “নিউরালিঙ্ক” (Neuralink)। এটি একটি ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) ডিভাইস, যা মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে কম্পিউটার বা যন্ত্রের সরাসরি সংযোগ তৈরি করতে পারে। যারা এসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই টের পান মানব সভ্যতা খুব দ্রুতই একটা রোবটিক যুগের ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
পুরাতনের প্রতি মোহ থাকলেও নতুনকে স্বাগত জানাতে আমার আপত্তি ছিল না; কিন্তু সেই নতুন যখন এমন ভীষণ রূপে দেখা দেয়, তখন মনে হয় এতোটা উন্নতি আমি চাই না আসলে। আমি আমার পুরনো সেই মানুষের পৃথিবীটাই চাই। এর প্রতিই আমার সমস্ত পক্ষপাত। মানুষ যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। ভুলে গেছে কোথায় গিয়ে তার থামা উচিত। মাঝে মাঝে বড়ো হতাশা আর নৈঃসঙ্গ অনুভূত হয়। মনে মনে বলি—মানুষ, থামো! আর কোথায় যেতে চাও তুমি!